বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বিশ্বে জনপ্রিয় দুটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ অন্যতম। পুঁজিবাদকে একটি মুক্ত বাজার অর্থনীতি হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে।
বর্তমানে, বেশিরভাগ দেশ মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনুশীলন করে যার মাধ্যমে কিছু পরিমাণ সরকারী নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকানা অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই আর্টিকেলে, পুঁজিবাদের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং পুঁজিবাদী দেশসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
পুঁজিবাদ কি?
পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র (Capitalism) হল এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে ব্যবসা, কারখানা এবং উৎপাদনের উপকরণসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে।
সহজভাবে বলতে গেলে, যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ থাকে না এবং সরবরাহ ও চাহিদার উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তাকে পুঁজিবাদ বলে।
পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা। এই অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পণ্যের উৎপাদন ও দাম নির্ধারণ করা হয়।পুঁজিবাদের অধীনে পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন সাধারণ বাজারে সরবরাহ এবং চাহিদার (Supply and demand) উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে – যা একটি বাজার অর্থনীতি হিসাবে পরিচিত।
পুঁজিবাদের বিশুদ্ধতম রূপ হল মুক্তবাজার (laissez-faire) অর্থনীতি যেখানে ব্যক্তিরা নির্ধারণ করতে পারে কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে, কি উৎপাদন বা বিক্রি করতে হবে এবং কোন মূল্যে পণ্য ও সেবা বিনিময় করতে হবে।
মুক্ত-বাজার অর্থনীতি পুঁজিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই জাতীয় অর্থনীতিতে, বাজারের চাহিদা এবং সরবরাহ অনুসারে পণ্যের বিতরণ ঘটে। সহজভাবে বলতে গেলে, কোনো পণ্যের চাহিদা বেড়ে গেলে দাম বেড়ে যায়। মুনাফা বাড়াতে প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে দাম সাধারণত কমে যায়।
পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য
পুঁজিবাদের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার মধ্যে ব্যক্তিগত মালিকানা, লাভের উদ্দেশ্য, ন্যূনতম সরকারি হস্তক্ষেপ এবং প্রতিযোগিতা অন্যতম। এছাড়াও রয়েছে,
- ব্যক্তিগত মালিকানা: এটি পুঁজিবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি যেখানে কারখানা, মেশিন এবং সরঞ্জামের মতো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যক্তি বা কোম্পানির মালিকানাধীন থাকে।
- উদ্দ্যোক্তার স্বাধীনতা: এই ব্যবস্থার অধীনে, প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে। এই অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে এবং পূঁজি বিনিয়গের মাধ্যমে যে কেউ উদ্যোক্তা হতে পারে।
- লাভের উদ্দেশ্য: মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালক। এই ব্যবস্থায়, সর্বাধিক মুনাফা অর্জন, উৎপাদক বিভিন্ন ভাবে তার পণ্যকে ভোক্তার কাছে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করে।
- মূল্য প্রক্রিয়া: এই ব্যবস্থার অধীনে, বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ অনুযায়ী পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হবে।
- মুক্ত বাণিজ্য: এই ব্যবস্থায়, কম শুল্ক বিদ্যমান যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করে।
- সরকারি হস্তক্ষেপ: একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে, ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যক্রমে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ নেই। ভোক্তা এবং উৎপাদক যেকোনো পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন।
- মালিকানার স্বাধীনতা: এই ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যে কোনো পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন করতে পারে এবং তার ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারে।
- শ্রেণিবিভাগ: এই উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্মবিত্ত ইত্যাদি শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি হয়। সমাজে আয় ব্যয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ধনীরা আরও ধনী হতে থাকে এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হতে থাকে।
- ব্যক্তিগত ইচ্ছাশক্তি: উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ইচ্ছাশক্তি দ্বারা নির্ধারিত হয়।
- ভোক্তার স্বাধীনতা: ভোক্তা তার ইচ্ছা, রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী ভোগ করতে পারে, অর্থাৎ ভোক্তার ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে।
- প্রতিযোগীতা: উদ্যোক্তা বা উৎপাদকদের মধ্যে নতুন কলাকৌশল, মুনাফা বৃদ্ধি, কম খরচে উৎপাদন ও কম মূল্যে ভোক্তাদের কাছে দ্রব্য সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিযোগীতা থাকে।
- স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ: ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় উৎপাদন, বণ্টন নিয়ন্ত্রনের কোন কর্তৃপক্ষ থাকে না। বাজারে কোন দ্রব্যের দাম, চাহিদা ও যোগানের ঘাত-প্রতিঘাত স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ
পশ্চিমা দেশগুলিতে পুঁজিবাদ একটি প্রভাবশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তবে, অনেক দেশই মিশ্র অর্থনীতি রয়েছে যা পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক উভয় নীতির অধীনে কাজ করে। বিশ্বের প্রধান পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যেমন,
- হংকং
- সংযুক্ত আরব আমিরাত
- সিঙ্গাপুর
- নিউজিল্যান্ড
- অস্ট্রেলিয়া
- কানাডা
- সুইজারল্যান্ড
- যুক্তরাজ্য
- যুক্তরাষ্ট্র
- আয়ারল্যান্ড