সাধারণত লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন বিশেষায়িত উপাদানসমূহের সুষম সমন্বয় সাধনকে সংগঠন বলে। এটি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যথাযথ সংগঠন ছাড়া প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপায় উপকরণের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব নয়। ইঞ্জিনকে সর্বতোভাবে প্রস্তুত না করে একে চালু করার প্রচেষ্টা যেমনি অর্থহীন তেমনি সংগঠন যদি কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা করা না যায়, তবে কর্মক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা, জটিলতা ও ভারসাম্যহীনতা দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই একটি উত্তম সংগঠনকে বিশেষ কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া উচিত।
সংগঠনের বৈশিষ্ট্যসমূহ
একটি উত্তম সংগঠনের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক নিম্নে তা চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরে আলোচনা করা হল।
১. উদ্দেশ্য কেন্দ্রিকতা (Objects oriented)
একটি উত্তম সংগঠনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উদ্দেশ্য কেন্দ্রিকতা। এটি এমনভাবে বিন্যস্ত ও সংহত করা হয়, যাতে তা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
২. সহজবোধ্যতা (Easy understanding)
একটি উত্তম সংগঠনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এটি যতদূর সম্ভব সহজবোধ্য হয়ে থাকে। একটি সংগঠন চার্ট দেখে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরের যে কেউ যাতে এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিভিন্ন পদ, পারস্পরিক সম্পর্ক, কর্তৃত্ব শৃঙ্খল (Chain of command) ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা পেতে পারে একটি উত্তম সংগঠনে তা নিশ্চিত করা হয়।
৩. যথাযথ কার্যবিভাজন (Proper division of work)
একটি উত্তম সংগঠনে এর কাজগুলোকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়, যাতে প্রতিষ্ঠানের বিশেষায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশেষায়ন সম্পর্কে কিথ ডেভিস বলেছেন, “কোন ব্যক্তি বা বিভাগ যদি একই ধরনের কাজে তার সামর্থ্য ব্যয় করে, তবে ঐ কাজে তার পক্ষে দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয়। একটি উত্তম সংগঠনে কার্যবিভাজনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিশ্চিত করা হয়ে থাকে।”
৪. সুসংজ্ঞায়িত দায়িত্ব ও কর্তব্য (Well defined responsibility and authority)
দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট বর্ণনা ও তার যথাযথ অনুসরণ হল একটি ভালো সংগঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রতিষ্ঠান যত বড় হয় বা এর কাজ যত জটিল হয় তাতেই সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তি নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা না হলে ভুল বুঝাবুঝি ও জটিলতা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাই একজন ভালো সংগঠক তার প্রতিষ্ঠানের উপর হতে নিচ পর্যন্ত সকল পদে কর্মরত ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুসংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়ে থাকেন।
৫. ভারসাম্যপূর্ণতা (Well balancing)
একটি উত্তম সংগঠনকে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হয়। এক্ষেত্রে বিভাগ ও উপবিভাগ এমনভাবে খোলা হয়, যাতে প্রত্যেকটি বিভাগই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও একে অন্যের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া একটি উত্তম সংগঠনে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যেও ভারসাম্য বজায় থাকে।
৬. আদেশের ঐক্য (Unity of command)
কোন ব্যক্তি একক ঊর্ধ্বর্তনের অধীনে থেকে তার নির্দেশমতো কাজ করবে, একটি ভালো সংগঠনে তাও নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। আদেশের ঐক্য বলতে আইরিচ ও কুঞ্জ বলেছেন, “The principle of unity of command states that the more often an individual reports to a single superior, the more likely it is individual will feel a sense of loyalty and obligation and the less likely it is that there will be confusion about instruction.” সংগঠন কাঠামো তৈরির সময় দ্বৈত অধীনতা পরিহার করা হলেই শুধুমাত্র কার্যক্ষেত্রে আদেশের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৭. আনুগত্য ও শৃঙ্খলা (Loyalty and discipline)
একটি কার্যকর সংগঠনে আনুগত্য ও শৃঙ্খলার ভাবধারা সবসময়ই বজায় থাকে। প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট থাকায় প্রত্যেকেই যার যার কাজ সম্পাদন করে। কেউ কোনরূপ ফাঁকি দিলে সাংগঠনিক নিয়মের কারণে ত্তা সহজেই ধরা পড়ে যায়। জবাবদিহিতা করাও দ্রুত ও সহজ হয়। ফলে কার্যক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার কোন সুযোগই থাকে না।
৮. সহজ যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন (Easy communication and co-ordination)
একটি ভালো সংগঠনে উত্তম যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এরূপ প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতনদের সাথে অধস্তনদের যোগাযোগ সহজ ও অনেকটা প্রত্যক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগককে এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে কোন ব্যক্তি ও বিভাগ আপনা আপনি অন্যের সাথে সমন্বয় সাধন করে চলতে পারে। ফলে প্রতিষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে উঠে, যা প্রতিষ্ঠানের কাজকে গতিশীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে।
৯. কাম্য তত্ত্বাবধান পরিসর (Optimum span of supervision)
প্রতিষ্ঠানের সকল পর্যায়ের নির্বাহির কাম্য তত্ত্বাবধান পরিসর একটি উত্তম সংগঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এরূপ সংগঠনে একজন নির্বাহির সময়, সামর্থ্য, কাজের প্রকৃতি, কর্মীদের মান ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে এমন কাম্য তত্ত্বাবধান পরিসর নির্ণয় করা হয়, যাতে তার পক্ষে দক্ষতার সাথে অধস্তনদের কাজ তত্ত্বাবধান ও তাদেরকে নেতৃত্বদান সম্ভব হয়। এতে নির্বাহির যেমনি অধিক কর্মভারগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না তেমনি প্রতিষ্ঠানে নির্বাহির সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের দক্ষতা অব্যবহৃত থাকার সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।
১০. নমনীয়তা (Flexibility)
নমনীয়তা বলতে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার সঙ্গতিকে বুঝায়। একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ সবসময় এক ধরনের থাকে না। কখনও কাজের পরিমাণ বাড়ে, আবার কখনও কমে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক সময় কার্য বিভাজন ও উপায় উপকরণকে নতুনভাবে সাজানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালে যদি একে এভাবে নমনীয়তার গুণসম্পন্ন করে সাজানো না হয়, তবে পরবর্তী সময়ে সমস্যা দেখা দেয়।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, একটি উত্তম সংগঠনের উপরালোচিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান থাকে। এসব বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি যে সংগঠনে অনুপস্থিত থাকে, সে সংগঠন কখনও উত্তম ও কার্যকর সংগঠন হতে পারে না। বিভিন্ন মনীষী কর্তৃক প্রদত্ত সংগঠনের বিভিন্ন সংজ্ঞা বিশেষণ করলেও দেখা যায় যে, একটি উত্তম সংগঠনে উপরালোচিত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান। তাই আলোচিত বৈশিষ্ট্যের আলোকে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হলে সহজে নির্ধারিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হবে এবং তা উত্তম সংগঠন বলেই পরিগণিত হবে।