তাহাজ্জুদ নামাজ এর গুরুত্ব অপরিসীম। আজকে আমরা জানবো তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম – নিয়ত এবং ফজিলত সম্পর্কে।
মূলত পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এই নামাজ পড়ার বিষয়ে বিশেষ ভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং এর ফজিলত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনাও সেখানে দেওয়া হয়েছে।
তাহাজ্জুদ কি ?
তাহাজ্জুদ শব্দটি একটি আরবি শব্দ।
যার অর্থ হলো ঘুম থেকে জাগা অর্থ্যাৎ ঘুম ত্যাগ করে গভীর রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নামাজ আদায় করা।
আমরা অনেকেই তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না এবং এর ফজিলত সম্পর্কেও আমাদের বিশদ কোনো ধারনা নেই।
তাই আমরা আজকে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।
তাহাজ্জুদ হলো একটি নফল ইবাদত তবে এটি নফল ইবাদত গুলোর মধ্যে অন্যতম।
যারা বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে তাদের মধ্যেই একশ্রেনীর মানুষ হলেন তারা যারা অত্যন্ত যত্নের সাথে এই নামাজ গভীর রাতে নিয়ম নিষ্ঠা ভরে আদায় করবে।
আমাদের সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন তাহাজ্জুদ হলো নফল নামাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নামাজ।
তিনি নিয়মিত এই নামাজ পড়তেন এবং তার সাহাবীদের ও উৎসাহিত করতেন।
আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-এর কাছে রাসুল (সা.)-এর তাহাজ্জুদ নামাজ (রাতের) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।
তিনি বললেন, তিনি রাতের প্রথমাংশে ঘুমাতেন। তারপর নামাজে দাঁড়াতেন এবং সাহরির পূর্বক্ষণে বিতর আদায় করতেন।
এরপর প্রয়োজন মনে করলে বিছানায় আসতেন।
তারপর আজানের শব্দ শুনে জেগে উঠতেন এবং অপবিত্র হলে সর্বাগ্রে পানি বইয়ে গোসল করে নিতেন নতুবা অজু করতেন।
তারপর নামাজ আদায় করতেন। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৬৮০; মুসনাদ আহমদ, হাদিস : ২৫৪৭৪)
তাহাজ্জুদ নামাজ কি ?
এটি হলো একটি নফল ইবাদত।
যা রাতের গভীরে ঘুম থেকে জেগে উঠে নিষ্ঠা ভরে এক মনে আদায় করতে হয় আল্লাহ’র সন্তুষ্টি আদায়ের জন্য৷
৫ ওয়াক্ত ফরয নামাজের পর সকল সুন্নত ও নফল নামাজের মধ্যে এই নামাজ সর্বোত্তম এবং এর ফজিলত ও গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি৷
যখন এই ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরয হয় নি তখন এই তাহাজ্জুদের নামাজ আমাদের নবীজীর উপর বাধ্যতামূলক ছিলো।
সেই কারণে তিনি কখনো এই নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকেন নি।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সা্ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সব নফল নামাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ তথা রাতের নামাজ।’ (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
কিন্তু তার উম্মাত দের জন্য এই নামাজ সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদা করে দেওয়া হয়।
সুতরাং এই নামাজ না পড়লে কোনো পাপ হবে না তবে তা পড়লে অনেক সোওয়াব লাভ করা যাবে।
যে এই নামাজ পড়বে সে অনেক পুন্যের অধিকারী হবে।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত:
আরবি:
نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ رَكَعَتِى التَّهَجُّدِ – اَللهُ اَكْبَر
বাংলা উচ্চারণ:
“নাওয়াইতু আন উছোয়াল্লিয়া লিল্লাহি তা’আলা রাকাতাই ছলাতিত তাহাজ্জুদী সুন্নাতু রাসুলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।”
অর্থ: আমি আল্লাহর ওয়াস্তে কেবলামুখী হইয়া তাহাজ্জুদের দু-রাকআত নফল নামাজ আদায় করিবার নিয়ত করিলাম। আল্লাহু আকবার।”
তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্তের নিয়ম এবং রাকাআত:
তাহাজ্জুদ নামাজ এর ওয়াক্ত –
এশার নামাজের পর থেকে সুবেহ-সাদিকের আগ পর্যন্ত সালাতুল লাইল বা তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা যায়।
তবে সর্বোত্তম সময় হচ্ছে গভীর রাত অর্থ্যাৎ এশার নামাজের পর সকলে ঘুমাবে এবং গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে এই নামাজ আদায় করবে।
নবী কারীম (সাঃ) কখনো মাঝ রাতে, কখনো তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আল-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পড়তেন। তারপর মেসওয়াক ও অযু করে নামায পড়তেন।
তাহাজ্জুদ নামাজ এর রাকাআত-
তাহাজ্জুদের নামাজ ২ থেকে ১২ রাকাআত পর্যন্ত
পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। যার মানে হলো সর্বনিম্ন ২ রাকাআত এবং সর্বোচ্চ ১২ রাকাআত পর্যন্ত পড়া যেতে পারে।
আমাদের নবী (সাঃ) ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতেন। সুতরাং ৮ রাকাআত আদায় করায় উত্তম।
তবে এতে কোনো বাধ্যবাদকতা নেই, যার যার মন খুশি মতো আদায় করতে পারে। তাহাজ্জুদের নামাজের কোনো কাজা হয় না।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম:
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী।”
সুতরাং তাহাজ্জুদের নামাজ ২ রাকাআত আদায় করলেও তার তাহাজ্জুদ আদায় করা হয়েছে বলে মনে করা হয়।
যে কোনো সুরা বা কেরাত দিয়েই এ নামাজ পড়া যায়। নবী করিম(সাঃ) যথাসম্ভব লম্বা কেরাত, লম্বা রুকু ও সেজদা সহকারে একান্ত নিবিষ্ট মনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন।
তাই লম্বা কেরাতে তাহাজ্জুদ আদায় করা সর্বোত্তম। কেরাত উঁচু বা নিচু উভয় আওয়াজে পড়া জায়েজ রয়েছে। তবে উচু স্বরে পড়া যদি কারও কষ্টের কারণ হয় তবে চুপিচুপি পড়া কর্তব্য।
১. প্রথমেই তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বাঁধতে হবে।
২. তারপর ছানা পড়তে হবে।
৩. সুরা ফাতেহা পড়ে তার সাথে অন্য সূরা বা সূরার অংশবিশেষ বা কেরাত পড়তে হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক লম্বা কেরাত পড়তেন।
৪. তারপর অন্যান্য নামাজের ন্যায় রুকু, সেজদা আদায় করতে হবে।
এভাবেই দ্বিতীয় রাকাআত আদায় করে তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করতে হবে।
এই একই নিয়মে দুই দুই রাকাআত করে ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজ এর ফজিলত:
তাহাজ্জুদের ফজিলত অপরিসীম যা বলে শেষ করা যাবে না কেননা উক্ত নামাজ পড়া হয় মহান আল্লাহ্ তা’লা কে খুশি করার উদ্দ্যেশ্যে। তাছাড়া বিভিন্ন হাদিস ও কুরআনে এসেছে-
ফরয নামাজের পর অন্যান্য সুন্নাত ও নফল সব নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ফযীলত সবচেয়ে বেশী (আহমাদ, মেশকাত ১১০ পৃঃ)
রাসুল (সাঃ) বলেন, আমাদের প্রভু পরওয়ারদিগার তাবারাকা ওয়া তা’আলা প্রত্যেক রাত্রে দুনিয়ার আসমানে (যা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়) নেমে আসেন যখন রাত্রের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকে । অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদের কে আমাকে ডাকবে! আমি তার ডাকে সাড়া দেব । কে আমার কাছে কিছু চাইবে আমি তাকে তা দেব, কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব (মুসলিম, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)
রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এবং সে তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে নামায পড়ায় এমনকি সে যদি জেগে না উঠে, তবে তার মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করে থাকেন।
রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কোন মহিলা যদি রাত্রিকালে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে এবং সে তার স্বামীকে নামাযের জন্য জাগায় এমনকি স্বামী না জাগলে স্ত্রী তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয় তাহলে তার প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে (আবু দাউদ, নাসায়ী, মেশকাত ১০৯ পৃঃ)
কেয়ামতের ভয়াবহ বিপর্যয় ও কঠিন হিসাব-নিকাশের দিন কোন ব্যক্তি যদি সহজ হিসাব কামনা করতে চায়, তবে তার উচিত হবে নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া কেননা এর ফজিলত অনেক।
আল্লাহ তাআলা সকল মুসলিম জাতিকে যথাযথভাবে রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আজকে আমরা তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম – নিয়ত এবং ফজিলত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করছি। আশা করি লেখাটি আপনাদের উপকারে আসবে।