কৃষি

বাগিচা কৃষি কাকে বলে? বাগিচা কৃষির বৈশিষ্ট্য, বাগিচা কৃষির সুবিধা, বাগিচা কৃষির অসুবিধা

1 min read

বাগিচা কৃষি কাকে বলে?

বাগিচা বা বাগান বা আবাদী কৃষি হচ্ছে এক ধরনের রপ্তানী ভিত্তিক বিশেষ কৃষি পদ্ধতি যেখানে একটি ফসলের উপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়। এটি একটি প্রকান্ড ধরনের সুষ্ঠু অভ্যন্তরীণ ভৌত অবকাঠামোসহ শিল্পোদ্যোগ যেখানে সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনই মূ্খ্য উদ্দেশ্য। ইহা শুধু শস্য চাষই জড়িত নয়, এর সাথে উৎপাদিত দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, মোড়ক, পরিবহণ এবং রফতানী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ এটি শিল্প ও বাণিজ্যের প্রান্তিক অবস্থায় বিরাজমান।

বাগিচা কৃষি ক্রান্তীয় অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ অর্থাৎ বিষুব রেখার উভয় পার্শ্বস্থ দেশসমূহ নিয়ে অবস্থিত। এ কৃষির সূচনা ঘনিষ্টভাবে উপনিবেশ স্থাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে ইহা ক্রান্তীয় অঞ্চল বরাবর বিচ্ছিন্নভাবে বিকাশ ঘটেছে।

বাগিচা কৃষির উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়ায় কফি চাষ; কিউবা, পেরু, প্রোটারিকো ও ফিলিপাইনে ইক্ষু চাষ; ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশে চা চাষ; পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ইকোয়েডর ও ব্রাজিলে কোকোয়া চাষ; ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের নিম্নভূমি অঞ্চল যেমন মেক্সিকো, জামাইকা, কলম্বিয়া, পানামা, কোষ্টারিকায় কলা চাষ এবং মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কাম্পুচিয়া, মায়ানমার ও ভারতে রাবার চাষ ইত্যাদি।

বাগান কৃষি বা বাগিচা কৃষি উপনিবেশিকতার ফসল যা কোন সময়ই স্থানীয় অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত উদ্দেশ্য নয় বরং ব্যবসা বাণিজ্য, রাজকীয় মূলধনে নিয়োজিত একটি বিশেষ ফসলের আন্তর্জাতিক প্রয়োজনীয় চাহিদা পুরনার্থে ইহার উদ্ভব ঘটেছিল। চিরায়ত উদাহরণে ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকায় ইংরেজদের দ্বারা চা এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ইংরেজ ও ডাচদের দ্বারা রবার চাষের প্রচলন ঘটে। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের পুজিগত আর্থিক অবস্থার ফলাফলকেই বাগান কৃষি বা বাগিচা কৃষির উদ্ভব ও এর মধ্যেই তার মূল উদ্দেশ্য নিহিত।

বাগিচা কৃষির বৈশিষ্ট্য

১. বাগিচা কৃষি পদ্ধতিটি খুবই আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক সম্মত, যাতে বিশেষ শস্যের বৃহদায়তন উৎপাদন ব্যবস্থা জড়িত।

২. একটি একক শস্যের বিশেষীকরণ এ কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন : ভারত ও বাংলাদেশের চা, মালয়েশিয়ার রবার চাষ।

৩. সমগ্র প্রকৌশলগত দক্ষতা, যন্ত্রপাতি, ভৌত অবকাঠামোগত দ্রব্যাদি বিদেশ থেকে বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের দেশ থেকে সংগৃহীত এ কৃষি পদ্ধতিতে প্রচলিত।

৪. বাগিচা কৃষি সাধারণতঃ শ্রমিক প্রগাঢ় কর্মকাণ্ড। সুলভে বহু সংখ্যক শ্রমিক দেশের পিছনমুখী এলাকা অবস্থা দূরদেশ থেকে আনার প্রবণতা এ কৃষি পদ্ধতিতে পরিলক্ষিত।

৫. শ্রমলব্ধ শ্রমিক ব্যতীত বাকী সকল ধরনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারী সাধারণতঃ দেশের বহিরাগতদের নিয়োগ দেরী হয়।

৬. চা, কফি, রাবার, কলা, আনারস, কোকোয়া, ইক্ষু ইত্যাদি বাগিচা কৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়।

৭. যেহেতু বাাগিচা কৃষির প্রায় সকল ফসলই আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা হয়ে থাকে, সেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্যাকিং ও প্রসেসিং ইত্যাদির জন্য বন্দর নিকটবর্তী অঞ্চলে এ কৃষি পদ্ধতি অবস্থিত।

৮. বাগিচা কৃষি পৃথিবীর মধ্যে মূলধন নিবিড় কৃষি পদ্ধতি। যাতে প্রতিষ্ঠা খরচ, বাড়তিসহ রাহা খরচ, শস্য পরিবহন ও রপ্তানী ইত্যাদি নিমিত্তে বৃহৎ অংকের মূলধনের প্রয়োজন।

৯. বাগিচা কৃষি মূলতঃ অনুন্নত দেশসমূহের অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই এ ক্ষেত্রে উন্নয়নগামী দেশসমূহের এ ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণামূলক কোন ভূমিকা নেই বললেই চলে।

১০. বাগিচা কৃষি সাধারণতঃ দুর্গম এলাকায় গড়ে ওঠে যেখানে খামার আয়তন বিশাল ও বৃহদায়তনের স্থানীয় লোকসংখ্যার ঘনত্ব স্বল্প, জমির মূল্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম এবং এর সঙ্গে অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

১১. বাগান কৃষি উৎপাদিত শস্যাদি মূলতঃ রপ্তানী করে থাকে উন্নয়নশীল দেশসমূহ আর আমদানীসহ ব্যবহার মূলতঃ উন্নত দেশসমূহ যা তাদের নিজেদের ভোগ্যপণ্য অথবা অন্য শিল্পের প্রাথমিক কাচামালরূপে।

১২. বাগিচা কৃষি প্রায়ই অন্যদেশ থেকে শ্রমিক অভিপ্রয়ানের উৎসাহ ভিত্তিক কর্মকাণ্ড উপনিবেশকালে হাজার হাজার লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হতো সহজ উপায়ে কাজের যোগান প্রাপ্যতার নিমিত্তে ফলে সাংস্কৃতিক বিনিময়ও ঘটার সুযোগ থাকতো।

১৩. প্রাথমিক প্রাপ্যতার আশা এ কৃষিতে খুবই কম কেননা শস্যের পরিপক্কতা আসতে বেশ সময় লেগে যায়। তবে প্রাথমিকভাবে উচ্চ বিনিয়োগ সত্বেও রাহা খরচ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে।

১৪. এ ধরনের কৃষিতে যেহেতু বাহির থেকে শ্রমিক আমদানী করা হয়। সেহেতু নানান ধরনের সামাজিক সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে।

১৫. যেহেতু এ কৃষি পদ্ধতি ক্রান্তীয় অঞ্চলে প্রচলিত সুতরাং এখানকার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর কারণে নানান ধরনের কীট পতঙ্গ, ভাইরাস ও অন্যান্য রোগব্যধির বিস্তার ঘটতে দেখা যায়।

বাগিচা কৃষির সুবিধা

১. উদ্যোক্তারা মৃতপ্রায় অথবা অনুন্নত খাতে বেশ পরিমাণ অর্থ সঞ্চারিত করে এ কৃষি পদ্ধতিকে স্পন্দমান, গতিশীল অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটাতে সাহায্য করে।

২. বাগিচা কৃষির উৎপাদিত পণ্যাদি সামগ্রীকভাবেই আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভরশীল। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যের সামান্য হ্রাস বৃদ্ধি ঘটার মাধ্যমে সমস্ত পদ্ধতিটিকেই ঝুকির সম্মুখীন করতে পারে।

৩. যেহেতু এটি সামগ্রিকভাবে রপ্তানীমুখী পদ্ধতি, সুতরাং নীট পরিমাণ ও মূল্য জাতীয় রপ্তানীতে প্রবৃদ্ধি ঘটায়। ফলে জাতীয় অর্থের সঙ্গে মূল্যবান অর্থেরও বৃদ্ধি ঘটে।

৪. ইহা একক একটি পদ্ধতি যা হাজার হাজার শ্রমিকের কাজের সংস্থানের মাধ্যমে উদ্ভূত বেকারত্ব সমস্যা হ্রাস করণে বেশ সহায়তা করেছে।

৫. বাগিচা কৃষি একটি জটিল ধরনের প্রক্রিয়া যা মূলতঃ শিল্প স্থাপন সহ সাধারণ সুবিধাদির মাধ্যমে নগরায়ন হারকে গতিশীল করে থাকে।

বাগিচা কৃষির অসুবিধাবলী

বাগিচা কৃষি পদ্ধতির কতিপয় সুবিধা ছাড়াও অনেক সময় ইহা আঞ্চলিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে থাকে, যেমন –

১) ইহা বহিরাগতদের দ্বারা গড়ে উঠছে এবং তা অবিরামভাবে। সুতরাং এ ধরনের কৃষি পদ্ধতিতে বহুকাল ব্যাপী স্থানীয় অদিবাসীদের জন্য টেকসই নয়।

২) ইহা শুধু এক ধরনের শস্য উৎপাদন করে বাইরের বাজারে বিক্রি করে থাকে। সুতরাং ইহা স্থানীয় লোকজনের খাদ্য ঘাটতি পুরণে সক্ষম নয়।

৩) মুনাফা নামে বিদেশীদের হাতে অর্থের প্রস্থান ঘটে যা কোনভাবে স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সক্ষম নয়।

৪) বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুলভ শ্রমিক বাহির থেকে সংগৃহীত এবং দক্ষ কৌশলীবৃন্দ আরো দূরবর্তী ভূমি থেকে আসে। তাই এ পদ্ধতি স্থানীয় বেকারত্ব ঘুচাতে অক্ষম এবং অনেক সময় সামাজিক উত্তেজনার বিস্তার ঘটে। মৃত্তিকা সন্তানগুলো তখন অহেতুক বহিরাগতদের সঙ্গে কলহে লিপ্ত হয়।

৫) কৃষি সম্প্রসারণের নামে ভূমি দখল করে ভূমিহীন, পরগাছা ধরনের লোকসমাজ সৃষ্টি করে থাকে।

৬) এ কৃষি পদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য অনুপযোগী। কেননা বেশি করে উৎপাদনও শস্যাবর্তনের অভাবে মৃত্তিকার উর্বরতা কমে যায় ও মৃত্তিকা ক্ষয়রোধ বৃদ্ধি করে।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x