অর্থনীতি

উপযোগ, চাহিদা, যোগান ও ভারসাম্য (Utility, Demand, Supply and Equilibrium)

1 min read
উপযোগ, চাহিদা, যোগান ও ভারসাম্য
Utility, Demand, Supply and Equilibrium

এই অধ্যায় পাঠশেষে আমরা-

  • উপযোগের ধারণা বর্ণনা করতে পারব।
  • উপযোগ, ভোগ ও ভোক্তার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করতে পারব।
  • মোট উপযোগ যে প্রান্তিক উপযোগের সমষ্টি তা প্রমাণ করতে পারব।
  • ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি চিত্র সহকারে ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • দাম ও চাহিদার পরিমাণের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • দাম ও যোগানের পরিমাণের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারব।
  • ভারসাম্য দাম ও পরিমাণ নির্ণয় করতে পারব।

 

উপযোগ, ভোগ ও ভোক্তা

উপযোগ : আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক দ্রব্য-সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। খাবার সামগ্রী, পরিধানের সামগ্রীসহ অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়। এগুলো না থাকলে আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারিনা। যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বইপত্র, ডাক্তারের সেবা প্রভৃতি দ্রব্য মানুষের অভাব মেটায়। অতএব, অর্থনীতিতে উপযোগ বলতে কোনো দ্রব্যের মানুষের অভাব পূরণের ক্ষমতাকে বোঝানো হয়।

 

ভোগ : প্রতিদিন আমরা ভাত, মাছ, কলম, ঘড়ি, জামা-কাপড় ব্যবহার করি বা এগুলো আমরা ভোগ করি। এখানে ভোগ বলতে কিন্তু এগুলো নিঃশেষ করাকে বোঝায় না। কেননা আমরা কোনো জিনিস ধ্বংস বা নিঃশেষ করতে পারিনা। আমরা শুধু দ্রব্যগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে এর উপযোগ গ্রহণ করতে পারি। খেয়াল রাখতে হবে অভাব মোচন ছাড়া অন্য কোনোভাবে দ্রব্যের উপযোগ ধ্বংস করা হলে তাকে ভোগ বলা হবে না। অতএব অর্থনীতিতে মানুষের অভাব পূরণের জন্য কোনো দ্রব্যের উপযোগ নিঃশেষ করাকে ভোগ বলা হয়।

ভোক্তা : যে ব্যক্তি ভোগ করে তাকে আমরা ভোক্তা বলি। অর্থাৎ কোনো অবাধ সহজলভ্য দ্রব্য ছাড়া অন্য সব দ্রব্য ভোগ করার জন্য যে ব্যক্তি অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত থাকে তাকে ভোক্তা বলা হয়।

মোট উপযোগ ও প্রান্তিক উপযোগ

মোট উপযোগ

বাজারে গিয়ে তুমি খাওয়ার জন্য একাধিক আম কিনতে চাও। ১ম আমটি কিনতে তুমি যে টাকা ব্যয় কর ২য়, ৩য় বা ৪র্থ বার আম ক্রয় করতে তা কর না। কারণ ১ম আমটি ভোগ করার পর তোমার আম খাওয়ার ইচ্ছা অনেকটা পূরণ হয়ে যায়। ২য় বার আমের প্রতি তোমার আকাঙ্খা বা আগ্রহ কমে যায়। ৩য়, ৪র্থ আমের ক্ষেত্রে আগ্রহ আরো কমবে। এমন হতে পারে যে, তুমি আর আম কিনবেনা। কারণ আম খাওয়ার প্রতি সে সময়ে তোমার আর কোনো আগ্রহ থাকে না বা তোমার কাছে অতিরিক্ত আমের উপযোগ শূন্য। আম μয় করতে তোমাকে টাকা ব্যয় করতে হয়। ধরি, ১ম আমটি তুমি কিনলে ৮ টাকায়, ২য় আমটি কিনতে তুমি ৭ টাকা দিতে রাজি থাকো, ৩য় আমের জন্য ৬ টাকা দিতে চাও এবং ৪র্থ আমের জন্য ৫ টাকা। এভাবে (৮ + ৭ + ৬ + ৫) = ২৬ টাকা দিয়ে তুমি ৪টি আম কিনলে। টাকাকে উপযোগের মাপকাঠি ধরলে এখানে ৪টি আমের মোট উপযোগ ২৬। অতএব, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে একটি দ্রব্যের বিভিন্ন একক থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তির সমষ্টিকে মোট উপযোগ বলে। যেহেতু অতিরিক্ত আম থেকে ক্রমান্বয়ে কম তৃপ্তি পাওয়া যায়, সেহেতু ভোগের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে মোট উপযোগ ক্রমহ্রাসমান হারে বাড়ে।

 

প্রান্তিক উপযোগ :

মনে কর তুমি ৩টি আম কিনেছ। এখন তুমি আবার আরেকটি আম কিনলে। এই অতিরিক্ত ৪র্থ আমটি হলো প্রান্তিক আম। এই প্রান্তিক আম থেকে তুমি যে তৃপ্তি বা উপযোগ খেলে তাই প্রান্তিক উপযোগ। এই আম কিনতে তুমি ৫ টাকা ব্যয় করলে প্রান্তিক উপযোগ হবে ৫। অর্থাৎ অতিরিক্ত এক একক দ্রব্য বা সেবা ভোগ করে যে অতিরিক্ত উপযোগ বা তৃপ্তি পাওয়া যায় তাকে প্রান্তিক উপযোগ বলে।

ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি

উপরের উদাহরণ থেকে দেখা যাচ্ছে তুমি বার বার একই পরিমাণ আম খেলে আমের প্রতি তোমার আগ্রহ কমতে থাকে এবং উপযোগও কমে। উপযোগ কমে বলেই তুমি অতিরিক্ত একক আমের জন্য কম দাম দিতে চাও। ৬ষ্ঠ আমের জন্য উপযোগ শূন্য (Zero) এবং ৭ম আমের প্রান্তিক উপযোগ ঋণাত্মক (Negative)। অর্থাৎ একই জিনিস বার বার ভোগ করলে অতিরিক্ত এককের উপযোগ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। সুতরাং ভোক্তা কোনো একটি দ্রব্য যত বেশি ভোগ করে তার কাছে ঐ দ্রব্যের প্রান্তিক উপযোগ তত কমে যেতে থাকে। ভোগের একক বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক উপযোগ কমে যাবার এ প্রবণতাকে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি বলে।

 

ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধিটি কিছু শর্ত মেনে চলে। তা হলো –

ক) ভোক্তা হবে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন;

খ) ভোক্তা চাইলে দ্রব্যের উপযোগ অর্থ দিয়ে পরিমাপ করতে পারে;

গ) দ্রব্যের দাম প্রান্তিক উপযোগের সমান হবে;

ঘ) দ্রব্যটি ভোগ করার সময় ভোক্তার আয়, রুচি এবং পছন্দের পরিবর্তন হবে না।

চাহিদা, চাহিদা বিধি, চাহিদা সূচি (স্বাভাবিক দ্রব্য)

আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছু পেতে চাই। গাড়ি, সুন্দর বাড়ি, উনড়বত খাবার ইত্যাদি। আমাদের সব আকাঙ্ক্ষা কিন্তু চাহিদা নয়। ভিক্ষুকের উদাহরণ দারিদ্রের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখানো। অর্থনীতিতে চাহিদা হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন-

 

১. কোনো দ্রব্য পাওয়ার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা;

২. ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অধিক সামর্থ্য এবং

৩. অর্থ ব্যয় করে দ্রব্যটি ক্রয়ের ইচ্ছা। সুতরাং ক্রেতার একটি পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে কেনার আকাঙ্ক্ষা, সামর্থ্য এবং নির্দিষ্ট মূল্যে দ্রব্যটি ক্রয় করার ইচ্ছা থাকলে তাকে অর্থনীতিতে চাহিদা (Demand) বলে।

চাহিদা বিধি : তোমার মা তোমার বাবাকে বাজার থেকে ইলিশ মাছ আনতে বললেন। বাজার থেকে এসে তোমার বাবা বিরক্তির সাথে বললেন, ইলিশ মাছের দাম বেশি তাই কেনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ দাম বেড়ে যাওয়ায় তোমার বাবার কাছে ইলিশ মাছের চাহিদা নেই বা কমে গেছে। আবার একদিন তোমার বাবা হঠাৎ দুটি ইলিশ মাছ নিয়ে বাড়ি এলেন এবং হাসিমুখে বললেন আজকে ইলিশ মাছের দাম কম তাই দুটো মাছ নিয়ে এলাম। অর্থাৎ চাহিদার সাথে দামের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

অতএব চাহিদা বিধি বা সূত্র বলতে আমরা বুঝি “অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে পণ্যের দাম কমলে তার চাহিদার পরিমাণ বাড়ে এবং দাম বাড়লে চাহিদার পরিমাণ কমে।” [দাম (↑) – চাহিদা (↓ ) আবার দাম (↓) – চাহিদা (↑)]। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে, ক্রেতার রুচি, অভ্যাস ও পছন্দের কোনো পরিবর্তন হবে না এবং ক্রেতার আয় ও বিকল্প দ্রব্যের দাম অপরিবর্তিত থাকবে ইত্যাদি।

 

চাহিদা সূচি

চাহিদা বিধিতে আমরা দেখেছি দামের সাথে চাহিদার বিপরীত সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থাৎ দ্রব্যের দাম বাড়লে চাহিদার পরিমাণ কমে আবার দ্রব্যের দাম কমলে চাহিদার পরিমাণ বাড়ে। এ ধারণাটি যখন সূচির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন তাকে চাহিদা সূচি বলে। অতএব, বলা যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন দামে কোনো দ্রব্যের যে বিভিন্ন পরিমাণ চাহিদা হয় তা যে তালিকার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তাকে চাহিদা সূচি বা চাহিদা তালিকা বলে।

যোগান, যোগান বিধি, যোগান রেখা

যোগান : বাজারে গেলে আমরা দেখব বিμয়ের জন্য বিভিনড়ব দ্রব্য নিয়ে বিক্রেতাগণ দোকান সাজিয়ে রেখেছেন। তবে আমরা এটাকেই যোগান বা সরবরাহ বলব না। অর্থনীতিতে যোগান বলতে একজন বিক্রেতা কোনো একটি দ্রব্যের যে পরিমাণ একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং একটি নির্দিষ্ট দামে সরবরাহ করতে ইচ্ছুক ও সমর্থ থাকে তাকে যোগান বলে।

উল্লেখ্য- একটি দ্রব্য, একটি নির্দিষ্ট সময় ও একটি নির্দিষ্ট দাম এখানে বিবেচ্য। অতএব, বিক্রেতা যে দামে দ্রব্যের যে পরিমাণ সরবরাহ করতে ইচ্ছুক তাকেই অর্থনীতিতে যোগান (Supply) বলে।

 

যোগান বিধি

আমরা প্রতিনিয়ত বাজারে জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয় করে থাকি। একজন বিক্রেতা কখন তার দ্রব্যটি বিক্রয় করতে আগ্রহী হবেন? অবশ্যই ঐ দ্রব্যের দাম যখন বাজারে সবচেয়ে বেশি তখনই একজন বিক্রতা তার পণ্য বিক্রয় করতে চাইবেন।

ধরো, আলুর কেজি যখন ১৫ টাকা তখন বিক্রতা ২ কুইন্টাল আলু বিক্রয় করে। দাম বেড়ে ২০ টাকা কেজি হলে বিক্রেতা বেশি পরিমাণে আলু সরবরাহ করতে চায়। মনে করি, তখন সরবরাহ হবে ৩০ কুইন্টাল। অর্থাৎ দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রব্যের যোগানের পরিমাণ বাড়ে এবং দাম কমার সাথে সাথে দ্রব্যের যোগানের পরিমাণ কমে যায়। অতএব দাম ও যোগানের সম্পর্ক সমমুখী। দাম যেদিকে পরিবর্তিত হয় যোগানও সেদিকে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে (যেমন, প্রযুক্তি স্থির, স্বাভাবিক সময় বিবেচিত), দাম বৃদ্ধি পেলে যোগানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং দাম হ্রাস পেলে যোগানের পরিমাণ হ্রাস পায়।

যোগান রেখা

কোনো দ্রব্যের দাম বাড়লে যোগানের পরিমাণ বাড়ে, দাম কমলে যোগানের পরিমাণ কমে। দাম পরিবর্তনের ফলে যোগানের পরিমাণের এ সমমুখী পরিবর্তনকে যখন রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয় তখন তাকে যোগান রেখা বলে।

 

ভারসাম্য দাম নির্ধারণ

বাজারের একটি সাধারণ দৃশ্য হলো ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দ্রব্যের দাম নিয়ে দর কষাকষি করা। ক্রেতা চেষ্টা করে সর্বনিম্ন দামে দ্রব্যটি ক্রয় করতে। আবার, বিক্রেতা চেষ্টা করে সর্বোচ্চ দামে দ্রব্য বিক্রয় করতে। ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষির ফলে এমন একটি দামে দ্রব্যটি ক্রয়-বিক্রয় হয় যেখানে তার চাহিদা ও যোগান পরষ্পর সমান। যে দামে চাহিদা ও যোগান সমান হয় তাকে ভারসাম্য দাম বলে। ভারসাম্য দামে যে পরিমাণ দ্রব্য কেনা-বেচা হয় তাকে ভারসাম্য পরিমাণ বলে।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x