জনসংখ্যা সমস্যা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের জন্য একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। অতিরিক্ত জনসংখ্যা যে কোন দেশের জন্য সমস্যা। অতিরিক্ত জনসংখ্যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত করে। দেশে বেকারত্বসহ জটিল সমস্যা সৃষ্টি করে।
জনসংখ্যা সমস্যা কি (জনসংখ্যা স্ফীতি কি)
কোন দেশের জনসংখ্যা যখন প্রাপ্ত ও সম্ভাব্য সম্পদের তুলনায় বেশি হয় এবং এর প্রভাবে এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয় তখন তাকে জনসংখ্যা সমস্যা বা জনসংখ্যা স্ফীতি বলা যায়। অর্থনীতিবিদ R. Malthus তাঁর An Essay on the principle of population গ্রন্থে বলেন, “যদি কোন দেশের জনসংখ্যা সে দেশের মোট খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে বেশি হয় তবে জনসংখ্যার সে পরিস্থিতিকে জনসংখ্যা স্ফীতি বা সমস্যা বলা হয়।”
সাবেক বিশ্বব্যাংক এর প্রেসিডেন্ট মিঃ ম্যাকনামারা জনসংখ্যা স্ফীতি সম্পর্কে বলেছেন, “পারমাণবিক যুদ্ধ ছাড়া বিশ্ববাসীর মুখে অন্যতম যে সমস্যা তা হচ্ছে জনসংখ্যা স্ফীতি।” মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা কোন দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। তাই বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ এটাকে একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জনসংখ্যা সমস্যায় আক্রান্ত দেশসমূহের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে এবং বেকারত্বসহ বিভিন্ন জটিল সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপক নজির হচ্ছে মধ্য দক্ষিণ এশিয়ায়। এখানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ বাস করে। সুতরাং বলা যায়, যে কোন দেশের সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা যদি অধিক হয় এবং এর ফলে দেশের আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয় তখন তাকে জনসংখ্যা স্ফীতি বলা হয়।
তাই জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি যে উদ্যোগ রয়েছে সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং জনসংখ্যা সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
জনসংখ্যা সমস্যার বা জনসংখ্যা স্ফীতির কারণ
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান প্রধান কারণ নিম্নে আলোচনা করা হলো,
১. ভৌগোলিক কারণ
ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ মৌসুমি অঞ্চলে অবস্থিত। ফলে এদেশের আবহাওয়ায় অল্প বয়সেই ছেলেমেয়ে যৌবনপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাও অনেক বেশি।
২. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ
বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের প্রচলন রয়েছে। অল্প বয়সে বিয়ে দিলে সাধারণত সে সন্তান ধারণ করবে। এভাবে বাল্য ও বহুবিবাহের ফলে পরিবার পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে জনসংখ্যাবৃদ্ধি পেতে থাকে ।
৩. অজ্ঞতা, অশিক্ষা ও অসচেতনতা
বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণই অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও অসচেতন। ফলে এসব জনগণের মধ্যে কুপ্রথা ও কুসংস্কার অতিমাত্রায় বিরাজ করে। যার ফলে তারা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে না। এভাবে আমাদের দেশে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যাবৃদ্ধি পেতে থাকে।
৪. দেশে শিশু মৃত্যুর হার অধিক
বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে প্রায় ১৩৬ জন। এজন্য সন্তানদের মৃত্যু আশঙ্কায় পিতামাতা দু’ একটি সন্তান নিয়ে ভরসা পায় না। ফলে অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে লালনপালন করতে আগ্রহী হয়।
৫. বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তার আশা
আমাদের দেশে বৃদ্ধদের জন্য কোন সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। যার ফলে পিতামাতারা বৃদ্ধকালে সন্তানসন্ততির উপর নির্ভর করতে চায়। এভাবে বৃদ্ধকালীন নিরাপত্তার অভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অধিক সন্তান, বিশেষ করে পুত্রসন্তান লাভের আশা কারে থাকে। এভাবে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যাবৃদ্ধি পেতে থাকে।
৬. নিম্ন জীবনমান
বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯০ জন জনগণ অত্যন্ত নিম্নমানের জীবনযাপন করে। শতকরা ৮০ জন লোক দারিদ্র্যসীমার নীচে অবস্থান করে। এসব জনগণের জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। স্বভাবতই এসব দরিদ্র লোকের সন্তান প্রতিপালনের ব্যয় অত্যন্ত কম। তাই তারা অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে জনসংখ্যা সমস্যাকে তীব্রতর করে তোলে।
৭. কৃষিভিত্তিক সমাজ কাঠামো
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা প্রধানত কৃষিভিত্তিক। গ্রাম এলাকার শ্রমজীবী জনগণের শতকর ৮০ জন লোকই কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করে। অধিক্ সন্তান কৃষিকাজের জন্য খুবই সহায়ক। এজন্য গ্রামাঞ্চলে জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৮. শিক্ষার অভাব
বাংলাদেশে শিক্ষিতের হার শতকরা মাত্র ৩২.৪ ভাগ। ফলে এদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তারা নিরক্ষতার কারণে জনসংখ্যাবৃদ্ধির ভায়বহ পরিণাম সম্পর্কে মোটেও ধারণা করতে পারে না। ফলে বিরামহীনভাবে তারা অধিক সন্তান জন্মদান করে সমস্যা সৃষ্টি করে।
৯. অর্থনৈতিক কারণ
জনসংখ্যাবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণও ব্যাপকভবে দায়ী। বিশেষ করে পুত্রসন্তান অর্থনৈতিক আয়ের জন্য খুবই সহায়ক। কারণ তারা একটু বড় হলেই অর্থকড়ি উপার্জন করতে সক্ষম হয়। তাই লাভের জন্য অর্থনৈতিক কারণে অনেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে না।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে যে, জনসংখ্যা সমস্যা আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও বৃহত্তর জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কাজেই এ সমস্যা প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সমাধান অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।