বিভারিজ রিপোর্ট কি, সুপারিশমালা, বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য তথ্যাদি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইংল্যান্ডের সার্বিক সমাজকল্যাণ কর্মসূচিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়। ইংল্যান্ডের শ্রম ও পুনর্গঠন মন্ত্রী আর্থার গ্রিন উড (Aurther Green Wood) পার্লামেন্টের সম্মতিক্রমে সামাজিক বীমা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির আন্তঃবিভাগীয় কমিটি (Interdepartmental Committee on Social Insurance and Allied Services) গঠন করেন । প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ স্যার উইলিয়াম বিভারিজ (Sir William Beveridge) কে এ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ কমিটিই ‘বিভারিজ কমিটি’ নামে পরিচিত।
বিভারিজ রিপোর্ট কি
বিভারিজ কমিটির দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ সমাজসেবার দক্ষতা ও কাঠামো জরিপ করা এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা পেশ করা। কমিটি বিভিন্ন সরকারি সাহায্য সংস্থা, সামাজিক রীমা সংস্থা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্কিত সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে বিভিন্ন শ্রেণীর শত শত নাগরিক, বণিক সংঘ, উৎপাদক সমিতি, বাণিজ্যিক বীমা কোম্পানি, শ্রমিক সংঘ, ভোক্তা সমিতি, ফেবিয়াল সমিতি প্রমুখের মতামত গ্রহণ করেন। উইলিয়াম বিভারিজ সকলের মতামত শ্রবণ করে ১৮ মাস পর ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এটি ইতিহাসে বিভারিজ রিপোর্ট নামে খ্যাত। বিভারিজ কমিটির সভাপতি হিসেবে ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করেন। কমিটি অভাব থেকে মুক্তির; আধুনিক শিল্পায়িত সমাজের ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক দুর্দশা, দারিদ্র্য এবং উপার্জনহীনতা থেকে বের হয়ে আসার পথ দেখায়।
বিভারিজ কমিটির রিপোর্টে ‘পঞ্চ দৈত্য’
বিভারিজ কমিটির রিপোর্ট মানবসমাজের অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করে। এগুলো হলো,
১. অভাব (Want),
২. রোগব্যাধি (Disease),
৩. অজ্ঞতা (Ignorance),
৪. অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ (Squalor) এবং
৫. অলসতা (Idleness)
বিভারিজ এগুলোকে মানবকল্যাণের পথে দৈত্য (Giant) বলে অভিহিত করে। এ পাঁচটি দৈত্যকে আবার ‘পঞ্চদৈত্য’ বলে অভিহিত করা হয়।
বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশমালা
বিভারিজ রিপোর্টে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয় । এ রিপোর্টে পাঁচটি কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যাপক ভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তার সুপারিশ করা হয়। এগুলো হলো,
১. একটি একীভূত, সর্বাত্মক এবং পর্যাপ্ত সামাজিক বীমা কর্মসূচি প্রবর্তন করা।
২. সামাজিক বীমা সুবিধা বহির্ভূত জনগণের জন্য জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করা।
৩. প্রথম শিশুর পর অন্যান্য প্রতিটি শিশুর জন্য সাপ্তাহিক শিশু ভাতার (যা বর্তমানে পারিবারিক ভাতা নামে পরিচিত) ব্যবস্থা করা।
৪. সকল স্তরের জনসাধারণের জন্য ব্যাপকভাবে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন সেবা প্রদান।
৫. অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় ব্যাপক গণবেকারত্ব প্রতিরোধকল্পে সরকারিভাবে পূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
সুপারিশকৃত নীতিমালা
বিভারিজ রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি মৌলিক নীতির কথা বলা হয়। এগুলো হলো,
১. একীভূত প্রশাসন (Unified administration),
২. কর্মসূচির ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিকরণ (Comprehensive coverage),
৩. সমহারে চাঁদা প্রদান (Flat rate of contribution),
৪. সমহারে সুবিধা প্রদান (Flat rate of benefits),
৫. গ্রহীতার মৌলিক চাহিদা পূরণের মতো পর্যাপ্ত সার্বিক সাহায্য (Adequacy of all benefits to meet basic needs of the recipients),
৬. জনসংখ্যার শ্রেণীবিভাজন (Classification of the population)।
(Sir William Beveridge) কে এ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ কমিটিই “বিভারিজ কমিটি’ নামে পরিচিত।
বিভারিজ রিপোর্টের বৈশিষ্ট্য
নিম্নে বিভারিজ রিপোর্টের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো,
১. এ রিপোর্টে ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম সর্বস্তরের জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়। এটি ব্যক্তির নিজের ও তার পরিবারে আয়ের নিশ্চয়তা বিধানের পাশাপাশি তাদের ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
২. এর মাধ্যমে ইংল্যান্ডে আধুনিক বীমা ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়।
৩. এ রিপোর্ট সমস্যা সমাধান ও দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে।
৪. সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি প্রবর্তন ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রদানের পাশাপাশি এ রিপোর্টে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কথাও উল্লেখ করা হয়।
৫. এ রিপোর্টে সমাজের উন্নতি ও প্রগতির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে অজ্ঞতা, অসুখ, অভাব, অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ ও অলসতাকে দায়ী করা হয়।
৬. এ রিপোর্টে অভাব থেকে মুক্তির আধুনিক পদ্ধতি খুঁজে বের করা হয়। পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক দুর্দশা, দারিদ্র্য ও উপার্জনহীনতা থেকে বের হয়ে আসার পথ দেখায়।
৭. সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে এ রিপোর্টে ইংল্যান্ডের জনসমষ্টিকে বিভিন্ন দিক থেকে শ্রেণীবিভাজনের কথা বলা হয়।
৮. আর্থিক বিপর্যয় থেকে ইংল্যান্ডের সমগ্র জনগণকে রক্ষা করার জন্য এ রিপোর্টে বিকল্প কর্মসূচির সুপারিশ করা হয়।
৯. এ রিপোর্টে মানব সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্ক উল্লেখ করা হয়।
১০. বিভারিজ রিপোর্টে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির তিনটি উপাদান সামাজিক বীমা, সামাজিক সাহায্য ও সমাজসেবা কর্মসূচি প্রবর্তনের সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়।
ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন এবং কর্মসূচি ও বিভারিজ রিপোর্টম
ইংল্যান্ডে সামাজিক নিরাপত্তামূলক আইন ও কর্মসূচি বিভারিজ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে প্রবর্তন করা হয়েছে। বর্তমান প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচিও এ রিপোর্টের সুপারিশের আলোকে পরিচালিত হচ্ছে। যদিও কিছু কিছু কর্মসূচি ও আইনের পরিবর্তন করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার সমন্বয় করে জাতীয় সামাজিক বীমা মন্ত্রণালয় (Ministry of National
Insurance)। ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি প্রবর্তনের লক্ষ্যে কতিপয় আইন প্রণীত হয়। এগুলো হলো,
১. পারিবারিক ভাতা আইন, ১৯৪৫ (Family Allowance Act of 1945),
২. জাতীয় বীমা আইন, ১৯৪৬ (National Insurance Act of 1946),
৩. শিল্প দুর্ঘটনা আইন, ১৯৪৬ (Industrial Injuries Act of 1946),
৪. জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা আইন, ১৯৪৬ (National Health Services Act of 1946),
৫. জাতীয় সাহায্য আইন, ১৯৪৮ (National Assistance Act of 1948)
৬. জাতীয় বীমা আইন, ১৯৫৯ (The National Insurance Act of 1959),
৭. ১৯৪৬ সালের সামাজিক সাহায্য আইন,
৮. ১৯৫৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য আইন (Mental Health Act 1959)
৯. বিবিধ (এবং আরো)।
উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, ইংল্যান্ডে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য যেমন ব্যবস্থা গৃহীত হয় তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এসব ব্যবস্থাদি ইংল্যান্ডকে একটি কল্যাণরাষ্ট্রে (Welfare state) পরিণত করে। ইংল্যান্ডের সামাজিক নিরাপত্তামূলক এসব কর্মসূচি ও সামাজিক আইন অবশ্য বিভারিজ রিপোর্টের ভিত্তিতে গড়ে উঠে।