বাংলা সাহিত্য কি?
মানবজীবন, সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পায় সাহিত্য লিখার মধ্যে দিয়ে। একজন লেখকের সাহিত্যের রূপ অলংকারের দ্বারা আমাদের মানবজীবন এবং সমাজজীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, বাস্তব-অবাস্তব সব স্বপ্ন প্রতিফলিত হয়। এখন কথা হচ্ছে সাহিত্য কাকে বলে? এক কথায় বলতে গেলে, ‘সাহিত্য হচ্ছে আমাদের সমাজজীবন তথা মানবজীবনের দর্পন স্বরূপ‘ । সাহিত্য হল জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কিছু অনুভূতি বা ধারণার একটি স্থায়ী প্রকাশ।
সাহিত্যের সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞাটি দিয়েছেন সাহিত্যবিদ ডাঃ লুৎফর রহমান। তাঁর মতে, ‘জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে যিনি যত কথা বলিয়া থাকেন, তাহাই সাহিত্য’।
‘সাহিত্য’ শব্দের উৎপত্তি
‘সাহিত্য‘ শব্দটি বাংলা ‘সহিত‘ শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। বাংলা ‘সহিত’ অর্থ হচ্ছে যোগ, সংযোগ, মিলন, অথবা সম্মিলন। ‘সহিত’ +’য’ = ‘সাহিত্য’, ‘য’ প্রত্যয় বাংলা ‘সহিত’ শব্দের সাথে মিলিত হয়ে ‘সাহিত্য’ শব্দটির সৃষ্টি হয়। তাহলে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ কি? বাংলা অভিধানে ‘সাহিত্য’ শব্দের অর্থ হচ্ছে একটি সহিত মনের ভাবের সাথে অন্য আরেকটি সহিত ভাবের মিলন বা বন্ধন।
সাহিত্যের শ্রেণীবিভাগ
রূপভেদ অনুসারে সাহিত্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়।
ক . মন্ময় সাহিত্য: যখন কোনো সাহিত্য দ্বারা এক বা অধিক ব্যক্তির, ব্যক্তিগত অনুভূতি বা মনের ভাব প্রকাশ পায়, তখন তাকে মন্ময় সাহিত্য বলে। মন্ময় সাহিত্যকে ইংরেজিতে ‘Subjective literature‘ বলে।
খ . তন্ময় সাহিত্য: যখন কোনো সাহিত্য দ্বারা ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ না পেয়ে বস্তুগত বা বস্তুসত্তার তথ্য অথবা বস্তুসত্তার পরিচয় বেশি প্রাধান্য পায়, তখন ওই সাহিত্যকে তন্ময় সাহিত্য বলে। ইংরেজিতে এই সাহিত্যকে ‘Objective literature‘ বলে।
আমরা সাহিত্যের রূপভেদ সম্পর্কে জেনে নিলাম , এখন বাংলা সাহিত্যের মূল শ্রেণীবিভাগ বা প্রকারভেদ সমূহ জেনে নিবো।
১. প্রবন্ধ: প্রবন্ধ বলতে, গদ্যরীতি অনুসারে সৃষ্ট নতুন কোনো সাহিত্যকর্মকে বোঝায়। তবে প্রবন্ধ শুধু বিষয়বস্তুকে আলোকপাত করে। সমাজ, রাজনীতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যে তথ্যমূলক গদ্য, লেখক তৈরী করেন, তা-ই হচ্ছে প্রবন্ধ সাহিত্য।
২. ছোটগল্প: ছোটগল্প হবে ছোট এবং তাতে থাকতে হবে গল্প। যখন কোনো সাহিত্য একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হয়, তখন তাকে ছোটগল্প বলে।
৩. কবিতা: কবিতা কে-না ভালোবাসে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের মাধুর্য ফুটে ওঠে। কবিতাকে অনেক সময় আমরা পদ্য বলে থাকি। যে সাহিত্যের দ্বারা মনের ভাব ছন্দের চরণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, তাকে কবিতা বলে।
৪. উপন্যাস: যে সাহিত্য দ্বারা মানব সমাজের বিস্তারিত কয়েকটি পর্বে আলোচনা করা হয়, তখন ওই সাহিত্য কর্মকে উপন্যাস বলে।
৫. নাটক: নাটক সাহিত্যটি, সাহিত্যের এক অনন্য অনলংকার। এই সাহিত্যকর্মের মূল বিষয় হচ্ছে কথোপকথন। একটি নাটক একটি বিষয় বস্তুর বাস্তব ছবি তুলে দরে।
৬. সমালোচনামূলক সাহিত্য: মানব বা সমাজজীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, বা ব্যক্তিজীবনকে সমালোচনা করা-ই, এই সাহিত্যের মূল লক্ষ্য।
বাংলা সাহিত্যের যুগের বিভাজন
১. প্রাচীন যুগ
প্রাচীন যুগের অন্যতম নির্দেশন হচ্ছে চর্যাপদ এবং দোহাকোষ।
প্রাচীন যুগের ব্যাপ্তি : (৬৫০ – ১২০০) খ্রিষ্টাব্দ
প্রাচীন যুগে সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য: ধর্ম নির্ভরতা, কাব্যসাহিত্য
২. মধ্য যুগ
মধ্য যুগের ব্যাপ্তি : (১২০১ – ১৮০০) খ্রিষ্টাব্দ
মধ্য যুগে সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য: দেব-দেবীর সাহিত্য
মধ্যযুগের বিভাজন
ক. মুসলিম শাসনভিত্তিক
তুর্কি যুগ (১২০১ – ১৩৫০)
সুলতানি যুগ (১৩৫১ – ১৫৭৫)
মুঘল যুগ (১৫৭৬ – ১৮০০)
খ. শ্রীচৈতন্য জীবনীভিত্তিক
প্রাকচৈতন্যে যুগ (১৩৫১ – ১৫০০)
চৈতন্যে যুগ (১৫০১ – ১৬০০)
প্রাকচৈতন্যে যুগ (১৬০১ – ১৮০০)
৩. অন্ধকার যুগ
অন্ধকার যুগের ব্যাপ্তি : (১২০১ – ১৩৫০) খ্রিষ্টাব্দ
অন্ধকার যুগে সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য: কিঞ্চিৎ কাব্য সাহিত্য
৪. আধুনিক যুগ
আধুনিক যুগের ব্যাপ্তি : (১৮০১ – চলিতেছে) খ্রিষ্টাব্দ
আধুনিক যুগে সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য: গদ্য সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের অগ্রযাত্রা (সূচনা) এবং বাংলা সাহিত্যবিদ
উইলিয়াম কেরি (জন্ম ১৭৬২, ইংল্যান্ডের নর্রদামটোনশায়ারে – মৃত্যু ১৮৩৪)
উইলিয়াম কেরি ইংরিজী সাহিত্যবিদ হয়ে বাংলা অনেক সাহিত্য রচনা করছেন। তাকে বাংলা গদ্য লেখক এবং বাংলা মুদ্রণের প্রবর্তক বলা হয়। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের অধক্ষ্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অগ্রযাত্রায় তার ভূমিকা অপরিসীম।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: কথোপকথন
রাজা রামমোহন রায় (জন্ম ১৭৭২, হুগলি জেলার রাধানগরে গ্রামে – মৃত্যু ১৮৩৩)
রামমোহন রায় বাংলা গদ্যে প্রাঞ্চল ভাষারীতির প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার নতুন বিকাশ ঘটান। তিনিই সর্বপ্রথম গদ্যরীতি পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ব্যবহার করেন। ঐ যুগে গদ্য রীতি পাঠ্যপুস্তকেই স্বীমাবদ্ধ ছিল।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: বেদান্ত সার, পথ্য প্রদান।
ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (জন্ম ১৮১২, পশ্চিমবঙ্গের কাচড়াপাড়ায় শিয়ালডাঙ্গা গ্রামে – মৃত্যু ১৮৫৯)
বাংলা সাহিত্যকে আধুনিক সাহিত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হচ্ছেন আধুনিক যুগের প্রথম কবি এবং প্রথম সচেতন কবি। মূলত, আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট পাওয়া গিয়েছিলো তার সাহিত্য কর্মে।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: হিত প্রভাকর, প্রবোধ প্রভাকর।
প্যারীচাঁদ মিত্র (জন্ম ১৮১৪, কলকাতায় – মৃত্যু ১৮৩৮)
বাংলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্র ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ নামে পরিচিত। এই নামে তিনি সাহিত্য রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’, তিনি রচয়িতা। অর্থাৎ, তিনিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: আলালের ঘরের দুলাল, অভেদী, গীতাংকুর, যৎকিঞ্চিৎ।
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (জন্ম ১৮২০, পশ্চিমবঙ্গের,মেদিনীপুর-বীরসিংহ গ্রামে – মৃত্যু ১৮৯১ :: ছদ্মনাম ‘কস্যচিত উপযুক্ত ভাইপোষ্য’):
ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের সার্থক সাহিত্যিক বলা হয়ে থাকে। তিনি ‘কস্যচিত উপযুক্ত ভাইপোষ্য’ ছদ্মনামে সাহিত্য রচনা করতেন। বাংলা গদ্যের সার্থক যতিচিহ্ন তিনি-ই প্রথম ব্যবহার করেন।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: সীতার বনবাস, ভ্রান্থী বিলাস।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (জন্ম ১৮২৪, যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে- মৃত্যু ১৮৭৩)
বাংলা কাব্যসাহিত্যে আধুনিকতার প্রকৃত প্রবর্তক হচ্ছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তার রচিত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রথম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য। প্রথম সার্থক নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং সার্থক ট্রাজেডি ‘কৃষ্ণকুমারী’ তার-ই সাহিত্য সৃষ্টি।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: পদ্মাবতী, বীরাঙ্গনা, কৃষ্ণকুমারী।
বিহারীলাল চক্রবর্তী (জন্ম ১৮৩৫, কলকাতার নিমতলায় – মৃত্যু ১৮৯৪)
বিহারীলাল চক্রবর্তীকে আধুনিক গীতিকবিতার প্রবর্তক বলা হয়। তার কাব্যে প্রেম-প্রীতির কথা ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: প্রেমপ্ৰবাহিনী, বঙ্গসুন্দরী, বন্ধুবিয়োগ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৮৩৮, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কাঁঠালপাড়া গ্রামে – মৃত্যু ১৮৯৪)
বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্র, আর বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের স্থপতি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তার রচিত প্রথম বাংলা সাহিত্যে সার্থক উপন্যাস হচ্ছে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: দুর্গেশনন্দিনী, আনন্দমঠ, বিষবৃক্ষ, কমলাকান্তের উইল।
মীর মশাররফ হোসেন (জন্ম ১৮৪৭, কুষ্টিয়া জেলার লাহিনী পাড়া গ্রামে – মৃত্যু ১৮৯৪ :: ছদ্মনাম ‘গাজী মিয়া’)
তিনি বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রথম মুসলিম সাহিত্যিক। বাংলা মুসলিম উপন্যাস সাহিত্যে তিনি-ই প্রথম মুসলিম উপন্যাস লিখেন এবং সেটি হচ্ছে ‘রত্নবতী’ ।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: বিষাদসিন্ধু, জমিদার দর্পন, রত্নবতী
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জন্ম ১৮৬১, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার – মৃত্যু ১৯৪১ :: ছদ্মনাম ‘ভানুসিংহ’)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বকবি নামে সুপরিচিত। তিনি-ই একমাত্র প্রথম বাঙালি, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ১৯১৩ সালে তার রচিত ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: শেষের কবিতা, ডাকঘর, সোনার তরী, চিত্রা, রক্তকরবী।
প্রমথ চৌধুরী (জন্ম ১৮৬৮, যশোর, বাংলাদেশ – মৃত্যু ১৯৪৬ :: ছদ্মনাম ‘বীরবল’)
প্রমথ চৌধুরী একধারে বাংলা, ইংরেজি, এবং ফরাসি সাহিত্যে দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত সাহিত্য কর্ম তাঁর-ই ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। প্রমথ চৌধুরীকে চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক বলা হয়।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: বীরবলের হালখাতা, নীললোহিত, সনেট পঞ্চাশৎ।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জন্ম ১৮৭৬, পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে – মৃত্যু ১৯৩৮)
তিনি রবীন্দ্র যুগে সাবলীল ভাষায় সাহিত্য প্রকাশ করে অনেক জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: শ্রীকান্ত, দেবদাস, দেনা-পাওনা, বড়দিদি।