পানি চক্র কী, কাকে বলে এবং পানি চক্র কীভাবে সংঘটিত হয়
পানি চক্র কী
পানির বিভিন্ন উৎপত্তিস্থল থেকে পানি নানাভাবে রূপান্তরিত হয়ে আবার মূল উৎসে ফিরে এলে তাকে পানি চক্র বলে। পৃথিবীর যাবতীয় পানি অর্থাৎ সমুদ্র, বায়ুমণ্ডল ও ভূপৃষ্ঠের পানি সর্বদা একটি পরস্পর সম্পর্কিত জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার ভৌত ও ভৌগোলিক অবস্থানের পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকে।
পানি চক্র কাকে বলে
পৃথিবী পৃষ্ঠ প্রধানত পানির সমন্বয়ে গঠিত। যার অংশ পানি দ্বারা আবৃত। পানিই একমাত্র প্রাকৃতিক উপাদান যা বিভিন্ন তাপমাত্রাভেদে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে। সঞ্চিত পানির পরিমাণ হচ্ছে সমুদ্রে- ৯৭.২%, হিমবাহ ও মহাদেশীয় হিমবাহে- ২.১৫%, ভূগর্ভস্থ পানি- ০.৬২%, ভূপৃষ্ঠস্থ পানি ০.০৩%। ভূপৃষ্ঠের এ অতি সামান্য শতাংশ পানি আবার হ্রদ, নদী, জলাশয় ও বায়ুমণ্ডলে বিন্যস্ত রয়েছে। যা পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনধারণের সহায়তা করে থাকে। এ পানি চক্রাকারে পরিবর্তিত হয়েই পানি সমুদ্র হতে বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে, বায়ুমণ্ডল হতে বৃষ্টিরূপে ভূপৃষ্ঠে এবং পরিশেষে নদীরূপে সমুদ্রে পতিত হয়, পানির এ চক্রকে পানি চক্র (Hydrologic cycle) বলে।
পানি বিজ্ঞানী R.K. Linsley এর মতে, “The hydrological cycle is descriptive term applied to the general circulation to the water from the seas to the atmosphere, to the ground and break to the seas again.” অর্থাৎ, পানি চক্র এমন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা সমুদ্র হতে বায়ুমণ্ডলে এবং বায়ুমণ্ডল হতে পুনরায় সমুদ্রে ফিরে যায়।”
পানি চক্র সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়াসমূহ
কিছু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়েকটি উপাদান পানি চক্র কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। উপাদানগুলো হচ্ছে,
- ১. বারিপাত
- ২. অভিগ্রহণ
- ৩. অনুপ্রবেশ
- ৪. পরিস্রবণ
- ৫. আন্ত:প্রবাহ
- ৬. ভূপৃষ্ঠস্থ রান অফ
- ৭. ভূগর্ভস্থ পানি
- ৮. বাষ্পীয়ভবন ও প্রস্বেদন
- ৯. ভূগর্ভস্থ প্রবাহ
- ১০. নদী প্রবাহ
পানি চক্র সংঘটিত হওয়ার প্রক্রিয়াসমূহ |
নিম্নে এ সমস্ত উপাদান ও প্রক্রিয়াসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো :
১. বারিপাত
জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ু আবহাওয়াজনিত কারণে ঘনীভূত হয়ে মেঘ, শিশির, কুয়াশা, তুষার প্রভৃতিতে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে এগুলো অনুকূল পরিবেশে বৃষ্টিপাতসহ বিভিন্নরূপে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। একেই সামগ্রিকভাবে বারিপাত (Precititation) বলে।
২. অভিগ্রহণ
বৃষ্টিপাতের পানি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছার পূর্বে উদ্ভিদ ও মৃত্তিকার অন্যান্য আচ্ছাদন দ্বারা বাঁধা পাওয়াকে অভিগ্রহণ (Interception) বলে। বাধাপ্রাপ্তির ফলে বৃষ্টিপাতের পানির সেই অংশ সঞ্চিত হলো যা বাষ্পীয়ভবনের পূর্ব পর্যন্ত উদ্ভিদ বা মৃত্তিকার আচ্ছাদনের ওপর থেকে যায়।
৩. অনুপ্রবেশ
বৃষ্টির পানি মাটিতে প্রবেশ করাকে অনুপ্রবেশ বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় মৃত্তিকার স্তর হালকা বা মাঝারি বৃষ্টিপাত হতে পানি শোষণ করতে পারে। কেননা মৃত্তিকার কণাসমূহের দুর্বল সংযুক্তির ফলে বেশিরভাগ মৃত্তিকার মধ্যে স্বাভাবিক প্রবেশ পথ থাকে। এছাড়াও মৃত্তিকা স্তরের মধ্যে ফাটল, কীটপতঙ্গ সৃষ্ট ফাটল বা উদ্ভিদের শিকড় দ্বারা সৃষ্ট ফাটল দিয়েও পানি চুঁইয়ে মৃত্তিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এভাবে বৃষ্টির পাণি চুঁইয়ে মাটিতে প্রবেশ করাকে অনুপ্রবেশ (Infiltration) বলে।
৪. পরিস্রবণ
যখন মৃত্তিকাস্থিত পানির ওপর চাপ থাকে তখন মাধ্যাকর্ষণের ফলে মৃত্তিকার পানি ভূগর্ভস্থ শিলান্তরে পৌছে এবং শিলাস্তরকে সমযুক্ত করে, এরূপ প্রক্রিয়াকে পরিস্রবণ (Precolation) বলে। পরিস্রবণের মাত্রা ভূপৃষ্ঠের গভীরতার সাথে হ্রাস পায়। সাধারণত ভূগর্ভের ওপরের স্তরে পরিস্রবণ সর্বাপেক্ষা বেশি হয়ে থাকে।
৫. আন্ত:প্রবাহ
আন্ত:প্রবাহ এক প্রকার পরিষবণ। ভূঅভ্যন্তরে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করার পর তা যদি কোনো অপ্রবেশ্য শিলাস্তরে বাধা পায় সে ক্ষেত্রে ভূ-অভ্যন্তরে পানি আর প্রবেশ করতে পারে না। এ কারণে অধিকাংশ পানি ঐ স্তরে সঞ্চিত হয়। অতঃপর ঐ পানি আনুভূমিকভাবে প্রবাহিত হয়ে দূরবর্তী কোনো ঢালু নিচু ভূমি বা নদীর সাথে মিষে যায়।
৬. ভূপৃষ্ঠস্থ রান অফ
বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মৃত্তিকার অনুপ্রবেশ শতার চেয়ে বেশি হলে অতিরিক্ত পানি ভূমির ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যেতে পারে। ভূমির উপরিভাগে বা উপরিতলের এ পড়ানো পানিকে ভূপৃষ্ঠস্থ রান অফ (Surface run-off) বলে।
৭. ভূগর্ভস্থ প্রবাহ
পানি পরিস্রবণের ফলে সাধারণত ভূগর্ভে পানি প্রবেশ করে এবং ভূগর্ভের অপ্রবেশ্য শিলার ওপর সঞ্চিত হতে থাকে। এরূপ সজ্জিত পানিকে ভূগর্ভস্থ পানি বলে। যে স্তরে এ পানি থাকে সে স্তরের শিক্ষা রপ্ত পানি দ্বারা সম্পৃক্ত থাকে। ভূগর্ভস্থ এ স্তরকে Ground water belt বলে। Soil water belt 5 Ground water belt এর মধ্যবর্তী স্তরকে Intermediate belt বলে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উপরিতলকে Ground water level বলে। ক্ষেত্র বিশেষ এ Ground water level এর একাধিক স্তর থাকতে পারে। সর্ব উপরের স্তরকে Upper ground water level বা ভূগর্ভস্থ পানির ঊর্ধ্বসীমা বলে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ পানির ঊর্ধ্বসীমা উঠানামা করে। বর্ষাকালে এটি ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে এবং গ্রীষ্মকালে নিচে নেমে যায়।
৮. বাষ্পীয়ভবন ও প্রস্বেদন
বৃষ্টি মৌসুমের মধ্যবর্তী সময়ে মৃত্তিকাস্থিত পানি দু’প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে যায়। যথা:
ক. এ প্রক্রিয়ায় সরাসরি মৃত্তিকা হতে পানির বাষ্পীভবন ঘটে এবং ক্রমাগত মৃত্তিকা স্তরের অভ্যন্তরের দিকে অগ্রসর হয়। এক্ষেত্রে বাতাস খুব সহজে মৃত্তিকার কণাসমূহের ফাঁকে ঢুকতে পারে এবং বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ফলে ক্রমাগত মৃত্তিকাঙ্খিত পানি জলীয়বাষ্পরূপে বায়ুমণ্ডলের দিকে অগ্রসর হয়। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে মৃত্তিকা স্তরের প্রথম ১ ফুট পর্যন্ত বাষ্পীভবনের ফলে শুকিয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী খরা মৌসুমে শুষ্ক স্তরের গভীরতা কয়েক ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে।
থ. মৃত্তিকা শুষ্ক হওয়ার দ্বিতীয় প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ অগণিত শিকড়ের দ্বারা খাদ্য তৈরি করার সময় মৃত্তিকা থেকে পানি টেনে নেয়। এ পানি উদ্ভিদের কাণ্ড ও ডাল বেয়ে পাতায় পৌঁছে এবং অবশেষে পত্ররন্থ দিয়ে জলীয়বাষ্পরূপে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। এ প্রক্রিয়াকে প্রস্বেদন (transpiration) বলে। জলবায়ু বিজ্ঞান ও পানির বিজ্ঞানে সরাসরি বাষ্পীভবন ও উদ্ভিদের প্রস্বেদন এ দুর্যৌথ প্রক্রিয়াকে একত্রে Evapotranspiration বলা হয়।
৯. ভূগর্ভস্থ প্রবাহ
ভূপৃষ্ঠের গভীরতম অংশ দিয়ে প্রবাহমান পানিরাশিকে ভূগর্ভস্থ প্রবাহ বলে। পরিস্রবণ ও অনুপ্রবেশ প্রক্রিয়ার ফলে মৃত্তিকা স্তরের অতিরিক্ত পানি ভূগর্ভের পানির স্তরে পৌঁছে এবং সেখানকার শিলাস্তরকে পরিপূর্ণরূপে সম্পৃক্ত করার পর শিলান্তরের গভীরতম ছিদ্রপথ অনুসরণ করে চলে। এ পানিরাশি ভূপৃষ্ঠের নিচু অংশ হতে নদীর তলদেশে পৌঁছে এবং নদীর পানিরূপে পুনরায় ভূপৃষ্ঠে বের হয়ে আসে।
১০. নদী প্রবাহ
ভূগর্ভের অতিরিক্ত পানি নদী প্রবাহরূপে ভূগর্ভ থেকে নির্গত হয়ে যায়। নদী সাধারণত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে পানি পেয়ে থাকে। কিন্তু সব নদী সারাবছর প্রবাহিত হয় না। কিছু কিছু নদী শুধু বর্ষা মৌসুমে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে, সারাবছর ধরে প্রবাহমান নদীর পানির উৎস হচ্ছে আন্ত:প্রবাহ এবং ভূগর্ভস্থ পানির নিঃসরণ। উপরিউক্ত ১০টি উপাদান ছাড়াও আরও দুটি উপাদান Hydrological cycle এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ দু’টি হচ্ছে,
- ১. ঘনীভবন (Condensation)
- ২. শোষণ (Absorption)