আমাদের আজকের প্রধান আলোচ্য বিষয় শব্দ কাকে বলে এবং এর প্রকারভেদ। আমি চেষ্টা করবো আজকের লিখায় যেনো আপনাদের শব্দের সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারনা দিতে পারি যাতে করে করে সকলে উপকৃত হয়।
শব্দ কাকে বলে :
এক বা একাধিক ধ্বনি একত্রিত হয়ে যদি কোনো অর্থ প্রকাশ করে তবে তাকে শব্দ বলে।
অথবা,
মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকেত্ত শব্দ বলা হয়ে থাকে।
উদাহরণ:
শব্দের উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: ন্+অ+র্+অ+ম্ = ধ্বনি। এ ধ্বনি পাঁচটির মিলিত রূপ হলো ‘নরম’। ‘ ‘নরম’- ‘ন’, ‘র’, ‘ম’ ধ্বনিসমষ্টির মিলিত রূপ, যা অর্থপূর্ণ। সুতরাং ‘নরম’ একটি শব্দ।
একই রকম : আমি, মসজিদ, যাই ইত্যাদি। এগুলোর আলাদা আলাদা অর্থ আছে। কিন্তু এ রকম শব্দগুলো দিয়ে আমাদের মনের ভাব সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারি না, তাই কিছু শব্দকে একত্র করে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি।
যেমন – “আমি মসজিদে যাই।” এটি একটি বাক্য। এখানে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
শব্দ কত প্রকার ও কি কি:
বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে তিন ভাবে শব্দের শ্রেণীবিভাগ করা যায়। যেমন –
১. গঠন অনুসারে শব্দ
২. অর্থ অনুসারে শব্দ
৩. উৎপত্তি অনুসারে শব্দ
গঠন অনুসারে:
গঠন অনুসারে বাংলা শব্দ দু প্রকার। যথা:
১. মৌলিক শব্দ
২. সাধিত শব্দ
১. মৌলিক শব্দ কাকে বলে :
যে শব্দকে বিশ্লেষণ করতে পারা যায় না বা বিশ্লেষণ করলেও ভাঙা অংশের কোনো অর্থ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন – বাবা, ভাই, গাড়ি, বড়, ছোট, কম, বেশি ইত্যাদি।
মৌলিক শব্দকে ‘স্বয়ংসিদ্ধ’ শব্দও বলা হয়। কারণ- মৌলিক শব্দের অর্থ স্বতঃপ্রকাশিত ও চূড়ান্ত।
২. সাধিত শব্দ কাকে বলে:
যে সকল শব্দকে বিশ্লেষণ করলে মৌলিক একটি অংশ পাওয়া যায় তাকে সাধিত শব্দ বলা হয়।
বা, যেসব শব্দকে বিশ্লেষণ করলে আলাদা অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায় সেগুলোকে সাধিত শব্দ বলে।
সাধিত শব্দকে বিভিন্ন ভাবে তৈরি করা যায়। যেমন:
১. উপসর্গ, ধাতু ও প্রত্যয়ের যোগে।
২. ধাতু ও প্রত্যয়ের যোগে।
৩. উপসর্গ ও শব্দ যোগে।
৪. শব্দ ও শব্দ যোগে।
৫. শব্দ ও প্রত্যয়ের যোগে।
সাধিত মানে সাধন বা তৈরি করা হয়েছে। যেমন –
উপকার = উপ + √কৃ + অ (উপসর্গ+ধাতু+প্রত্যয়)
হিমালয় = হিম + আলয় (শব্দ+শব্দ)
রামায়ণ = রাম + অয়ন (শব্দের+প্রত্যয়)
একাধিক মৌলিক শব্দের যোগেও সাধিত শব্দের তৈরি হয়, যেমন – হাতপাখা = হাত+পাখা। তেমনি – জলপথ, দিনরাত, আশা আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি।
অর্থ অনুসারে শব্দ :
অর্থ অনুসারে বাংলা ভাষার শব্দসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
১। যৌগিক শব্দ
২। রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ ও
৩। যোগরূঢ় শব্দ।
যৌগিক শব্দ কাকে বলে :
যেসব শব্দের অর্থ তাদের প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের অর্থানুযায়ী নির্ধারিত হয় তাদের যৌগিক শব্দ বলে। যেমন:
পড়্+উয়া=পড়ুয়া,
ঢাকা+আই=ঢাকাই,
কৃ+তব্য=কর্তব্য।
রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ কাকে বলে :
যেসব প্রত্যয় নিষ্পন্ন শব্দে তাদের প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কোনো বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তাদের রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ বলে। যেমন:
‘সন্দেশ’ শব্দের ও প্রত্যয়গত অর্থ ‘সংবাদ’। কিন্তু এর প্রচলিত অর্থ ‘মিষ্টান্ন বিশেষ’। কাজেই ‘সন্দেশ’ রূঢ়ি শব্দ।
উদাহরণ: হস্তী, তৈল, বাঁশি ইত্যাদি ।
যোগরূঢ় শব্দ কাকে বলে :
সমাসবদ্ধ অথবা একাধিক শব্দের বা ধাতুর দ্বারা নিষ্পন্ন শব্দে যখন কোনো আপেক্ষিক অর্থ না বুঝিয়ে অন্য বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাদের যোগরূঢ় শব্দ বলে। যেমন:
‘পঙ্কজ’ শব্দের আপেক্ষিক অর্থ হলো যা পঙ্কে জন্মে তা, অর্থাৎ শৈবাল, পদ্মফুল, কেঁচো প্রভৃতি।
কিন্তু পঙ্কজ বললে শুধু পদ্মফুলকেই বোঝায়। কাজেই ‘পঙ্কজ’ যোগরূঢ় শব্দ।
এছাড়া রয়েছে রাজপুত্র, সরোজ, জলধি, মহাযাত্রা ইত্যাদি ।
৩. উৎপত্তি অনুসারে শব্দ :
শব্দকে উৎপত্তির দিক থেকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
১. তৎসম শব্দ
২. অর্ধতৎসম শব্দ
৩. তদ্ভব শব্দ
৪. দেশি শব্দ ও
৫. বিদেশি শব্দ
১. তৎসম শব্দ কাকে বলে :
যেসকল শব্দগুলো সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে এবং যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে সেসব শব্দকে বলা হয় তৎসম শব্দ।
তৎসম এটি একটি পারিভাষিক শব্দ।
যার অর্থ [তৎ (তার)+ সম (সমান)] = তার সমান অর্থাৎ সংস্কৃত।
তৎসম খুবই গুরুগম্ভীর হয়ে থাকে, তাই গুরুগম্ভীর বাংলা লিখতে গেলে তৎসম শব্দের ব্যবহার করতে হয়। বাংলা সাধু ভাষার বেশির ভাগ শব্দই তৎসম। তৎসম শব্দের উদাহরণ: চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম,মনুষ্য ইত্যাদি।
২. অর্ধতৎসম শব্দ কাকে বলে :
বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দকে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে ব্যবহার করা হয়, সেগুলোকে বলে অর্ধতৎসম শব্দ।
তৎসম মানে সংস্কৃত। আর অর্ধতৎসম মানে আধা সংস্কৃত।
তৎসম শব্দকে বিকৃত উচ্চারণের ফলে অর্ধতৎসম শব্দের উৎপত্তি হয়ে থাকে।
উদাহরণ: জোছনা, ছেরাদ্দ, গিন্নি, বোষ্টম ইত্যাদি
এই শব্দগুলো যথাক্রমে সংস্কৃত জ্যোত্স্না, শ্রাদ্ধ, গৃহিণী, বৈষ্ণব শব্দের থেকে আগত।
৩. তদ্ভব শব্দ কাকে বলে :
যে শব্দগুলি সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে তাদের বলে তদ্ভব শব্দ।
উদাহরণ:
হাত (<হস্ত)
পা (<পদ)
মাথা (<মস্তক)
গা (<গাত্র)
কান (<কর্ণ)
৪. দেশি শব্দ কাকে বলে :
যেসব শব্দগুলো অতি প্রাচীন কাল থেকে এদেশে প্রচলিত হয়ে আসছে এবং সভ্যতার বিকাশে যা বিলুপ্ত বা বিকৃত হয়ে যায়নি তাদের দেশি শব্দ বলে।
উদাহরণ: ঢেঁকি,কুলা,ডিঙা ইত্যাদি।
দেশি শব্দ মনে রাখার সহজ উপায়
চাল, ডাল, ঢেকি, কুলা
ডাব, ঢোল, কুড়ি, চুলা
চুঙ্গা, টোপর, গঞ্জ, ডিঙ্গা
ধুতি, ডাগর, পেট, সিঙ্গা
৫. বিদেশী শব্দ কাকে বলে :
রাজনৈতিক, ধর্মীয়, বানিজ্যিক বা সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দের বাংলা ভাষায় আগমন ঘটেছে তাদের বিদেশী শব্দ বলে৷
উদাহরণ: চেয়ার, কলম, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি।
এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ভাষার শব্দ। যেমন-
আরবি শব্দ :
আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওযু, কোরবানি, কুরআন, কিয়ামত, গোসল,জান্নাত, জাহান্নাম, হওবা, হসবি, যাকাত, হজ, হাদিস, হারাম, হালাল আদালত ইত্যাদি।
ফারসি শব্দ
খোদা, গুনাহ, দোযখ, নামায, পয়গম্বর, ফেরেশতা, বেহেশত, রোযাকারখানা, চশমা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান,দস্তখত ইত্যাদি।
ইংরেজি শব্দ:
১. অপরিবর্তিত উচ্চারণে- চেয়ার, টেবিল
২. পরিবর্তিত উচ্চারণে- আফিম (opium), ইস্কুল (school), বাক্স (box), হাসপাতাল (hospitai), বোতল (bottle)
পর্তুগিজ শব্দ :
আনারস, আলপিন, আলমারি, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাউরুটি, পাদ্রি, বালতি
ফরাসি শব্দ :
কার্তুজ, কুপন , ডিপো, রেস্তোঁরা
ওলন্দাজ শব্দ :
ইস্কাপন, টেক্কা, তুরুপ, রুইতন, হরতন (তাসের নাম)
গুজরাটি শব্দ :
খদ্দর, হরতাল
পাঞ্জাবি শব্দ :
চাহিদা, শিখ
তুর্কি শব্দ :
চাকর, চাকু, তোপ, দারোগা
চিনা শব্দ :
চা, চিনি, লুচি
মায়ানমার/ বর্মি শব্দ :
ফুঙ্গি, লুঙ্গি
জাপানি শব্দ :
রিক্সা, হারিকিরি
মিশ্র শব্দ :
এছাড়াও আরেকটি বিশেষ ধরনের শব্দের দেখা পাওয়া যায়। দুইটি ভিন্ন ধরনের শব্দকে সমাসবদ্ধ করে বা অন্য কোনো উপায়ে একত্রিত হলে ঐ নতুন শব্দটিকে বলা হয় মিশ্র শব্দ। যেমন-
১. রাজা-বাদশা (তৎসম+ফারসি)
২. হাট-বাজার (বাংলা+ফারসি)
৩. হেড-মৌলভী (ইংরেজি+ফারসি)
মুণ্ডমাল শব্দ
একটি বাক্য বা বাক্যাংশের পদগুলোর প্রথম বর্ণগুলোকে একত্র করে যে শব্দকে গঠন করা হয় তাকে মুন্ডমাল শব্দ বলে। ইংরেজিতে এক্রোনেইম বলে। যেমনঃ দুদক-(দুর্নীতি দমন কমিশন )