বদর যুদ্ধের ফলাফল | বদর যুদ্ধের ১০টি ফলাফল নিয়ে বিশদ আলোচনা
যে কুরাইশদের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণের জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.) মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করলেন, মদিনায় এসেও সেই কুরাইশদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেলেন না। কুরাইশরা পৌত্তলিকদের সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলমানদের উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বে নওমুসলিমগণও কঠোর মনোবল নিয়ে পৌত্তলিকদের প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। ফলে মদিনার অদূরে বদর নামক স্থানে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের স্থানের নামানুসারে এ যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে ‘বদরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে সংঘটিত বড়ো বড়ো যুদ্ধ অপেক্ষা এ যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এ যুদ্ধ মুসলমানদের জীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ যুদ্ধের গুরুত্ব সম্পর্কে পি. কে. হিট্টি বলেছেন, “The battle of Badr laid the foundation of Muhammad temporal power Islam had won its first and decisive military victory.”
বদর যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব
বদর প্রান্তরে মুসলমানদের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম তথা বিশ্বের ইতিহাসে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়। বিশ্বের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের অন্যতম।
১. আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
বিশাল কুরাইশ বাহিনী স্বল্পসংখ্যক মুসলিম সৈন্যদের নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে হযরতকে হত্যা এবং ইসলামকে পৃথিবীর বুক হতে ধ্বংস করার দুরাশা চিরতরে ব্যর্থ হয়। অপরদিকে, সামান্য সংখ্যক মুসলমান সহস্রাধিক কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়। মুসলমানদের মনোবল, শক্তি, সাহস, উদ্দীপনা ও আল্লাহর উপর গভীর বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। এ যুদ্ধে জয়লাভ করায় জীবিত অবস্থায় গাজি ও যুদ্ধে শহিদ হওয়ার প্রেরণা এবং পারলৌকিক পুরস্কার লাভের বাসনা তাদের পরবর্তী বিজয়গুলোকে প্রভাবান্বিত করে।
২. অস্তিত্ব রক্ষা
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য এক চরম অগ্নিপরীক্ষা। এটা সকল সময়ের জন্য ইসলামের ভাগ্য নির্ধারণ করেছিল । যুদ্ধে পরাজয় মানে ইসলামের কবর রচনা। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও মাত্র ৩১৩ জন যোদ্ধা জীবনমরণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে মানুষের ভাগ্যে এরূপ গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে R. A. Nicholson বলেছেন, “Badr, like marathon is one of the greatest and most memorable battles in all history.”
৩. ইসলামের স্থায়িত্ব
বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ যুদ্ধে ইসলাম ও পৌত্তলিকতার চরম পরীক্ষা হয়ে যায়। অসত্যের উপর সত্যের জয় হয়। ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম আল্লাহর মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। একে ধ্বংস করা মানুষের সাধ্যের বাইরে।
৪. শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ
ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেছেন, “বদরের যুদ্ধে জয়লাভ ইসলামের প্রথম সামরিক বিজয়। আমরা নিবিষ্টচিত্তে এটা অনুধাবন করেছি। কারণ এটা স্বজাতি দেশবাসীর উপর মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।” এটা অবিসংবাদিত সত্য যে, বদরের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগসন্ধিক্ষণকারী ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধ ছিল প্রকৃতপক্ষে সত্যের সাথে মিথ্যার, অজ্ঞানতার উপর জ্ঞানের এবং মিথ্যার উপর সত্যের জয়, যা অবশ্যম্ভাবী বদর যুদ্ধে প্রমাণিত হয়।
৫. আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস
মুসলমানরা যে দুর্বল নয় বদরের যুদ্ধ আরব জাহানে সে সত্যই প্রমাণ করেছে। মুসলমানগণ নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে আল্লাহ সর্বদাই তাঁর বান্দার শক্তিকে বৃদ্ধি করেন। বিধর্মীরা হযরতের ঐশ্বরিক ক্ষমতায় আকৃষ্ট হয় এবং মুসলমানগণ বদরের বিজয়কে আল্লাহর প্রতিশ্রুতির পুরস্কারস্বরূপ গ্রহণ করে তাওহিদে ও নবুয়তে অটল থাকে। পি. কে. হিট্টি বলেছেন, Islam recovered and passed on gradually from the defensive to the offensive. অর্থাৎ, ইসলাম পুনরুজ্জীবন লাভ করল, আত্মরক্ষার পরিবর্তে আক্রমণাত্মক নীতি অবলম্বন করল।
৬. ইসলাম প্রচার ও প্রসার
বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় ইসলাম প্রচারে নবযুগের সূচনা করে। ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেছেন, “ইসলাম ধর্মের প্রতি আরব বিশ্ব এমনকি পৃথিবীর মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ফলে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে আরব উপদ্বীপে ইসলাম সম্প্রসারিত হয়। প্রকাশ্যে ধর্ম প্রচার ও আচার-অনুষ্ঠান পালন, রাষ্ট্রীয়কার্য তত্ত্বাবধান, যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনা, দূত প্রেরণ দ্বারা বহির্বিশ্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠা এবং সমরাভিযান দ্বারা ইসলামি রাষ্ট্রের
সম্প্রসারণ নীতিতে বিধর্মীদের ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।
৭. ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মুখোশ উন্মোচন
বদর যুদ্ধে বিজয় ছিল ইসলামের অপরাজেয় শক্তির পরিচায়ক। এর ফলে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা ইসলামের অসীম ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণ করতে সাময়িকভাবে ক্ষান্ত হয়।
৮. মহানবীর মর্যাদা বৃদ্ধি
যুদ্ধক্ষেত্র হতে বিজয়ীর বেশে রসুল (সা.) মদিনায় ফিরে পরাক্রমশালী যোদ্ধা, সুদক্ষ সমরনায়ক ও সুবিবেচক শাসকের পূর্ণ মর্যাদা লাভ করেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) যে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক শক্তিতেই বিকশিত নন, পার্থিব ঘটনাবলির বিচারে তিনি একজন যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা, এ যুদ্ধে তাই প্রমাণিত হয়। হিটির মতে, “বদরের যুদ্ধ সামরিক অভিযানের দিক থেকে তুচ্ছ হলেও এটি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পার্থিব শক্তির ভিত্তিস্থাপন করল। ইসলাম তার প্রথম ও চূড়ান্ত সামরিক বিজয় লাভ করল।”
৯. মদিনা রাষ্ট্রের ভিত প্রতিষ্ঠা
বদরের যুদ্ধ ইসলামকে মদিনা প্রজাতন্ত্রের ধর্ম হতে একটি সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রের ধর্মে উন্নীত করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং একে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করে।
১০. সৈন্যদের খেতাব লাভ
এ যুদ্ধে রসুল (সা.) এর শক্তি, সম্মান যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি যুদ্ধে যোগদানকারী ৩১৩ জন বীরসেনানী মহানবীর শ্রেষ্ঠ সাহাবি হওয়ার মর্যাদা লাভ করেন এবং তাদের ‘বদরি সাহাবি’ খেতাব দেওয়া হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, বদরের যুদ্ধ ছোটো যুদ্ধ হলেও ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এ যুদ্ধে জয়লাভ না করলে ইসলাম ধর্ম হয়ত পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত না। বদরের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে মুসলমানগণ একটি জাতি এবং ইসলাম একটি ধর্ম হিসেবে আরব উপদ্বীপ তথা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রয়াস পায়। এটা ইসলামের মাইলফলক। এখান থেকেই মুসলমানদের বিশ্ব জয়ের সূত্রপাত। এ বিজয় পরবর্তীতে দিয়েছে শক্তি ও সাহস, উজ্জীবিত করেছে বিপর্যয়ে ও সংঘাতে। বদরের অনুপ্রেরণা আজও শেষ হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এ যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলমানরা শত্রুবাহিনীর পরিত্যক্ত প্রচুর দ্রব্যসামগ্রী লাভ করে। একটি উদ্ধান্ত জাতির জন্য এর প্রয়োজনীয়তা ছিল তখন অপরিসীম। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি মুসলমানরা যে উদারনীতি ব্যবহার করে তা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।