ব্যবস্থাপনার মূলনীতিগুলো কি কি | ব্যবস্থাপনার ১৪টি নীতিমালা

নীতি হচ্ছে সুনির্ধারিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত আইন বা নিয়ম, যার উপর নির্ভর করে যথাযথ কর্মসূচি ও কর্মপন্থা প্রণয়ন করা হয়। ব্যবস্থাপনা পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা সবসময় প্রভাবিত হওয়ায় এ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার কোন বাঁধাধরা নিয়মনীতি নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নি। এ কারণে যুগে যুগে বিভিন্ন মনীষীগণ বিভিন্ন অবস্থাদি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে বিভিন্ন প্রকারের নীতিমালা নির্দিষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। তন্মধ্যে হেনরি ফেয়ল প্রদত্ত ১৪টি নীতিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। হেনরি ফেয়লের ১৪টি নীতিমালাই ব্যবস্থাপনার মূলনীতি হিসেবে মানা হয়। এ প্রসঙ্গে N. C, Roy Chowdhury বলেছেন, “Fayol’s principles of management still live bright star among the stars.”

ব্যবস্থাপনার ১৪ টি মূলনীতি বা নীতিমালা

নিম্নে ব্যবস্থাপনার নীতিসমূহ আলোচনা করা হল।

১. কার্যবিভাগ (Division of work)

কার্যবিভাগ ব্যবস্থাপনার একটি উল্লেখযোগ্য নীতি। এ নীতি অনুসারে একটি সংগঠনের বিভিন্ন কার্যের প্রকৃতি অনুযায়ী এদেরকে বিভাগ করে যোগ্যতানুসারে কর্মীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। ফলে দক্ষতা ও নিপুনতার সাথে শুধু কার্যসম্পাদনই হয় না, কর্মীদের কর্ম নিপুনতা এবং দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। এ প্রসঙ্গে Weihric and Koontz এর মতে, “দক্ষতার সাথে শ্রমিক ব্যবহার করে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করাকে কার্যবিভাগ বলে।” (Division of work is the specialization that economists consider necessary for efficiency in the use of labour.)

২. ক্ষমতা ও দায়িত্ব (Balancing authority and responsibility)

প্রতিষ্ঠানে যখন কোন অধস্তন নির্বাহি বা কর্মীকে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে তখন তা সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতাও তাকে প্রদান করতে হবে। অন্যথায় উক্ত নির্বাহি বা কর্মীর পক্ষে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না। এ প্রসঙ্গে Henri Fayol এর মতে, “Authority and responsibility to be related.” অর্থাৎ, দায়িত্বের সাথে ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের সম্পর্ক থাকতে হবে। সুতরাং কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মধ্যে সবসময় সমতা বা ভারসাম্য থাকা উচিত।

৩. নিয়মানুবর্তিতা (Discipline)

সংগঠনের নির্ধারিত নিয়মনীতির প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ এবং তা মেনে চলার প্রতি ঐকান্তিক আগ্রহ প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা অর্জনের জন্য অপরিহার্য। হেনরী ফেয়ল ব্যবস্থাপনার সকল স্তরে নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠার জন্য গতানুগতিক শান্তিদান নীতির পরিবর্তে উত্তম তত্ত্বাবধানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ প্রসঙ্গে Henri Fayol এর মতে, “Discipline requires good superiors at all levels.” অর্থাৎ, ভালো ব্যবস্থাপকের সকল পর্যায়ে নিয়মানুবর্তিতা প্রয়োজন।

৪. আদেশের ঐক্য (Unity of command)

 এ নীতির মূলকথা হল প্রত্যেক কর্মী একজন মাত্র Boss বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে আদেশ ও নির্দেশ প্রাপ্ত হবে। কারণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একাধিক হলে কর্মীর পক্ষে সকলের আদেশ অনুসরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং তাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে কর্মীর পক্ষে দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদন করা সম্ভব হবে না। তাই সুষ্ঠু ও দক্ষতার সাথে কার্যসম্পাদনের জন্য একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অধীনে, কর্মচারীদেরকে কাজে ন্যস্ত থাকতে হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে আদেশ দানের ঐক্য বজায় থাকবে।

৫. নির্দেশনার ঐক্য (Unity of direction)

এ নীতির অর্থ হল প্রতিষ্ঠানের সব বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির, সমবেত প্রচেষ্টাকে একটি মূল উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নিয়োজিত করতে হবে এবং সে উদ্দেশ্যকে ঠিক রেখে ধারাবাহিক সমন্বিত নির্দেশিকা কার্যক্রম চালাতে হবে। অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী আদেশ-নির্দেশ যেন জারি না হয় সে দিকে ব্যবস্থাপনা লক্ষ্য রাখবে।

৬. সাধারণ স্বার্থে নিজের স্বার্থ ত্যাগ (Sacrifice individuals interest to general interest)

 প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থকে সবসময় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া আবশ্যক। অন্যথায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য অর্জন ও সংশ্লিষ্ট সকলের সর্বোচ্চ কল্যাণ লাভ সম্ভব হবে না। তাই সাধারণ স্বার্থকে যে কোন অবস্থায় ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য প্রণয়ন করতে হবে। এ প্রসঙ্গে Bartol and Martin বলেছেন, “কোন একজন কর্মী বা একদল কর্মীর স্বার্থকে কখনই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বা লক্ষ্যের উপর স্থান দেওয়া উচিত নয়।”

৭. পারিশ্রমিকের নীতি (Law of remuneration)

হেনরী ফেয়ল পারিশ্রমিক সম্পর্কে বলেছেন, (ক) পারিশ্রমিক ন্যায্য হতে হবে এবং (খ) পারিশ্রমিক দানের যুক্তিসংগত পন্থা থাকতে হবে। তাই কর্মীদের কাজের প্রকৃতি, সময়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করে সুষ্ঠু ও ন্যায্য বেতন কাঠামো স্থির করতে হবে যাতে তারা সকলে সন্তুষ্টির সাথে কাজ করতে পারে।

৮. কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ (Centralization and decentralization)

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তবলি কেন্দ্রীভূত এবং নিম্নস্তরের কার্যাবলি বিকেন্দ্রীভূত থাকে। এ নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে যে, কেন্দ্রে কতখানি কর্তৃত্ব কেন্দ্রীভূত হবে এবং কতখানি কর্তৃত্ব অন্যান্য স্তরে বিকেন্দ্রীভূত হবে।

৯. সাম্যতা (Equity)

সবার প্রতি সমান আচরণ ও হে প্রদর্শন করা এ নীতির লক্ষ্য। কর্মীদের প্রতি দয়া প্রদর্শন, সুবিচার দান, সমান দৃষ্টিদান এবং সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যবস্থাপকগণ অনুগত্য, অনুরাগ ও শ্রদ্ধা লাভ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন অধস্তন সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস পায়। মোটকথা, কর্মীদের প্রতি ব্যবস্থাপনার আচরণ হতে হবে, আন্তরিক, বন্ধুসুলভ ও সাম্যভিত্তিক। তাদের সাথে কোন অবস্থাতেই বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।

১০. জোড়া মই শিকল নীতি (Scalar chain)

সংগঠনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত ব্যবস্থাপনার পর্যায়ভুক্ত লোকদের এমনভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত করতে হবে যাতে তা সমন্বিত শিকলের রূপ ধারণ করে। এ শিকল কর্তৃত্বের প্রবাহ ও যোগাযোগের পথ নির্দেশ করে। এ নীতির মূল কথা হল সংগঠনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে একেবারে নিম্নস্তর পর্যন্ত এমনভাবে নেমে আসবে যাতে একটা স্তরের সাথে অন্য স্তর সম্পর্ক যুক্ত হয়ে পড়ে। এটি একটি দ্বিমুখী যোগাযোগ প্রক্রিয়া। এ নীতিকে অনেকে স্তরবিন্যাসের নীতি হিসেবে অভিহিত করেছেন।

১১. শৃঙ্খলা (Order)

হেনরী ফোল শৃঙ্খলাকে দু’ভাগে ভাগ করছেন। যথা: মানব শৃঙ্খলা ও বস্তুগত শৃঙ্খলা। এ নীতির লক্ষ্য হচ্ছে, যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে এবং সঠিক বস্তুকে সঠিক স্থানে স্থাপন করা এবং প্রতিষ্ঠানে মানব শৃঙ্খলা ও বস্তুগত শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করা। এছাড়াও সকল ব্যক্তি ও বস্তুগত উপাদান যাতে সঠিক নিয়মে শৃঙ্খলার সাথে কার্যসম্পাদন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

১২. চাকরির স্থায়িত্ব (Stability of service)

আদর্শ ব্যবস্থাপনার অন্যতম নীতি হচ্ছে কর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব বিধান করা। প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কর্মীর চাকরির স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এতে কর্মীদের নিরাপত্তাবোধ ও মানবিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পাবে। তাদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বাড়বে। এক্ষেত্রে কর্মীরা মনোযোগ সহকারে কাজে আত্মনিয়োগ করবে। এতে করে প্রতিষ্ঠান লাভবান হয় এবং ব্যবস্থাপনার কাজ সহজ হবে। ফলে প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না। চাকরির স্থায়িত্ব কর্মীর অর্থনৈতিক জীবনকে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে।

১৩. উদ্যোগ (Initiative)

উদ্যোগ হল একটি চিন্তামূলক ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নমূলক কার্য। নতুন কোন পদ্ধতি বা কৌশল উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করার জন্য কর্মীদেরকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত ও যথোপযুক্ত সুযোগ দিতে হবে। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে এবং কর্মনৈপুণ্য প্রদর্শন সম্ভব হবে। এ প্রসঙ্গে Weihrich and Koontz এর মতে, “উদ্যোগ ব্যবস্থাপনাকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা করে।”

১৪. একতাই বল (Esprite de corps)

ব্যবস্থাপনার উল্লেখযোগ্য নীতি হচ্ছে দলগত চেতনা বা একতাই বল। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যার্জনের জন্য সকল স্তরের ব্যবস্থাপনা ও অধস্তনদের মধ্যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা একতাই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র শক্তির উৎস। পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে কার্যসম্পাদন করলে প্রতিষ্ঠান সহজে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। কারণ একক শক্তির চেয়ে দলীয় শক্তি অনেক বেশি গতিশীল। এ প্রসঙ্গে Robert Kreituer এর মতে, “Harmonious efforts among individuals in the key to organizational success.” অর্থাৎ, কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা হচ্ছে সংগঠনের সফলতার চাবিকাঠিস্বরূপ।

পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান বৃহদায়তন উৎপাদনের যুগে ব্যবস্থাপনাকে উপরিউক্ত মূল নীতিসমূহের উপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করতে হবে। ফলে তিনি তার কার্য অত্যন্ত সুচারুভাবে সম্পাদন করতে পারবেন। ব্যবস্থাপনার উপরিউক্ত মূলনীতি ছাড়া আরও কতিপয় নীতি পরিলক্ষিত হয়; যেমন- সহযোগিতার নীতি, নমনীয়তার নীতি, ভারসাম্যের নীতি, সর্বজনীনতার নীতি, ব্যতিক্রমের নীতি প্রভৃতি। সুতরাং সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, ব্যবস্থাপনার সকল মূলনীতি প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক ফল প্রদানে সক্ষম হবে।

Similar Posts