উৎপাদনের ধারণা | উৎপাদনের গুরুত্ব | উৎপাদনের আওতা
উৎপাদনের ধারণা (Concept of Production)
মানুষ তার শ্রম ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদে যে বিনিময়যোগ্য বাড়তি উপযোগ সৃষ্টি করে তাকে উৎপাদন বলে। মানুষ প্রকৃত পক্ষে নতুন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না – সে এর আকৃতিগত পরিবর্তন, স্থানান্তর, সংরক্ষণ, প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে এতে বাড়তি উপযোগ বা মূল্য সৃষ্টি করে। এই বাড়তি উপযোগ বা মূল্য সৃষ্টির কাজই উৎপাদন হিসেবে বিবেচিত হয়। মাটি থেকে ইট, বাঁশ থেকে কাগজ, কাঠ থেকে আসবাবপত্র, তুলা থেকে সুতা – এভাবে হাজারো জিনিস আমরা উৎপাদিত হতে দেখি।
উৎপাদনের গুরুত্ব (Importance of Production)
নিম্নে সংক্ষেপে উৎপাদনের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলোঃ
প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার যোগান (Supplying necessary goods and services)
মানুষের সকল ধরনের অভাব পূরণে উৎপাদনের বিকল্প নেই। একটি মানুষের প্রতিনিয়তই খাদ্য – খানা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার প্রয়োজন পড়ে। উৎপাদনের মাধ্যমেই এ সকল পণ্য উৎপাদিত হয়। ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তা গ্রাহকের নিকট পৌঁছে। উৎপাদন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের উপযোগ সৃষ্টি বা উৎপাদনের মধ্য দিয়েই আমরা হাতের নাগালের মধ্য থেকে পণ্য ও সেবা ক্রয় করে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন উপভোগ করতে সমর্থ হই।
ব্যক্তিগত আয়ের প্রধান অবলম্বন (Main source of personal income)
আয়ের সাথে ভোগের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক বিদ্যমান। আয় নেই তো ভোগও নেই। ধনী মানুষের আয় বেশি হওয়ায় তাদের ভোগের পরিমাণও বেশি। ভোগ কার্যত উৎপাদন বাড়ায় যা প্রকারান্তরে আয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি করে। মানুষ নানান উৎপাদনের কাজে জড়িত থেকে মূলত আয় করে। কেউ চাকরি করছে, ব্যবসায় করছে, গাড়ি চালাচ্ছে, শ্রম বিক্রয় করছে – এভাবে প্রতিটা কাজই কোনো না কোনোভাবে উপযোগ সৃষ্টি বা উৎপাদনের সাথে জড়িত। উৎপাদন যত বাড়ে মানুষের আয়ও তত বাড়ে। ব্যক্তিগত আয় যত বাড়ে জাতীয় আয়ও ততই বৃদ্ধি পায়। জাতীয় সমৃদ্ধিও ততই অর্জিত হয়ে থাকে।
সরকারের আয়ের প্রধান ক্ষেত্র (Main sector of Govt. income)
সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত হলো ভ্যাট, কর, শুল্ক ইত্যাদি। যার সবই উৎপাদনের বদৌলতে মানুষ ও তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বা উৎপাদন থেকে অর্জিত হয়। ২০১১-২০১২ অর্থ বছরের জুলাই-মার্চ এর হিসেবে দেখা যায়, মোট রাজস্ব আয়ের মোট ভ্যাট থেকে ৩৯%, কর থেকে ২৭%, সম্পূরক কর খাতে ১৮%, আমদানি শুল্ক খাত ১৫% ও অন্যান্য খাতে ১% অর্জিত হয়েছে। যার সবই উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত। সরকারের আয় যত বাড়ে সরকার ততই শক্তিশালী হয়। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নসহ রাষ্ট্রের উন্নয়নের কাজে তা ব্যবহৃত হতে পারে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচক (Index of economic development)
জাতীয় উৎপাদন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচক উৎপাদন প্রবৃদ্ধির দ্বারাই পরিমাপ করা হয়। ব্যক্তির বেলায় আয়-উৎপাদন যত বাড়ে ব্যক্তির সঞ্চয়, মূলধন বিনিয়োগ ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যক্তির স্বচ্ছন্দ ততই অর্জিত হয়। রাষ্ট্রের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় আয়, ভোগ, সঞ্চয়, মূলধন, বিনিয়োগ এবং যার ফলশ্রুতিতে আবার উৎপাদনও আয় বৃদ্ধি পায়। এরূপ অগ্রগতির চাকা যতই শক্তিশালী হয় একটা দেশ ততই বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জন করে।
সামাজিক অগ্রগতি লাভের উপায় (Way of social progress)
বেকারত্ব মানুষের জন্য অভিশাপ, উৎপাদন উন্নয়নের উপায় – এ সকল আপ্তবাক্য সকল সমাজেই প্রচলিত। যে সমাজের মানুষ বেকার, অলস সময় কাটায় – সেখানে অশান্তি ও হানাহানি বিরাজ করে। যে সমাজের মানুষ উন্নয়ন চিন্তা করে, উৎপাদনের কাজে জড়িত থাকে – সেখানে গণ্ডগোল, হানাহানি ও সন্ত্রাস স্থান পায় না। তাই উৎপাদন সামাজিক অগ্রগতি লাভেরও একটা উপায়। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে সবাই কাজ করে, ফলে শ্রমের মর্যাদা রয়েছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অথচ আমাদের সমাজে ভিন্নতা লক্ষণীয়।
উৎপাদনের আওতা (Scope of Production)
বিনিময়যোগ্য উপযোগ সৃষ্টিকেই উৎপাদন বলে। এই উপযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্র বা আওতাকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা প্রকৃতপক্ষে কষ্টসাধ্য বিষয়। এক সময় কৃষি ছিল উৎপাদনের প্রধান খাত। বাংলাদেশে ধান, পাট, রবিশস্য ইত্যাদিই ছিল মুখ্য ফসল। উৎপাদনের আওতা আলোচনা করা হলোঃ
কৃষিখাত (Agriculture sector)
উৎপাদনের প্রথম ও প্রাচীন খাতই হলো কৃষি খাত। মাটি, পানি, সার, বীজ ইত্যাদি ব্যবহার করে ফসল ফলানোর প্রয়াসই মূলত কৃষি উৎপাদন নামে খ্যাত। খাদ্য ও শিল্প কাঁচামালের যোগান আসে মূলত কৃষি খাত থেকে। ধান, গম, ভুট্টা, শাক-সবজি, ডাল ইত্যাদি খাদ্য সামগ্রীর যোগান দেয় কৃষি। পাট, তুলা, আখ, চা ইত্যাদি শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালও আসে কৃষি থেকে। সকল ধরনের ফলমূল আমরা কৃষি থেকে লাভ করি। বৃহৎ অর্থে উৎপাদন বিবেচনায় মৎস্য, প্রাণিজ ও জলজ সম্পদ কৃষির একটা উপখাত হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে মৎস চাষ, মৎস শিকার, পশুপালন, উৎপাদন কৃষি খাতের আওতাধীন। ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ছিল ২০.০১%।
শিল্পখাত (Industry sector)
শিল্প বিপ্লবের পর কৃষিখাতকে পিছনে ফেলে উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিল্পখাত এগিয়ে এসেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে রূপগত উপযোগ সৃষ্টির সকল প্রয়াস সংশ্লিষ্ট খাতকেই শিল্পখাত বলে। শিল্প এখন এত বড় খাত যে একে নির্দিষ্ট ছকে গণ্ডিবদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব।কুটির শিল্প থেকে শুরু করে ছোট, মাঝারি ও বৃহদায়তন সকল শিল্প এর অন্তর্ভূক্ত। খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, খনন ও আহরণ, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ এবং নির্মাণ-এ চারটি উপখাত শিল্প খাতের অধীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০১০ – ২০১১ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে শিল্পখাতের অবদান ছিল ৩০.৩৮%। এখানে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৮.৪২%।
সেবাখাত (Service sector)
একটা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদির সাথে পাল্লা দিয়ে দেশের সেবাখাতের উৎপাদন বাড়ে। একজন মানুষের আয় যখন সীমাবদ্ধ থাকে তখন মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণই তার কাছে মুখ্য থাকে। যখনই তার আয় মৌলিক চাহিদা পূরণের পর্যায় অতিক্রম করে তখনই নানান সেবা প্রাপ্তির আগ্রহ মানুষের মাঝে বৃদ্ধি পায়। এখন সে ভালো সেলুনে যায়, সময় পেলেই বেড়ায়, সন্তান-সন্ততিকে ভালো মানের প্রতিষ্ঠানে পড়ায়, গাড়ি কেনে, ড্রাইভার রাখে – এভাবে সেবা প্রাপ্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে সেবা উৎপাদনের নতুন নতুন খাত জন্ম নেয়। শিক্ষা, পরিবহন ও যোগাযোগ, ডাক ও তার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহ, উকিল ও এটর্নীফার্ম, সরকারি ও এনজিও প্রতিষ্ঠানসমূহ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়, হোটেল ও রেস্তোরা, পর্যটন শিল্প, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা ইত্যাদি সেবাখাতের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে জাতীয় উৎপাদনে সেবা খাতের অবদান ছিল ৪৯.৬১%।