বিশ্বব্যাংক কী | বিশ্বব্যাংকের আবির্ভাব, কার্যাবলী, মূলধন তহবিল, ঋণদান কর্মসূচি
বিশ্বব্যাংকের আবির্ভাব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোতে দেখা দেয় মহামন্দা। বিশেষ করে ত্রিশ দশকের মহামন্দার ফলে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতি নড়বড়ে হয়ে যায়। এসময়ে যুদ্ধের ফলে নানা দেশের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি লক্ষ করা যায়। এরকম দুর্বিষহ অবস্থার পরিণতিতে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হুমকির মুখে পড়ে। ইউরোপ আমেরিকাসহ উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য একটি শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা বিশ্ব উপলব্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমন্ত্রণে ১৯৪৪ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪০০ জন প্রতিনিধি এক সভায় যোগ দিয়ে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠায় একমত পোষণ করে। আর এরই মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের আবির্ভাব ঘটে।
বিশ্বব্যাংক কি
বিশ্বকে মহামন্দার হাত থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালের ১ জুলাই হতে ২২ জুলাই তারিখ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘New Hampshire’ ব্রেটন উডস নামক স্থানের মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে যুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার গঠন কল্পে আয়োজিত এক সম্মেলন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪০০ জন প্রতিনিধি যোগদান করেন। এ সম্মেলন ইতিহাসে ব্রেটন উডস সম্মেলন নামে পরিচিতি লাভ করে। ব্রেটন উডস সম্মেলনের সিদ্ধান্তক্রমে ১৯৪৫ সালে International Bank for Reconstruction and Development.’ যার অফিসিয়াল নাম World Bank বা বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার সঠিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যেই এ ব্যাংক গঠিত হয়।
বিশ্বব্যাংকের কার্যাবলী
১৯৪৫ সালের বিশ্বব্যাংক গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয়ান দেশসমূহের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সহায়তা করা। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক শুধু ইউরোপকেন্দ্রিক না থেকে নতুন যাত্রা শুরু করে। যার আওতায় বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ সংস্থা মনোনিবেশ করে। বিশ্বের প্রধান প্রধান যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বিশ্বের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে তার মধ্যে বিশ্বব্যাংক অন্যতম। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক যে অবদান রাখছে তা বলাই বাহুল্য। এছাড়াও আশার বাণী হলো সাম্প্রতিককালে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। নিম্নে বিশ্বব্যাংকের প্রধান প্রধান কাজগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলো।
বিশ্বব্যাংকের কার্যাবলি বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। এর ফলে সমস্ত বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম প্রসারের জন্য বিশ্বব্যাংক নিম্নোক্ত তিনটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে :
- 1. The International Development Association or IDA.
- 2. The International Finance Corporation or IFC and
- 3. The Multinational Investment Gaurantee Agency or MIGA.
বিশ্বব্যাংক উপরিউক্ত সংস্থাসহ নির্বাহী পরিচালক পরিষদের সহায়তায় যেসব কার্যাবলি সম্পন্ন করে থাকে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১. বিশ্বব্যাংকের প্রধান কাজ হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করা।
২. বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশগুলোর যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবকাঠামোর পুনঃনির্মাণে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
৩. অনুন্নত দেশগুলোকে সহায়তা প্রদান করা যাতে এসব দেশ তাদের কাম্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে।
৪. উন্নয়নশীল দেশসমূহকে আর্থিক ও পরামর্শ প্রদান করা যাতে তাদের উন্নয়নশীল কর্মকাণ্ড বজায় রাখতে পারে।
৫. উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর দারিদ্র্য দূর করে যাতে টেকসই উন্নয়নের পথে চলতে পারে তার জন্য সাহায্য সহযোগিতা করা।
৬. বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশসমূহের উন্নয়নকে আরও গতিশীল করার জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধিকল্পে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করা।
৭. অধিভুক্ত সংস্থাসমূহের মাধ্যমে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে স্বল্প সুদে বা বিনা সুদে ঋণদান করা।
৮. বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশগুলোর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে International Finance Corporation (IFC) এর মাধ্যমে ঋণদান করা।
৯. স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে উন্নত দেশসমূহে যে বিনিয়োগ করে The Multinational Investment Guarantee Agency (MIGA) এর মাধ্যমে তার নিরাপত্তা প্রদান করা।
১০. বিশ্বব্যাংক ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত করে Ingternational Center for Settlement of Investment Dispute (ICSID) এর মাধ্যমে দেশীয় সরকার ও বৈদেশিক বিনিয়োগকর্ত্রীদের মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা ও নিষ্পত্তিতে সহায়তা করা।
১১. বিশ্বব্যাংক সদস্য দেশের উৎপাদনশীল কাজকর্মে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় ঋণদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১২. সদস্য দেশগুলোর উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উপদেশ, পরামর্শ ও বিভিন্ন কারিগরি সহায়তা প্রদান করা এবং উন্নয়নশীল দেশসমুহের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করা।
বিশ্বব্যাংকের মূলধন তহবিল
বিশ্বব্যাংকের মূলধনের প্রধান উৎস হলো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর চাঁদা। ১৯৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাংকের ১৭৬টি সদস্য রাষ্ট্র ব্যাংকের মূলধন বাবদ ১৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বিশ্বব্যাংক মূলধন সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভার আরোপিত ভোট দান পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। যার মাধ্যমে ব্যাংকের সদস্য দেশসমূহের অর্থনৈতিক শক্তি এবং মূলধন যোগানে তাদের অবদানের প্রতিফলন ঘটে। নিম্নে ছকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সর্বোচ্চ ভোট দানকারী ৫টি দেশের নাম উল্লেখ করা হলো।
দেশের নাম (ভোটের পরিমাণ)
- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (১৭%)
- জাপান (৭%) ,
- জার্মানি (৫%)
- যুক্তরাজ্য (৫%)
- কানাডা (৩%)
মোট দেশ : ৫টি
মোট : ৩৭%
অর্থনৈতিক ক্ষমতার উত্থানপতন এবং নতুন সদস্য রাষ্ট্রের আগমনে সময়ে সময়ে আলোচ্য ভোটের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যায়। বিশ্বব্যাংক তার স্বাভাবিক ঋণদান কর্মসূচি চালানোর জন্য প্রয়োজনে নিজ নামে আন্তর্জাতিক মূলধন বাজার থেকে অর্থ ঋণ নিয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন খাতে প্রদেয় ঋণ থেকে প্রাপ্ত সুদ ও বিশ্বব্যাংকের তহবিলের অন্যতম উৎস। বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ করে থাকে। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক সদস্য দেশগুলোতে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণদান কর্মসূচি
বিশ্বব্যাংক ঋণদানের ক্ষেত্রে অতি সাবধানতা অবলম্বন করে। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংক সেসব ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করে যেসব ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা অনেক বেশি। আর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে, যার উজ্জ্বল উদাহরণ হলো বাংলাদেশের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা বাতিল করা। বিশ্বব্যাংকের কঠিন শর্তসমূহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পক্ষে মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো উন্নত দেশগুলো খুব সহজেই পূরণ করতে পারে। তাই ঐসব দেশগুলো বিশ্বব্যাংক থেকে অতি সহজেই ঋণ পেয়ে থাকে। অর্থাৎ, উন্নত দেশগুলো থেকে অতি সহজেই ঋণের অর্থ ফেরত পাওয়া যায় বা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। যার ফলে বিশ্বব্যাংক উন্নত দেশে বেশি ঋণ প্রদান করে থাকে। তাই আমরা বলতে পারি, এ ব্যাংক অনুন্নত দেশের প্রয়োজনের চেয়ে উন্নত দেশগুলোর প্রয়োজনকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের সনদ অনুযায়ী দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে পারে এমন উৎপাদনশীল ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতে এ ব্যাংক ঋণ প্রদান করে। বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে কিংবা অন্য দেশ থেকে পণ্য বা সেবা ক্রয়ের জন্য ঋণ প্রদান থেকে বিশ্বব্যাংক বিরত থাকে। বিশ্বব্যাংক গঠনের প্রাথমিক অবস্থায় এ ব্যাংক শুধুমাত্র উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতায় ব্যস্ত থাকত। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এ ব্যাংক থেকে তেমন কোনো সুবিধা পেত না। যার ফলে সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের বেসরকারি খাত উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত সহযোগী সংগঠনসমূহ বিশ্বব্যাংক স্থাপন করে।
- International Development Association (IDA): অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে সহজেই ঋণপেতে পারে তার জন্য বিশ্বব্যাংক ১৯৬০ সালে IDA গঠন করে। IDA বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করে। মূলত যেসব দেশের মাথাপিছু আয় কম অর্থাৎ যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ৮০০ ডলারের ওপরে তাদেরকে ৭% সুদের হারে ১৫-২০ বছর মেয়াদি ঋণদান করে। আর যেসব দেশের মাথাপিছু আয় ৮০০ ডলারের নিচে তাদেরকে ০.৭৫ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে ৩০- ৪০ বছর মেয়াদি ঋণ প্রদান করে। এ ধরনের ঋণ অনেকটা সুদ মুক্ত ধরনের হয়ে থাকে।
- International Finance Corporation (IFC): বিশ্বব্যাংক ১৯৫৬ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেসরকারিখাতের উন্নয়নের জন্য IFC গঠন করে। IFC বিনিয়োগ ব্যাংকের মতো বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিশীল বাণিজ্যিক কাজকর্মে ঋণ ও ইক্যুইটি মূলধন প্রদান করে থাকে।
- Multinational Investment Guarante Agency (MIGA): অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিকঅস্থিতিশীলতাজনিত বিনিয়োগ ঝুঁকির কারণে উন্নত দেশের বিনিয়োগকারীদের অনীহা দূরীকরণে ১৯৮৮ সালে বিশ্বব্যাংক MIGA প্রতিষ্ঠা করে। MIGA বিনিয়োগ ঝুঁকি হ্রাসকরণে বিমার ব্যবস্থা করে, যার ফলে উন্নয়নশীল দেশসমূহে বিনিয়োগ বাধা দূর হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিশ্বব্যাংক তার ঋণ নীতিতে উন্নত দেশের ক্ষেত্রে এক রকম এবং অনুন্নত দেশগুলোর জন্য অন্য রকম পদ্ধতি গ্রহণ করে যে বৈষম্যের মাত্রা বৃদ্ধি করেছিল তা আজ একটু হলেও সমতার দিকে এগিয়েছে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশ্বব্যাংক তার সঠিক ঋণ নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নত দেশসমূহকে একই কাতারে নিয়ে আসতে পারবে বলে আশা করা যায়।