মূল্যবোধ কি?
মূল্যবোধ হলো ঐসব চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্খা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, যা মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার ও কার্যাবলীকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। মূল্যবোধ মানুষের ব্যক্তিগত ব্যবহার ও আচার-আচরণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে এবং সার্বিকভাবে একটি গাইডলাইন হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ পরিচালনাকারী নীতি ও মানদন্ড। অর্থাৎ কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাসকে মূল্যবোধ বলে। স্বাধীনতা, ন্যায়নীতি, সততা প্রভৃতি মূল্যেবোধের উদাহরণ। মূল্যবোধ স্থায়ী নয় বরং পরিবর্তনশীল, বয়স এবং সময় মূল্যেবোধ পরিবর্তন করতে সহায়তা করে। মূল্যবোধের তুলনায় মনোভাব অপেক্ষাকৃত বেশি পরিবর্তনশীল।
মূল্যবোধের উদাহরণ হল:
- ব্যক্তিগত: স্বতন্ত্র মূল্যবোধের মধ্যে সহানুভূতি, সততা, দয়া বা উদারতা অন্তর্ভুক্ত।
- সম্পর্ক: আন্তঃব্যক্তিক মূল্যবোধের মধ্যে আস্থা, বন্ধুত্ব, আনুগত্য বা অন্তরঙ্গতা অন্তর্ভুক্ত।
- কাজ: কর্মজীবনের মূল্যবোধের মধ্যে পেশাদারিত্ব, নেতৃত্ব বা দলগত কাজ অন্তর্ভুক্ত।
- সমাজ: বৃহত্তর সমাজের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধের মধ্যে পরিবেশবাদ, সামাজিক ন্যায়বিচার অন্তর্ভুক্ত।
মূল্যবোধগুলো আমাদের আত্মবোধের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এটি সুখ, তৃপ্তি এবং পরিপূর্ণতার অনুভূতি তৈরি করে এবং আমাদের আচরণের সুস্থ নিদর্শন বিকাশে সহায়তা করে। এছাড়াও মূল্যবোধ আমাদেরকে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় এর সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
মূল্যবোধের গুরুত্ব
- মূল্যবোধ মানুষের মৌলিক আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষাগুলোকে জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত একটি স্থিতিশীল এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতিতে সংহতকরণ এবং পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- এগুলো ব্যক্তিগত, সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং মনোভাব সমন্বয়ে গঠিত সামাজিক কর্মের সাধারণ অভিজ্ঞতা।
- মূল্যবোধ সমাজ গড়ে তোলে এবং সামাজিক সম্পর্ককে একীভূত করে।
- এটি মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে এবং অন্যদের কর্মের মূল্যায়নের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে।
- সামাজিক জীবন পরিচালনায় বিরাট ভূমিকা রাখে।
- দৈনন্দিন আচরণ পরিচালনার জন্য আদর্শ মানদন্ড তৈরি করতে সহায়তা করে।
মূল্যবোধের সংজ্ঞা
সমাজবিজ্ঞানী গ্রিন এর মতে, ‘‘মূল্যবোধ হচ্ছে তুলনামূলকভাবে স্থায়ী সচেতনতা যা আবেগের সন্নিকটস্থ অবস্থা, লক্ষ্য, ধারণা অথবা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।’’
সমাজবিজ্ঞানী স্কেফার মতে, ‘‘ভালো বা মন্দ, ঠিক বা বেঠিক এবং কাঙ্খিত বা অনাকাঙ্খিত বিষয় সম্পর্কে সমাজের বিদ্যমান ধারণার নাম হলো মূল্যবোধ।’’
স্টুয়ার্ট সি. ডড -এর মতে, “সামাজিক মূল্যবোধ হলো সেই সকল রীতি-নীতির সমষ্টি যা ব্যক্তি সমাজের নিকট হতে আশা করে এবং যা সমাজ ব্যক্তির নিকট হতে লাভ করে।’’
সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম -এর মতে, “মূল্যবোধ মানুষের ইচ্ছার একটি প্রধান মানদণ্ড। এর আদর্শে মানুষের আচার-ব্যবহার ও রীতিনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এই মানদন্ডে সমাজে মানুষের কাজের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।’’
M. Haralambos এর মতে, “মূল্যবোধ হল একটি বিশ্বাস যা কিছু ভাল এবং কাম্য”।
এম রোকেচের মতে, “মূল্যবোধ হল সার্বজনীন বিশ্বাস যা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ক্রিয়াকলাপ এবং সিদ্ধান্ত নির্দেশ করে”।
এডওয়ার্ড স্প্রেঞ্জারের মতে, “মূল্যবোধ হল দৃষ্টিভঙ্গি, কুসংস্কার, অভ্যন্তরীণ প্রবণতা, পছন্দ ও অপছন্দ, যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক বিচার, এবং বিশ্ব সম্পর্কে একজন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করে এমন সংস্থার ধরণগুলির একটি নক্ষত্রপুঞ্জ”।
মূল্যবোধের প্রকারভেদ
- সামাজিক মূল্যবোধ
- রাজনৈতিক মূল্যবোধ
- গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
- ধর্মীয় মূল্যবোধ
- সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ
- নৈতিক মূল্যবোধ
- অর্থনৈতিক মূল্যবোধ
প্রত্যেক সামাজিক পরিবেশে মানুষের আচরণ ক্ষেত্রের বৈচিত্র্যতার প্রেক্ষাপটে মূল্যবোধের ধারণাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. সামাজিক মূল্যবোধ: সুস্থ সামাজিক জীবন যাপনের জন্য সমাজ জীবনে সম্পাদিত আচরণের আদর্শগত দিক হল-সামাজিক মূল্যবোধ। সামাজিক মূল্যবোধ হলো সামাজিক শিষ্ঠাচার, সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, শ্রমের মর্যাদা, শৃঙ্খলাবোধ, আত্মত্যাগ প্রভৃতি মানবিক সুকুমার বৃত্তির সমষ্টি। সামাজিক মূল্যবোধ হলো মানুষের আচরণ বিচারের মানদণ্ড। সামাজিক মূল্যবোধের মাপকাঠিতে মানুষের কাজের ভালো-মন্দের বিচার করা হয়।
২. রাজনৈতিক মূল্যবোধ: বর্তমান জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত। যে কারণে বর্তমানে রাজনৈতিক মূল্যবোধকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিচার বিবেচনা করা হয়। রাজনৈতিক আদর্শ, আনুগত্য, পরমসহিষ্ণুতা, দায়িত্বশীলতা, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সহনশীলতা প্রভৃতি বিষয় রাজনৈতিক মূল্যবোধের অংশবিশেষ।
৩. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। গণতন্ত্র থেকে উৎসারিত মূল্যবোধ-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। গণতান্ত্রিক আদর্শ ও রীতিনীতি অনুশীলনের আদর্শিক দিকই হল-গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।
৪. ধর্মীয় মূল্যবোধ: ধর্মীয় ঐতিহ্য, বিশ্বাস, গ্রন্থ চর্চা প্রভৃতি থেকে উদ্ভদ মূল্যবোধসমূহকে ধর্মীয় মূল্যবোধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আবার যে কোনো ধর্মের মূল্যবোধকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া, ধর্মীয় মূল্যবোধ পালনের স্বাধীনতা দেওয়াও ধর্মীয় মূল্যবোধের অন্তর্ভুক্ত। ধর্মবিশেষে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিভিন্ন হয়ে থাকে। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, অপরের ধর্মমতকে শ্রদ্ধা করা, অন্যের ধর্ম পালনে বাধা প্রদান না করা, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধর্মকে শ্রেষ্ঠ না ভাবা এবং বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদান না করাই হল-ধর্মীয় মূল্যবোধ।
৫. সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ: মানুষ তার লালনকৃত বা ধারণকৃত সংস্কৃতি থেকে যে মূল্যবোধ গ্রহণ করে- সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। সাংস্কৃতিক মূলবোধ বেশি পরিমানে উদ্ভূত হয়-সামাজিক প্রথা থেকে। যেমন, একটি নির্দিষ্ট সমাজ বা দেশের প্রচলিত পোশাক-পরিচ্ছেদ, খাবার, গান, অনুষ্ঠান ইত্যাদি ধারণ করা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উদাহরণ।
৬. নৈতিক মূল্যবোধ: ব্যক্তি তার কর্মপন্থা স্বাধীনভাবে নির্বাচন করে। যে কোনো পরিস্থিতিতে কী করা উচিত বা উচিত নয় সে বিষয়ে প্রত্যেককে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। ব্যক্তির এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর তার জীবনের সাফল্য বা অসাফল্য নির্ভর করে।
মূল্যবোধের বৈশিষ্ট্য
মূল্যবোধের কিছু বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি রয়েছে। যেমন,
১. পরিবর্তনশীলতা: মূল্যবোধের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর পরিবর্তনশীলতা। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে। কারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, চাহিদা ইত্যাদি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ মানুষের মননশীলতার উপর মূল্যবোধ নির্ভরশীল। অতীতের অনেক মূল্যবোধ বর্তমানে আমাদের কাজে অর্থহীন, যেমন: বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদি।
২. আপেক্ষিকতা: মূল্যবোধ, বৈচিত্র্যময় ও আপেক্ষিক। আজ যা মূল্যবোধ বলে বিবেচিত, কাল তা সেভাবে বিবেচিত নাও হতে পারে। তাই সামাজিক মূল্যবোধ একটি আপেক্ষিক প্রত্যয়।
৩. বিভিন্নতা: স্থান-কাল ভেদে মূল্যবোধ বিভিন্ন রকম হতে পারে অর্থাৎ একেক সমাজে মূল্যবোধ একেক ধরনের। যেমন পশ্চিমা বিশ্বে মেয়েরা যে ধরনের পোশাক পরিধান পরিচ্ছদ পরে আমাদের সমাজে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আবার মুসলিম সমাজের মূল্যবোধ আর খ্রিস্টান বা হিন্দু সমাজের মূল্যবোধ এক নয়।
৪. সামাজিক মাপকাঠি: মূল্যবোধ মানুষের আচার-ব্যবহার, ধ্যান-ধারণা, চালচলন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করার মাপকাঠি স্বরূপ, এসব নিয়ন্ত্রণ সমাজের মানুষকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে। একই রাজনীতি আচার, অনুষ্ঠান ও আদর্শের ভিত্তিতে সমাজের সকলের মিলিত ও সংঘবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন
৫. সমষ্টির প্রভাব: মূল্যবোধ সমাজের মানুষের সামগ্রিক ধ্যান-ধারণার সমষ্টি। এজন্য মূল্যবোধ ব্যক্তিগত আগ্রহ –অনগ্রহকে প্রভাবিত করে না। এখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা গৌণ হতে পারে।