১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইন কি । ব্যাখ্যা ও আলোচনা
১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইন কি
ইংল্যান্ডের দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ, সক্ষমদের কাজ করতে বাধ্য করা, কিংবা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে। এসব আইনের মধ্যে এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইন একটি।
ইংল্যান্ডের দারিদ্র্য দূরীকরণে সর্বপ্রথম ১৩৪৯ সালে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড কর্তৃক প্রণীত হয় দরিদ্র আইন ‘Statute of Labourers‘. ১৫৩১ সালে রাজা অষ্টম হেনরি একটি আইন প্রণয়ন করে বৃদ্ধ, অক্ষম ও বিকলাঙ্গদের ভিক্ষা করার জন্য রেজিস্টেশন ও লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করেন। রাজা অষ্টম হেনরি কর্তৃক প্রণীত ১৫৩৬ সালের আইনে ব্যক্তিগত ভিক্ষাদান নিষিদ্ধ করা হয় এবং ভিক্ষাদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের দান প্রতি রোববার গির্জায় গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া আরও অনেকগুলো আইন প্রণীত হয়। ১৫৬২ সালের Statute of artificers আইন, ১৫৬৩ সালের আইন, ১৫৭২ সালে রানী প্রথম এলিজাবেথ কর্তৃক প্রণীত আইন, ১৫৭৩ সালের House of correction এবং ১৫৯৭ সালে ‘Alms house’ স্থাপন করা হয়। কিন্তু এসব আইন এবং পদক্ষেপের ক্রমাগত ব্যর্থতা এবং পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথ ১৬০১ সালের পূর্বে প্রণীত আইনসমূহ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে এক নতুন আইন প্রবর্তন করেন। উক্ত আইনই ইতিহাস খ্যাত। ‘এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইন ১৬০১’ নামে সুপরিচিত। ইংল্যান্ডের দরিদ্রদের সহায়তা দানের প্রচেষ্টা হিসেবে এটি ৪৩তম প্রয়াস বিধায় একে ৪৩তম এলিজাবেথ বলে অভিহিত করা হয়।
১৬০১ সালের এলিজাবেথীয় দরিদ্র আইনের বৈশিষ্ট্য
১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ
১. ১৬০১ সালের দরিদ্র আইন ১৩৪৯ থেকে ১৫৯৭ সাল পর্যন্ত প্রণীত আইনের একটি সমন্বিত রূপ।
২. এ আইনের মাধ্যমে সক্ষম দরিদ্রদের সংশোধনাগার ও দরিদ্রাগারে কাজ করতে বাধ্য করা হয়।
৩. এ আইনের মাধ্যমে সচ্ছল আত্মীয়স্বজনসম্পন্ন দরিদ্রদের সাহায্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
৪. পারিবারিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম ব্যক্তিদেরকে বাধ্য করা হয়। পরিবারের নির্ভরশীল সদস্য, দুস্থ ব্যক্তি, পিতামাতা এবং দাদা-দাদির প্রতি সক্ষম সদস্যদেরকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা হয়।
৫. অক্ষম ও অসচ্ছল পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব স্থানীয় প্যারিস কিংবা স্থানীয় এলাকার লোকজনের উপর অর্পণ করা হয়।
৬. এ আইনে যেসব দরিদ্রদের থাকার ব্যবস্থা আছে তাদের জন্য বহিঃসাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়।
৭. এ আইনে যারা সাহায্য পেতে ইচ্ছুক তাদের কাছ থেকে আবেদনপত্র গ্রহণ করা হয়।
৮. আইন বাস্তবায়নের জন্য বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ওভারসিয়ার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়।
৯. সাহায্যার্থীর যোগ্যতা হিসেবে প্যারিসের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া কিংবা কমপক্ষে প্যারিসে ৩ বছর বসবাস করার শর্ত আরোপ করা হয়।
১০. এ আইনে দরিদ্রদেরকে সক্ষম দরিদ্র, অক্ষম দরিদ্র ও নির্ভরশীল বালক বালিকা এ তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়।
১১. এ আইনের অধীনে দরিদ্রদের পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য বিভিন্ন ধরনের করারোপের ব্যবস্থা করা হয়।
১২. এ আইনের অধীনে যেসব নাগরিক নির্ভরশীল ছেলেমেয়ের দায়িত্ব নিত তাদের কাছে ছেলে হলে ২৪ বছর ও মেয়ে হলে ২১ বছর বয়সপূর্তি পর্যন্ত গৃহভৃত্য বা গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করতে বাধ্য থাকত।
১৩. এ আইনে আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে জরিমানার ব্যবস্থা ছিল।
১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের সবল দিক
নিম্নে এ আইনের সবল দিকগুলো মূল্যায়ন করা হলো,
১. আর্থসামাজিক ফলপ্রসূতা : ১৬০১ সালের দরিদ্র আইন প্রণয়নের ফলে ইংল্যান্ডের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। যেমন-ব্যাপক হারে ভিক্ষাবৃত্তি ও ভবঘুরেপনা রোধ করা সম্ভব হয়, দরিদ্রদেরকে চরম অসহায়ত্ব থেকে বাঁচানো সম্ভব হয় ও সামাজিক দায়িত্ব বৃদ্ধি পায়।
২. সমাজকর্মের উদ্ভবের ভিত্তি : সমাজকর্মের ভিত্তিভূমি রচনা করতেও এ আইনের একটা ভূমিকা রয়েছে। আধুনিক সমাজকল্যাণ ও সমাজকর্ম ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের কাছে ঋণী।
৩. সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রতকরণ : ১৬০১ সালের দরিদ্র আইন সচ্ছল আত্মীয়জনকে অসচ্ছল আত্মীয়জনের প্রতি, পিতামাতাকে সন্তানের প্রতি, সন্তানকে পিতামাতার প্রতি একটা দায়িত্ববোধের চেতনা জাগ্রতকরণে সহায়তা করে।
৪. সরকারি দায়িত্ব : এ আইনের মাধ্যমে সরকার অক্ষম দরিদ্র ও নির্ভরশীল ছেলেমেয়েদের প্রতি দায়িত্ববোধকে স্বীকার করে নেয় এবং সরকার এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের দুর্বল দিক
১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের দুর্বল দিক এর সবল দিকগুলো তুলে ধরা হলো,
১. এ আইনে দরিদ্রদের অনেকটাই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়।
২. এ আইনের অধীনে নির্ভরশীল ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার কোন ব্যবস্থা ছিল না।
৩. এ আইন ছিল দুঃস্থ পুনর্বাসনমূলক। কিন্তু দুঃস্থতা প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা ছিল না।
৪. এ আইন বাস্তবায়নে জনসাধারণের উপর যে করারোপের ব্যবস্থা করা হয় তা অনেকের কাছেই ছিল বোঝাস্বরূপ।
৫. নির্ভরশীল ছেলেমেয়েদের এ আইনের অধীনে তাদের মনিবের অধীনে যে নির্দিষ্ট সময় কাজ করতে বাধ্য করা হতো তা ছিল অনেকটা দাসপ্রথার শামিল। অনেকে একে দাসপ্রথার সাথেই তুলনা করেন।
৬. এ আইনের বাস্তবায়নকল্পে অব্যবহৃত ও পুরাতন ভবনগুলোকে দরিদ্রাগার (Almshouse) ও শ্রমাগার (Workhouse) হিসেবে ব্যবহার করে সেখানে দরিদ্রদের রাখা হয়। এসব ভবনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দরিদ্রদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।
৭. শ্রমাগারের দরিদ্রদের জন্য ওভারসিয়ার কর্তৃক নিযুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সেখানে অবস্থানরত দরিদ্রদের জোরপূর্বক কঠোর কাজ করাত। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সাথে কয়েদিদের মত আচরণ করা হতো।
৮. দরিদ্রদের সাহায্যার্থে আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টিত ছিল না। এতে সরকারি সাহায্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নানাধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়।
৯. দরিদ্রদের সাহায্যার্থে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল।
আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এ আইনে দারিদ্র্য বিমোচনমূলক কোন স্থায়ী কর্মসূচি ছিল না। দারিদ্র্যের কারণ অনুসন্ধান করে তা নিরসনের জন্য কোন গবেষণামূলক ব্যবস্থাও এ আইনের অধীনে রাখা হয় নি। এ সীমাবদ্ধতার কারণেই ১৮৩৪ সালে এ আইনটি সংশোধন করে নতুন একটি আইন প্রণীত হয়।