বিধানসভা কাকে বলে? বিধানসভার বিশেষ ক্ষমতা, বিধানসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি
বিধানসভা কাকে বলে?
বিধানসভা ভারতের রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ (দ্বিকক্ষীয় আইনসভার ক্ষেত্রে) অথবা একমাত্র কক্ষ (এককক্ষীয় আইনসভার ক্ষেত্রে)। দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মির ও পুদুচেরি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল-দুটির আইনসভাও বিধানসভা নামে পরিচিত। বিধানসভার সদস্য বা বিধায়কেরা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রাপ্তবয়স্ক ভোটারদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন।
বিধান শব্দের অর্থ আইন।সেই অর্থে যে সভায় আইন তৈরী করা হয় তাকে বিধানসভা বলা যেতে পারে। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী অঙ্গ রাজ্যের (দিল্লি,পুদুচেরি ও সাম্প্রতিক জম্মুও কাশ্মীর সহ) আইন সভা (Legislature) র নিম্ন কক্ষ বা জনপ্রিয় কক্ষ কে বিধানসভা বলে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ মন্ত্রীসভা কৃতকর্মের জন্য যৌথভাবে বিধানসভার কাছে দায়ী থাকে। বিধান পরিষদ থাকলেও শাসকদলকে কেবলমাত্র রাজ্য বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কের সমর্থন লাভ করতে হয়। অর্থ সংক্রান্ত বিল কেবলমাত্র বিধানসভায় আলোচিত হয়। বিধানসভায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রতিনিধি না থাকলে রাজ্যপাল ঐ সম্প্রদায় থেকে একজনকে মনোনীত করতে পারেন।বিধানসভার কাজ পরিচালনা করেন অধ্যক্ষ বা Speaker.তাঁকে সাহায্য করতে বা তাঁর অনুপস্থিতিতে সভা পরিচালনা করেন উপাধ্যক্ষ বা Deputy Speaker. যে বিরোধী দল বা গোষ্ঠী বিধানসভার এক দশমাংশ আসন লাভ করে তাদের পরিষদীয় দলনেতা ‘বিরোধী দলনেতা’র মর্যাদা লাভ করেন,যা ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান। বিধানসভার সদস্যগণ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। রাজ্য বিষয়ক বিল পাশ হওয়ার পর রাজ্যপাল এবং যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়ক বিল পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির সাক্ষরের পর তা আইনে পরিণত হয়। ভারতীয় সংবিধানের পরিকাঠামোগত সংশোধনীর ক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেকের বেশি রাজ্য বিধানসভার অনুমোদনের প্রয়োজন। বিধানসভা কিছু বিচার বিষয়ক ক্ষমতা ও আছে। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় একটি মেজ বা অশোকস্তম্ভ যুক্ত দন্ড আছে যা অন্য কোনো রাজ্যে নেই।এটি সম্মান সহকারে সভার শুরুতে অধ্যক্ষের আগে আগে আনা হয় এবং একইভাবে সভার শেষে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিধানসভার বিশেষ ক্ষমতা
সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব কেবলমাত্র বিধানসভাতেই আনা যায়। এই প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পাস হলে মুখ্যমন্ত্রী সহ মন্ত্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হয়।
অর্থ বিল কেবলমাত্র বিধানসভাতেই আনা যায়। বিধানসভায় পাস হওয়ার পর তা বিধান পরিষদে পাঠানো হয়। বিধান পরিষদ ১৪ দিনের বেশি আটকে রাখতে পারে না।
অন্যান্য বিলের ক্ষেত্রে, বিলটি যে কক্ষে সর্বাগ্রে উত্থাপিত হয় (সে বিধানসভাই হোক বা বিধান পরিষদই হোক), সেই কক্ষে পাস হওয়ার পর অপর কক্ষে প্রেরিত হয়। অপর কক্ষ বিলটি ছয় মাস আটকে রাখতে পারে। অপর কক্ষ বিল প্রত্যাখ্যান করলে, ছয় মাস অতিক্রান্ত হলে বা অপর কক্ষের আনা বিলের সংশোধনী মূল কক্ষে গ্রাহ্য না হলে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। তখন রাজ্যপাল উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন ডেকে অচলাবস্থা কাটান এবং সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে বিলটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়। তবে বিধানসভা সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় এক্ষেত্রে বিধানসভার মতই গ্রাহ্য হয়ে থাকে, যদি না তা নিয়ে বিভিন্ন দলের মতান্তর উপস্থিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা পশ্চিমবঙ্গের এককক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভা। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বিবাদীবাগ এলাকায় হাইকোর্টের দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবনটি অবস্থিত। বিধানসভার সদস্যদের বিধায়ক বলা হয়। তাঁরা পাঁচ বছরের জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মোট আসনসংখ্যা ২৯৫। এর মধ্যে ২৯৪টি আসনের বিধায়করা এক-আসনবিশিষ্ট বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন এবং এক জন সদস্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় থেকে সরাসরি নির্বাচিত হন। সাধারণত, বিধানসভার মেয়াদ পাঁচ বছরের; তবে তার আগেই বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যায়।
বিধানসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি
রাজ্য আইনসভা হিসেবে বিধানসভার প্রধান কাজ আইন প্রণয়ন করা। প্রতিটি বিধানসভাকে যেসকল কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয় নিম্নে তা আলােচনা করা হল一
(1) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা : বিধানসভার প্রথম ও প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন করা। সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা অনুযায়ী রাজ্য তালিকাভুক্ত যে-কোনাে বিষয়ে বিধানসভা আইন প্রণয়নে এককভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকারী। আবার, যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে পার্লামেন্ট এবং বিধানসভা যৌথভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে। বিধানসভায় গৃহীত প্রতিটি বিলে রাজ্যপালের সম্মতি অপরিহার্য। কিন্তু রাজ্যপাল সাধারণ বিলের পুনর্বিবেচনার জন্য সুপারিশ-সহ কিংবা সুপারিশ ছাড়া বিধানসভার কাছে ফেরত পাঠাতে পারেন। তবে পুনরায় বিবেচনার জন্য বিলটি দ্বিতীয়বার রাজ্যপালের কাছে প্রেরিত হলে, রাজ্যপাল তাতে কখনােই অসম্মতি জ্ঞাপন করতে পারেন না। রাজ্যপাল স্বাক্ষর করলেই সংশ্লিষ্ট বিলটি আইনে পরিণত হয়, অবশ্য কোনাে কোনাে সময়ে সংশ্লিষ্ট বিলে সই না করে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য পাঠানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে রাজ্যপাল স্ববিবেচনা অনুযায়ী কাজ করে থাকেন বলেই তিনি রাজ্য মন্ত্রীসভার সুপারিশ গ্রহণ করতে বাধ্য থাকেন না।
(2) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাজ্য বিধানসভা হল রাজ্যের অর্থ সম্পদের অতন্দ্র প্রহরী। তাই রাজ্য বিধানসভার সম্মতি ব্যতীত সরকারের আয় ব্যয় সংক্রান্ত কোনাে প্রস্তাব কার্যকরী হতে পারে না। নতুন কোনাে কর স্থাপনের প্রস্তাবই হােক বা রাজ্যের সঞ্চিত তহবিল (Consolidated Fund) থেকে ব্যয়ের কোনাে প্রস্তাব হোক সবকিছু রাজ্য বিধানসভার অনুমােদন সাপেক্ষে কার্যকরী হয়। রাজ্যের জরুরি ব্যয় সংক্রান্ত তহবিল (Contingency Fund) থেকে রাজ্যপাল অগ্রিম কোনাে ব্যয়ের অনুমতি দিলেও, তা রাজ্য বিধানসভা কর্তৃক অনুমােদিত হওয়া প্রয়ােজন। রাজ্য বিধানসভা কর্তৃক অনুমােদিত না হলে সরকারের বাৎসরিক ব্যয় বরাদ্দ সংক্রান্ত প্রস্তাব (Budget) কার্যকরী হতে পারে না। রাজ্যপালের সম্মক্ৰিমে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী রাজ্য বিধানসভায় সরকারের আর্থিক বছর শুরু হওয়ার পূর্বেই সরকারের ব্যয় বরাদ্দ এই প্রস্তাব বিলের আকারে পেশ করে থাকেন। বিধানসভায় গৃহীত হওয়ার পর এই বিল রাজ্যপালের সম্মতিলাভ করলেই আইনে পরিণত হয়। রাজ্যপাল কোনাে অর্থ বিলকে অস্বীকার করতে পারেন না।
(3) শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ক্ষমতা : সংবিধান অনুযায়ী সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য রাজ্য মন্ত্রিসভা বিধানসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। রাজ্য মন্ত্রীসভার স্থায়িত্ব বিধানসভার উপর নির্ভরশীল। বিধানসভার আস্থা হারালে তৎক্ষণাৎ মন্ত্রীসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন, ছাঁটাই প্রস্তাব পেশ, অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন ইত্যাদির দ্বারাও বিধানসভা রাজ্য মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অবশ্য কঠোর দলীয় রাজনীতির কারণে বিধানসভার দ্বারা মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বাস্তবে তত্ত্বগত ধারণায় পর্যবসিত হয়েছে।
(4) সংবিধান-সংশোধন বিলের অনুমােদন সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাজ্য বিধানসভা সংবিধান-সংশোধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারতের সংবিধান-সংশােধনের মূল দায়িত্ব ভারতীয় পার্লামেন্টের হাতে ন্যস্ত থাকে কখনাে-কখনাে দেশের স্বার্থে বিধানসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য সংবিধান-সংশােধনের মতাে দায়িত্ব পালন করে থাকে। এই দায়িত্বগুলির মধ্যে উল্লেখ্য হল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্ট সংক্রান্ত বিষয় এমনকি কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ের নির্ধারণ।
(5) সংবাদ ও তথ্য প্রদান সংক্রান্ত ক্ষমতা : জনসাধারণকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে সংবাদ ও তথ্য প্রদান সরবরাহ-কেন্দ্র হিসেবে বিধানসভা কাজ করে থাকে। অধিবেশন চলাকালীন সময় মন্ত্রীরা যে বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নের জবাবে উত্তরপ্রদান ও তথ্য সরবরাহ করে থাকেন, বিধানসভা তা সংবাদমাধ্যমের দ্বারা সরবরাহ করে থাকেন। ফলে জনগণ সরকারি কাজের বিষয়ে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল হতে পারে।
(6) নিয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য যে বিশেষ নির্বাচক সংস্থা গঠিত হয়, অন্যান্য রাজ্য বিধানসভার মতাে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভায়ও অংশগ্রহণ করতে পারে। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যসভার (পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ) সদস্যগণকে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একক হস্তান্তরযােগ্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করে থাকেন। রাজ্যসভায় পশ্চিমবঙ্গের আসনসংখ্যা হল ১৬। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রাজ্যসভার এই ১৬ জন ব্যক্তিকে নিয়ােগ করা।
(7) সাধারণের স্বার্থজড়িত বিষয়ে আলােচনা সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাজ্য বিধানসভায় সমগ্র রাজ্যের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকেন। সুতরাং জনগণের সাধারণ স্বার্থজড়িত বিষয়ে সভায় আলােচনা, সমালােচনা ও তর্কবিতর্ক চলে। এই সমস্ত আলােচনা থেকে বহু কার্যকরী সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই সমস্ত আলােচনা থেকে বহু অজ্ঞাত সরকারি তথ্য ও প্রকাশিত হতে পারে যার থেকে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধি লাভ করে, যা পরােক্ষভাবে জনমত গঠনে সহায়তা করে থাকে।
(8) অন্যান্য ক্ষমতা :
- অন্যান্য রাজ্য বিধানসভার ন্যায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা, সভার নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে সভার কাজ পরিচালনার জন্য একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকারকে নির্বাচিত করে।
- পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা এই রাজ্যের রাজ্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের রিপাের্ট, কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেলের রিপাের্ট প্রভৃতি পর্যালোচনা করতে পারে।
- পশ্চিমবঙ্গের সীমানা সংক্রান্ত কোনাে কেন্দ্রীয় বিল সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার মতামত চাইলে তা জানানোও বিধানসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে বিবেচিত হয়।