ইস্তেখারা এর নিয়ত, দোয়া ও নামাজ আদায়ের নিয়ম

ইস্তেখারা কি?

ইস্তেখারা একটি আরবি শব্দ এবং এর অর্থ হলো- কল্যাণ প্রার্থনা করা অথবা এমন কিছু প্রার্থনা করা যাতে কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

সুতরাং  যে কাজটি করা হবে তাতে  কল্যাণ রয়েছে কিনা তার ইশারা-ইঙ্গিত পেতে ইস্তেখারার নিয়তে দুই রাকাআত নামাজ আদায় ও দোয়া পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বিশেষ প্রার্থনা করাই হলো ইস্তেখারা।

সালাতুল ইস্তেখারা করা এটি হলো একটি সুন্নাত ইবাদত ।আমাদের প্রিয় নবি হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এই সুন্নাত ইবাদত এর বিষয় টি আদায় করার বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

এই বিষয়ে বিভিন্ন হাদিসে এসেছে যে

হজরত জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যেভাবে কুরআনের সুরা শেখাতেন; ঠিক সেভাবে (গুরুত্বের সঙ্গে) প্রতিটি কাজের আগে আমাদের ইস্তেখারা (কল্যাণ প্রার্থনা) করার শিক্ষা দিতেন।

শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তায়মিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ইস্তেখারা সম্পর্কে বলেন, ‘ওই ব্যক্তি অনুতপ্ত হবে না; যে আল্লাহর কাছে ইস্তেখারা বা কল্যাণ কামনা করে, মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার উপর অটল-অবিচল থাকে।; কেননা আল্লাহ তাআলা পরামর্শের আলোকে কাজ করার কথা বলেছেন এভাবে-

وَشَاوِرْهُمْ فِي الأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللّهِ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ‘

আর তুমি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে পরামর্শ কর। এরপর আল্লাহর উপর ভরসা কর (সিদ্ধান্তে অটল থাক)। নিশ্চয়ই আল্লাহ (তার ওপর) ভরসাকারীদেরকে ভালোবাসেন।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৫৯)

হজরত কাতাদা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- ‘মানুষ যখন আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর পরামর্শ করে তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সব চেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার তাওফিক দেন।’

সালাতুল ইস্তেখারা কখন করতে হয়?

মানুষ অনেক সময় একাধিক বিষয়ের মধ্যে কোনটিকে গ্রহণ করবে এবং কোনটি তার জন্য কল্যানকর সে বিষয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কারন সে বুঝতে পারে না কোথায় তার কল্যাণ নিহীত রয়েছে।

কেননা  সে ব্যাপারে আমাদের কারো কোনো জ্ঞান নেই।

তাই একটি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে কল্যান লাভের জন্য আসমান জমীন সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্’র  নিকট সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইস্তেখারা করতে হয় বা সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়।

যেনো তিনি তার সিদ্ধান্তকে এমন কোনো  জিনিসের উপর স্থীর করে দেন যা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী জন্য উপকারী হবে।

বিয়ে, চাকুরী, ব্যবসা,সফর ইত্যাদি বৈধ বিষয়ে ইস্তেখারা করা  উত্তম বলে ধরা হয়।

ইস্তেখারা করার নিয়ম

১. প্রথমেই ওযু করে পাক পবিত্র হতে হবে।

২. এরপর ২ রাকাআত নফল নামায আদায় করতে  হবে।

৩.  নামাযের সালাম ফিরিয়ে আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও মর্যাদার কথা মনে জাগ্রত করে একান্ত বিনয় ও নম্রতার সহিত আল্লাহর প্রশংসা ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর দরূদ পাঠ করতে হবে।

এর পর ইস্তেখারার দুয়াটি পাঠ করতে হবে।

ইস্তেখারা এর দোয়া-

আরবি-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ وَأَسْتَقْدِرُكَ بِقُدْرَتِكَ وَأَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِكَ الْعَظِيمِ، فَإِنَّكَ تَقْدِرُ وَلاَ أَقْدِرُ وَتَعْلَمُ وَلاَ أَعْلَمُ وَأَنْتَ عَلاَّمُ الْغُيُوبِ، اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ خَيْرٌ لِي فِي دِينِي ومعاشِى وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاقْدُرْهُ لِي وَيَسِّرْهُ لِي ثُمَّ بَارِكْ لِي فِيهِ، وَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنَّ هَذَا الأَمْرَ شَرٌّ لِي فِي دِينِي ومعاشِى وَعَاقِبَةِ أَمْرِي فَاصْرِفْهُ عَنّي وَاصْرِفْنِي عَنْهُ وَاقْدُرْ لِيَ الْخَيْرَ حَيْثُ كَانَ ثُمَّ أَرْضِنِي بِهِ.

বাংলা অনুবাদ-

আল্লাহুম্মা ইন্নী-আস্তাখিরুকা বি-ইলমিকা ওয়া আস্তাকদিরুকা বি-কুদরাতিকা ওয়াআসআলুকা মিনফাদলিকাল আযীম, ফা-ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু, ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লামু ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ূব। আল্লাহুম্মা ইনকুন্তা তা’লামু আন্না “হাযাল আমরা” খাইরুল্লি ফীহ- দ্বীনী ওয়া মা’আশী ওয়া আক্বিবাতি আমরী, ফাকদুরহুলী ওয়া-্ইয়াসসিরহু লী, সুম্মা বা-রিকলী ফীহি, ওয়া ইন কুনতা তা’লামু আন্না হাযাল আমরা শাররুল্লী ফী দীনী ওয়া মা’আশী ওয়াআকীবাতি আমরি,ফাসরিফহু আন্নী ওয়াসরীফনী আনহু ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা সুম্মা আরদিনী বিহী।

বাংলা অর্থ-

“হে আল্লাহ! আমি তোমার জ্ঞানের সাহায্য চাইছি, তোমার শক্তির সাহায্য চাইছি এবং তোমার মহান অনুগ্রহ চাইছি। তুমিই শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী, আমার কোন ক্ষমতা নেই।

তুমি অফুরন্ত জ্ঞানের অধিকারী, আমার কোন জ্ঞান নেই। তুমি অদৃশ্যবিষয়ে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত।

হে আল্লাহ! তুমি যদি এ কাজটি আমার জন্য, আমার দ্বীনের দৃষ্টিকোণ হতে, আমার জীবন যাপনের ব্যাপারে এবং আমার কাজের পরিণামের দিক হতে, ভাল মনে কর তবে তা আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দাও এবং আমার জন্য সহজ করে দাও।

পক্ষান্তরে তুমি যদি এ কাজটি আমার জন্য আমার দ্বীনের দৃষ্টিকোণ হতে, আমার জীবন যাপনের ব্যাপারে এবং আমার কাজকর্মের পরিণামের দিক হতে ক্ষতিকর মনে কর, তবে তুমি সে কাজটি আমার থেকে দূরে সরিয়ে দাও।

এবং আমাকে তা থেকে বিরত রাখ। এবং যেখান থেকে হোক তুমি আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ করে দাও”।

(তিরমিজি ৪৮০ ইবনু মাজাহ (১৩৮০,রিয়াদুস সলিহীন ৭২২)

এই দুয়ার  মধ্যে যেখানে “হাজাল আমরা” শব্দটি এসেছে সেখানে-

যে কাজটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন মনে মনে সে কাজটি স্মরণ করবেন।

উক্ত দু’আ পাঠ শেষ করে কারো সাথে কোনোরকম কথা না বলে কিবলামুখী হয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন।

ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর মন যেদিকে সাড়া দিবে বা যেদিকে আগ্রহ পোষন করবে, সেটিই ফলাফল মনে করবেন।

সেই কাজের মধ্যেই আপনার জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে ধরে নিবেন ।

এর জন্য স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্নে নির্দেশনা পাওয়া বাধ্যতামূলক না।

আর যদি কারো ঘুমানোর সময় না থাকে অর্থাৎ খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চান, তাহলে দোয়াটি শেষ করার পর যেইদিকে আপনার মন আগ্রহ পোষণ করবে সেটাই ফলাফল বলে মনে করে নিতে হবে ।

ইনশাআল্লাহ বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবেন এবং সেই কাজ সফল হবে।

নামাজের নিয়ম-

যেভাবে আমরা ৫ ওয়াক্ত নামাজে নফল নামাজ আদায় করি সেভাবে পড়লেই সালাতুল ইস্তেখারা আদায় করা হয়ে যাবে।

তবে নফল নামাজ আদায়ের পূর্বে নিয়ত থাকতে হবে ইস্তেখারার।

ইস্তেখারার উদ্দেশ্যে নফল নামাজ আদায় করার কথা চিন্তা করলেই নিয়ত হয়ে যাবে ।

তারপর প্রথম রাকাতে সুরা ফাতেহার পরার পর, যেকোনো একটি সূরা মিলিয়ে পড়তে হবে।

আর দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতেহার পর যেকোনো অন্য আরেকটি সূরা মিলিয়ে পড়তে হবে যেভাবে অন্যান্য নামাজের ক্ষেত্রে পড়া হয়।

তাছাড়াও আপনি চাইলে আরো একটি নিয়মে নামাজ আদায় করতে পারেন। সেক্ষেত্রে-

প্রথম ও দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতেহার পর ৩ বার করে সূরা ইখলাস পড়া যেতে পারে ।

যে নিয়ম আপনার জন্য অধিক সহজ মনে হবে আপনি চাইলে সেই নিয়মই নফল নামাজ আদায় করতে পারবেন এতে সুষ্ঠু ভাবে নামাজ আদায়ে কোনো প্রভাব পড়বে না।

নিয়ত

আপনি চাইলে আরবীতে বা বাংলাতে মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করতে পারেন।

আরবি-

نويت ان اصلي لله تعالى ركعتى صلواة الاستخارة نفل متوجها إلى جهة الكعبة الشريفة الله اكبر

বাংলায় উচ্চারণ:-

নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা রাকয়াতাই সালাতিল ইস্তেখারাতি নাফলা, মুতাওয়াজজিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।

বাংলায় নিয়ত:-

“আমি কাবা শরীফের দিকে কিবলা মুখী হইয়া আল্লাহর জন্য দুই রাকাত ইস্তেখারার নফল নামাজ আদায়ের নিয়ত করছি।  আল্লাহু আকবার” ।

কিছু বিষয় যা মনে রাখা প্রয়োজন-

১.  ইস্তিখারার দুয়া মুখস্ত না থাকলে দেখে দেখেও তা পড়া যাবে তাতে কোনো  অসুবিধা নেই।

তবে মুখস্ত করে  পড়া অধিক উত্তম।

২. যেই জন্য ইস্তিখারা করা হয় ইস্তিখারার পর সে বিষয়ে স্বপ্ন দেখা আবশ্যক নয়।

স্বপ্নের মাধ্যমেও সঠিক জিনিসটি জানতে পারা যায় আবার স্বপ্ন ছাড়াও মনের মধ্যে সে কাজটির প্রতি আগ্রহ বা অনাগ্রহ দেখা দিতে পারে। আর সেই আগ্রহ টাই সেই কাজ করার নির্দেশনা।

৩.  উক্ত বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়ার পর আল্লাহর উপর ভরসা করে দৃঢ়ভাবে কাজে এগিয়ে যাওয়ায় উত্তম। পিছুপা হওয়া বা হীনমন্যতায় ভূগা উচিত হবে না।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর যখন সিদ্ধান্ত গ্রহন করে ফেল তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর।” [সূরা আলে ইমরান: ১৫৯]

৪.  সালাতুল ইস্তিখারা ও দোয়া পড়ার পরও যদি সঠিক সিদ্ধান্তে উপণিত  হতে না পারেন তবে একধিকবার তা পড়া জায়েয রয়েছে।

৫.  এক জনের পক্ষ থেকে আরেকজন তার হয়ে সালাতুল ইস্তিখারা আদায় করার নিয়ম নেয়। তবে সাধারণভাবে তার কল্যাণের জন্য দুয়া করা যাবে।

৬.  অন্যায় বা হারাম কাজের জন্য এমন কি মাকরূহ কাজের ক্ষেত্রেও ইস্তিখারা করা জায়েজ না।

৭. যেসকল বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে থাকে অর্থাৎ বিষয়টি তার ইচ্ছার অধীনে সেসব বিষয়ে ইস্তেখারা না করা।

৮. আল্লাহর সিদ্ধান্তে সবসময় খুশি থাকা উত্তম।

আশা করছি আজকের আলোচনায় ইস্তেখারা সম্পর্কে যাবতীয় ধারনা দিতে পেরেছি। আরো কিছু জানার থাকলে প্লিজ কমেন্ট করবেন আমি যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।