পৃষ্ঠটান কাকে বলে? পৃষ্ঠটানের প্রভাব | পৃষ্ঠতল সক্রিয় পদার্থ
পৃষ্ঠটান কাকে বলে?
পৃষ্ঠটান হলো তরল তলগুলির প্রবণতা সম্ভাব্য ন্যূনতম পৃষ্ঠের অঞ্চলে সঙ্কুচিত হওয়া।
তরল ও গ্যাসের সংযোগস্থলে, তরল অণুগুলির পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ (সংসক্তি টানের জন্য), তরল ও গ্যাসের অণুগুলির আকর্ষণ (আসঞ্জন বলের জন্য) অপেক্ষা অনেক বেশি হওয়ায় পৃষ্ঠটান সংঘটিত হয়।
তরলপৃষ্ঠের নিচে অভ্যন্তরীণ বলসমূহের লব্ধি বল এমনভাবে ক্রিয়া করে, যেন তরলের উপরিতল কোনো টান করা স্থিতিস্থাপক পর্দা দ্বারা আবৃত রয়েছে। এই অসম লব্ধি বলের কারণেই তরল পৃষ্ঠে সংকোচনশীল টান প্রযুক্ত হয়, সেই কারণেই সম্ভবত একে ‘পৃষ্ঠটান’ বলা হয়।
পৃষ্ঠটানে বল প্রতি একক দৈর্ঘ্যে কিংবা প্রতি বর্গ-একক ক্ষেত্রফল প্রযুক্ত হতে পারে।
তরলের ফোঁটার বিশেষ আকৃতির জন্যও পৃষ্ঠটান দায়ী। যদিও তরলের নির্দিষ্ট আকৃতি নেই, তবুও পৃষ্ঠতলের অসম সংসক্তি বলের কারণে জলের ফোঁটাগুলোর গোলকাকার আকার ধারণের প্রবণতা দেখা যায়।
পৃষ্ঠটানের প্রভাব
- জলের ভর প্রসারিত হলে জলবিন্দুর সৃষ্টি হয়। অ্যানিমেশনে দেখানো হয়েছে, জল ততক্ষণ নলটির সাথে আটকে থাকে, যতক্ষণ না তার ভর প্রসারিত হতে হতে এমন অবস্থায় পৌঁছয়, যে অবস্থায় পৃষ্ঠটান জলকে নলের সাথে আটকে রাখতে সক্ষম হয়। তখন এটা মুক্ত হয় আর পৃষ্ঠটানের জন্য গোলাকার আকৃতি ধারণ করে। নল থেকে জলের প্রবাহ চালালে, তা নিচে পড়ার সময় অসংখ্য জলকণায় পরিণত হবে। অভিকর্ষ জলের প্রবাহকে নিচে টেনে আনে, আর পৃষ্ঠটান তাকে ভেঙে জলকণায় পরিণত করে।
- মোমের মতো পিচ্ছিল আবরণ যুক্ত তলে (গাছের পাতা) বৃষ্টির জল মুক্তোর মতো ক্ষুদ্র আকার নেয়। জল মোমের সাথে দুর্বলভাবে আকর্ষিত হয়, কিন্তু নিজের অণুর সাথে দৃঢ় সংঘবদ্ধ থাকে। তাই জল ছোটো ছোটো বিন্দুর আকারে ভেঙে যায়। পৃষ্ঠটান এদের গোলাকার আকার দিতে সাহায্য করে, কারণ সমান আয়তনের ক্ষেত্রে গোলক পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সবচেয়ে কম হয়।
- আলাদা দুটি তরলের মুক্তপৃষ্ঠের টানের তারতম্যের জন্য জল ও তেলের পৃথকীকরণ (ছবিতে জল ও তরল মোম) সম্ভব হয়। এর জন্যও দায়ী পৃষ্ঠটান।
- জলের চেয়ে বেশি ঘনত্বযুক্ত বস্তুর জলে ভেসে চলাও পৃষ্ঠটানেরই ফলাফল। তবে এটা তখনই ঘটবে, যখন সেই বস্তুর ওজন এতটাই নগণ্য হয় যে, পৃষ্ঠটান জনিত বল সেই ওজনকে সহ্য করতে সক্ষম হয়। উদাহরণ হিসেবে, কিছু পোকা পৃষ্ঠটানকে কাজে লাগিয়ে পুকুরের জলের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারে। পোকাটির পা’গুলির ভারের নগণ্যতার জন্য পায়ের অণু আর জলের অণুর কোনো আকর্ষণ থাকে না, তাই যখন জলের মধ্যে পা’টি ফেলা হয়, পৃষ্ঠটান কেবল জলে পায়ের জন্য সৃষ্ট বক্রতাকে মসৃণ করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ জল পোকাটিকে উপরে ঠেলে দেয় যাতে সেটা জলের মুক্ততলের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এই অবস্থায় জল পোকার ভার বহন করতে পারে। এক্ষেত্রে জলতল একটি স্থিতিস্থাপক পর্দার মতো কাজ করে। পোকাটির পায়ের চাপে জলের পৃষ্ঠতলে খাঁজের সৃষ্টি হয় বা পৃষ্ঠতল সামান্য অবনমিত হয়, আর পৃষ্ঠতলের বক্রতা (তথা ক্ষেত্রফল) সংকোচনের প্রবণতার জন্য জল পোকার পা’টিকে উপরে ঠেলে দেয়।
- অ্যালকোহলীয় পানীয় রাখা কোনো পাত্রের দেয়ালে তরলের বিন্দু ও ধীর প্রবাহকে ‘টিয়ার্স অফ ওয়াইন’ বা ‘ওয়াইনের অশ্রু’ বলে। জল ও ইথানলের পৃথক পৃষ্ঠটানের মধ্যে জটিল মিথষ্ক্রিয়ায় এটি ঘটে; জল ও উদ্বায়ী ইথানলের মিশ্রিত পৃষ্ঠটান এর জন্য দায়ী।
পৃষ্ঠতল সক্রিয় পদার্থ
পৃষ্ঠতল সক্রিয় পদার্থ (surfactant) ব্যবহার করলে তরলের পৃষ্ঠটান উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়, তখন পৃষ্ঠটানের প্রমাণ পাওয়া যায়:
- ‘এমালশন’ হল এক ধরনের কলয়েড জাতীয় দ্রবণ, যেখানে পৃষ্ঠটান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশুদ্ধ জলে তেলের অতি ক্ষুদ্র ফোঁটা বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দিলে ফোঁটাগুলি অনায়াসেই একজোট হয়ে অধিক ভর সৃষ্টি করে। কিন্তু পৃষ্ঠতল সক্রিয় পদার্থের উপস্থিতিতে পৃষ্ঠটান হ্রাস পায়, ফলস্বরূপ জলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তেলের ফোঁটা পৃথক্ভাবে ভাসমান থাকে।
- সাবানের বুদবুদের ভর অত্যন্ত কম হয়, কিন্তু সেই তুলনায় পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল অনেক বেশি হয়। বিশুদ্ধ জলে বুদবুদগুলো অস্থায়ী। পৃষ্ঠতল সক্রিয় পদার্থ যোগ করলে বুদবুদগুলোকে স্থিতিশীল করা সম্ভবপর হয় (ম্যারাঙ্গোনি প্রভাব)। আসলে ওই জাতীয় পদার্থ জলের পৃষ্ঠটান তিনগুণ বা তারও বেশি কমিয়ে দেয়।
শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “পৃষ্ঠটান কাকে বলে? পৃষ্ঠটানের প্রভাব | পৃষ্ঠতল সক্রিয় পদার্থ” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।