স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর।
স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর।
স্বাধীনতা ও সাম্য এই দুটি আদর্শ মানুষের রাজনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করছে। এই দুটি আদর্শকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে মানুষ রক্ত্ক্ষয়ী সংগ্রাম করেছে। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ফরাসী বিপ্লব উভয় ক্ষেত্রেই এই দুটি আদর্শকে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে। অথচ আশ্চর্যের কথা, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেন নি।
লর্ড এ্যাক্টন (Lord Acton), টকভিল (Tocqueville), লেকি (Lecky), স্পেন্সার (H. Spencer), বেজহট (Bengehot) প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণাকে পরস্পর বিরোধী বলে মনে করেন।
Lecture on Liberty গ্রন্থে এ্যাক্টন মন্তব্য করেছেন, “সাম্যের জন্য আবেগ স্বাধীনতার আশাকে ব্যর্থ করে।
স্বাধীনতা ও সাম্যকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে করার পিছনে কাজ করে স্বাধীনতা ও সাম্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। স্বাধীনতা বলতে যদি ব্যক্তির খেয়াল খুশির মত কাজ করার অবাধ ক্ষমতাকে বোঝায় তাহলে স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্যের বিরোধ স্বাভাবিক। এ ধরনের মতের সমর্থকদের ধারণা হলো এই যে, কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা ছাড়া সাম্য আসতে পারে না। আর নিয়ন্ত্রণের অর্থই হলো স্বাধীনতার সংকোচন। সুতরাং প্রতিটি ব্যক্তিটির পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সাম্যের আশাকে ত্যাগ করতেই হয়।
বর্তমানে কেউ স্বাধীনতাকে ব্যক্তির অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা বলে মনে করেন না। নিয়ন্ত্রণবিহীন স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতা বা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। বর্তমানে স্বাধীনতা বলতে একটা বিশেষ পরিবেশকে বোঝায় যেখানে প্রতিটি মানুষ তার ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ পায়। এই পরিবেশ একমাত্র সকলের সমান অধিকারের ভিত্তিতেই সৃষ্টি হতে পারে। সমাজে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা থাকলে স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চোরাবালির ওপর স্বাধীনতার সৌধ নির্মাণ করা যায় না। সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতেই প্রকৃত স্বাধীনতা উপলব্ধি করা যায়। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে টনি বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ বোঝায়, তাহলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া সেই স্বাধীনতা সম্ভব নয়।” অনুরূপভাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক রুশো বলেছিলেন “সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। মেটল্যান্ড, গডউইন, ল্যাস্কি, বার্কার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ এবং মার্কসবাদী লেখকগণ এই মতের সমর্থক।
বস্তুত স্বাধীনতার ধারণাকে কার্যকর করতে সাম্যের প্রযোজন অপরিহার্য। বাস্তবে স্বাধীনতা বলতে শুধুমাত্র ন্যূনতম পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার বোঝায় না। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় যারা অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল তাদের নিরাপত্তা বিধান, যাতে অন্যের দয়ার ওপর তাদের নির্ভরশীল হতে না হয়। তার জন্য শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অনেকটা পরিমাণে সাম্য দরকার। সুতরাং সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী তো নয়ই, বরং স্বাধীনতার জন্য একান্ত আবশ্যক।
মার্কসবাদী লেখকগণও সাম্যকে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্যকে, স্বাধীনতার অপরিহার্য শর্ত বলে মনে করেন, তাঁদের মতে ধনবৈষম্যমূলক সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অসাম্য-বৈষম্য থাকায় সকলের পক্ষে স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি সম্ভব হয় না। এরূপ সমাজে মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণ ক্রমশই শোষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। এই শেষোক্ত শ্রেণীর মানুষদের প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্যাবস্থা প্রয়োজন। অর্থাৎ মার্কসীবাদীদের মতে, শ্রেণীহীন, শোষণহীন, সাম্যবাদী সমাজই কেবলমাত্র স্বাধীনতার প্রকৃত পীঠস্থান হয়ে উঠতে পারে।