বাংলা ভাষা
বাংলা ভাষার ‘বাংলা’ শব্দটি প্রাচীন যুগে ‘বাঙলা’ শব্দ রূপে লিখা হতো। বাংলা ভাষা সম্পর্কে জানতে হলে, শুরুতেই বুঝতে হবে ‘ভাষা’ কি বা কাকে বলে।
ভাষা
এককথায়, মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে বলা হয় ভাষা। ব্যাকরণিক ভাষায়, ‘বাগযন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে যখন মনের ভাব প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে ভাষা বলে‘। এইখানে, বাগযন্ত্র বলতে দাঁত, নাক, তালু, জিহ্বা, কন্ঠনালী ইত্যাদি বাক-প্রতঙ্গ সম্পর্কীয় অঙ্গকে বুঝানি হয়েছে। পৃথিবীতে চার থেকে আট হাজারের মত ভাষা আছে এবং তার মধ্যে সাড়ে তিন হাজার ভাষা বর্তমানে প্রচলিত আছে। ভাষার মূল অংশ চারটি (অর্থ, ধ্বনি, শব্দ, ও বাক্য) । ভাষার মূল উপকরন বাক্য এবং ক্ষুদ্রতম একক হচ্ছে ধ্বনি ।
ভাষার উপসংহারে বলা যায় যে, ভাষার দুইটি মূল বিষয় হচ্ছে, ১। মুখে উচ্চারিত শব্দ সমূহ অর্থবোধক হতে হবে, এবং ২। মুখে উচ্চারিত শব্দ সমূহের দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ পাবে।
বাংলা ভাষা কাকে বলে?
মানুষের কন্ঠ নিঃসৃত বাক সংকেতের সংগঠনগুলো যখন বাংলার ব্যাকরণিক রীতি, অক্ষর, শব্দ অনুসরণ করে মনের ভাব প্রকাশ করা হয়, তাকে বাংলা ভাষা বলে। পৃথিবীতে ভাষাভাষীর জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষা চতুর্থ অবস্থানে অবস্থান করছে। বাংলা ভাষার আনুমানিক বয়স হবে প্রায় এক হাজার থেকে চৌদ্দশ বছর (১০০০ – ১৪০০)।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ
ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ প্রথম বাংলা ভাষার উৎপত্তির এক ছক তৈরি করেন। উনার মতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে আনুমানিক সপ্তম শতাব্দীতে ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা থেকে।
ইন্দো ইউরোপীয় -> শতম -> আর্য ভাষা -> প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা -> প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য -> প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত -> গৌড় প্রাকৃত -> গৌড় অপভ্রংশ -> বাংলা ভাষা
আবার, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভিন্ন মতামত প্রদান করেন, তাঁর মতে মাগধী প্রাকৃত থেকে দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। তবে, বেশিরভাগ ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলা ভাষার উদ্ভব বা উৎপত্তি প্রাকৃত থেকে। তাহলে বলা যায় যে, প্রাকৃত বাংলা ভাষার পূর্বের স্থর। প্রাকৃত শব্দের অর্থ স্বাভাবিক। তাহলে, প্রাকৃত ভাষা হচ্ছে জনগনের ভাষা। অপভ্রংশ, প্রাকৃতের বিপরীত অর্থ বুঝায়। অপভ্রংশ অর্থ হচ্ছে বিকৃত। অপভ্রংশের অবদান বাংলা ভাষায় এবং বাংলা সাহিত্যে অপরিসীম। বাংলা ভাষার সবচেয়ে কাছাকাছি ভাষা হচ্ছে অসমিয়া।
উল্লেখ্য, প্রাচীন বাংলা ভাষার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, ১। ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ২। রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, এবং ৩। ছন্দোরীতিগত বৈশিষ্ট্য
বাংলা ভাষার প্রকারভেদ অথবা রীতি
বাংলা ভাষার সাথে সংমিশ্রন হয়েছে বিভিন্ন ভাষার ভিন্ন ভিন্ন শব্দসমূহ। বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজি, ফারসি, আরবি ইত্যাদি বিদেশী ভাষার অনেক শব্দ কালের অকালে মিশ্রিত হয়েছে। বাংলার বিশেষ করে বাংলাদেশের এক অঞ্চলের বাংলা ভাষার সাথে অন্য অঞ্চলের বাংলা ভাষার মিল নেই, তবে ভাবের মিল থাকে। বাংলা ভাষায় যেমন কথা বলার ক্ষেত্রে উপভাষার ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে লেখার বিভিন্নতা। সেক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে দুইভাগে বিভক্ত করা যায়,
১। লৈখিক বা লেখ্য
২। মৌখিক বা কথ্য
শুধু বাংলা ভাষায় নয়, মৌখিকথার বা লৈখিকথার ভিন্নতা দেখা যায় অন্য ভাষায়ও (ইংরেজি, আরবি, হিন্দি, ফারসি)। মৌখিক বা কথ্য বাংলা ভাষার একটি রূপ দেখা যায় এবং সেটি হচ্ছে ‘আঞ্চলিক ভাষা’। অনুরূপভাবে, লৈখিক বা লেখ্য বাংলা ভাষার রীতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় (সাধু ভাষা, চলিত ভাষা)।
বাংলা ভাষার প্রকারভেদ |
১। সাধু ভাষা বা সাধু লেখ্য রীতি
বাংলা ভাষার যে লেখ্য রীতি সুনির্দিষ্ট ভাবে ব্যাকরণের পদবিন্যাস মেনে চলে, তাকে সাধু রীতি বা সাধু ভাষা বলে।
উদাহরণ: বৈশাখী ঝড়ে শিমুল গাছটি ভাঙিয়া যাইতে লাগিল। শিমুল গাছটিতে কতই সুন্দর ফুল ফুটিয়া রহিয়াছে। আমি ঝড়ের পূর্বেই বাড়িতে আসিয়া হাজির হইলাম।
২। চলিত ভাষা বা চলিত লেখ্য রীতি
বাংলা ভাষার যে লেখ্য রীতি তদ্ভব শব্দবহুল, সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য, তাকে চলিত রীতি বা চলিত ভাষা বলে।
উদাহরণ: বৈশাখের ঝড়ে শিমুল গাছটি ভেঙে যেতে লাগল। শিমুল গাছে কত সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে। আমি ঝড়ের আগেই বাড়িতে এসে হাজির হলাম।
৩। আঞ্চলিক ভাষা বা আঞ্চলিক কথ্য রীতি
মৌখিক ভাবে শুধু আঞ্চলিক ভাষার ভিন্নতা রয়েছে। কোন কোন আঞ্চলিক ভাষার রয়েছে নির্দিষ্ট অক্ষর এবং ব্যাকরনের নিয়ম।
উদাহরণ: বাংলাদেশের সিলেট এবং ভারতের আসাম রাজ্যে সিলেটি-নাগরী ভাষার প্রচলন রয়েছে। এই নাগরী ভাষার রয়েছে নিজস্ব শব্দ গঠনের নীতি ও অক্ষর। ‘শিমুল গাছে কত সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে‘ এই বাক্যকে সিলেটি আঞ্চলিক নাগরী ভাষায় রূপান্তরিত করলে হবে, ‘শিমুল গাছ-অ খত সুন্দর ফুল ফুটছে‘।
উপরোক্ত সাধু ও চলিত ভাষার উদাহারণ দুটিতে শাব্দিক পার্থক্য তুলে ধরা হলো।
পদ | সাধু | চলিত |
বিশেষ্য | বৈশাখী | বৈশাখের |
ক্রিয়া | ভাঙিয়া যাইতে লাগিল | ভেঙে যেতে লাগল |
বিশেষ্য | গাছটিতে কতই | গাছে কত |
ক্রিয়া | ফুটিয়া রহিয়াছে | ফুটে রয়েছে |
অব্যয় | পূর্বেই | আগেই |
ক্রিয়া | আসিয়া | এসে |
ক্রিয়া | হইলাম | হলাম |
সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য
ধর্ম | সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
১। গুরুগম্ভীরতা | সাধু ভাষা গুরুগম্ভীর | চলিত ভাষা গুরুগম্ভীর নয় |
২। শব্দবহুল | সাধু ভাষা তৎসম শব্দবহুল | চলিত ভাষা গুরুগম্ভীর তদ্ভব শব্দবহুল |
৩। ব্যাবহার উপযোগিতা | সাধু ভাষা নাটকের সংলাপ ও
বক্তৃতায় ব্যাবহার উপযোগী নয় |
চলিত ভাষা নাটকের সংলাপ, বক্তৃতায়, এবং আলাপ-আলোচনায় বিশেষভাবে উপযোগী |
৪। সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের গঠন | সাধু ভাষার সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ এক অনন্য গঠন পদ্ধতি মেনে চলে | চলিত ভাষার সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের গঠন সর্বদা পরিবর্তন হয়, যার ফলে চলিত ভাষা সহজতর রুপ ধারণ করে |
৫। পরিবর্তনশীলতা | সাধু ভাষা অপরিবর্তনশীল | চলিত ভাষা পরিবর্তনশীল |
৬। অনুসর্গ | সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ব রুপ ব্যাবহার করা হয় | চলিত ভাষায় অনুসর্গের পূর্ব রুপের পরিবর্তন হয় |
৭। হ-কার | সাধু ভাষায় হ-কার লোপের প্রবণতা নেয় বললে চলে | চলিত ভাষায় হ-কার লোপের প্রবণতা অনেক বেশি |
৮। মনের ভাব প্রকাশ | মনের ভাব প্রকাশে সাধু ভাষা উপযোগী নয় | মনের ভাব প্রকাশে চলিত ভাষা সবচেয়ে বেশি উপযোগী |
৯। উদাহারণ | তাঁহার সহিত দেখা হইয়াছিল | তার সাথে দেখা হয়েছিল |
কিছু সাধু ও চলিত ভাষার পদ অনুসারে শাব্দিক পার্থক্য দেওয়া হলো
নং | পদ | সাধু ভাষায় রুপ | চলিত ভাষায় রুপ |
১ | বিশেষ্য | মস্থক | মাথা |
২ | জুতা | জুতো | |
৩ | তুলা | তুলো | |
৪ | পূজা | পুজো | |
৫ | জ্যোৎস্না | জোছনা | |
৬ | পুরোহিত | পুরুত | |
৭ | বিশেষণ | শুষ্ক / শুকনা | শুকনো |
৮ | বন্য | বুনো | |
৯ | সর্বনাম | তাঁহারা | তাঁরা |
১০ | তিনি | সে | |
১১ | উহারা | ওঁরা | |
১২ | তাহাকে | তাকে | |
১৩ | উহাকে | ওকে | |
১৪ | তাঁহার | তাঁর | |
১৫ | তাহার | তার | |
১৬ | ক্রিয়া | করিবার | করবার |
১৭ | করিবার | করার | |
১৮ | পাইয়াছিলেন | পেয়েছিলেন | |
১৯ | গিয়াছিলেন | গিয়েছেন | |
২০ | যাইয়াছিলেন | যেয়েছিলেন/যান | |
২১ | রহিয়াছে | রয়েছে | |
২২ | হইলেন | হলেন | |
২৩ | হইল | হল / হলো | |
২৪ | হইয়া | হয় | |
২৫ | আসিয়া | এসে | |
২৬ | দেখিয়া | দেখে | |
২৭ | করিলেন | করলেন | |
২৮ | পড়িল | পড়ল / পড়লো | |
২৯ | লাগিল | লাগল | |
৩০ | খুলিয়া | খুলে | |
৩১ | বলিয়া | বলে | |
৩২ | ভাঙিয়া | ভেঙে | |
৩৩ | ভাঙাইতে | তাঙতে | |
৩৪ | দেখিয়া | দেখে | |
৩৫ | ফুটিয়া | ফুটে | |
৩৬ | দেন নাই | দেন নি | |
৩৭ | ছুটিতে | ছুটতে | |
৩৮ | চকিত হইয়া | চকিত হয়ে | |
৩৯ | ছড়াইয়া দিলে | ছড়ালে | |
৪০ | পার হইয়া | পার হয়ে | |
৪১ | অবয় | পূর্বে | আগে |
৪২ | পূর্বেই | আগেই | |
৪৩ | অদ্য | আজ | |
৪৪ | সহিত | সঙেগ | |
৪৫ | সহিত | সাথে | |
৪৬ | অপক্ষা | চেয়ে | |
৪৭ | দিয়া | দিয়ে |