রজঃচক্র কি এবং কাকে বলে | কেন এবং কীভাবে হয় | ঋতুচক্র বা মাসিকচক্র কি

রজঃচক্র বা ঋতুচক্র বা মাসিকচক্র কি এবং কাকে বলে

স্ত্রীলোকের যৌবনকালে পরিপক্ক ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ ও গর্ভধারণের লক্ষ্যে যৌনাঙ্গসমূহে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পর্যায়ক্রমে পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়। ডিম্বাশয়ের হরমোনের প্রভাবে প্রতি ২৮ দিন অন্তর ৪-৫ দিন ধরে চক্রাকারে যে রক্ত, মিউকাস, অনিষিক্ত ডিম্বাণু, এন্ডোমেট্রিয়াম ইত্যাদি যোনী পথে নিঃসৃত হয় তাকে রজঃচক্র বা মাসিক চক্র বলে। বয়ঃসন্ধিকালে পিটুইটারী গ্রন্থি নিঃসৃত গোনাডোট্রপিক হরমোনের প্রভাবে ১২-১৫ বছর বয়সের মেয়েদের প্রথম রজঃস্রাব (Menstruation) শুরু হয়। কিন্তু এই সময় রজঃস্রাব অনিয়মিত হয় এবং প্রতিটি রজঃচক্রে ডিম্বাণু উৎপন্ন হয় না। বয়ঃপ্রাপ্ত নারীর সমগ্র যৌবনকালে প্রায় নিয়মিত ব্যবধানে রজঃস্রাব ঘটে থাকে। রজঃচক্রের গড় সময় ২৮ দিন, তবে এটি ২৫ থেকে ৩৫ দিনও হতে পারে। রজঃচক্রের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে (১২ – ১৬ তম দিন) ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ হয়। স্ত্রীলোক এ সময় যৌন সঙ্গম করলে ডিম্বাণু শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়।

রজঃচক্র কেন এবং কীভাবে হয়

রজঃচক্রের বিভিন্ন সময়ে ডিম্বাশয় ও জরায়ুতে যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নে বর্ণনা করা হলঃ

১. ডিম্বাশয় চক্র (Ovarian cycle)

রজঃচক্রের সময় স্ত্রীলোকের ডিম্বাশয়ের অভ্যন্তরে যেসব পরিবর্তন সাধিত হয় তাদেরকে একত্রে ডিম্বাশয় চক্র বলে। ৪টি দশার পর্যায়ক্রমিক আবর্তনের মাধ্যমে ডিম্বাশয় চক্র শেষ হয়। যথা

(ক) ফলিকুলার দশা (Follicular phase) : এ দশা রজঃচক্রের ৪র্থ বা ৬ষ্ঠ দিন থেকে ১৪ তম দিন পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময় ফলিকুলের থিকা-ইন্টারনা স্তর পর্যাপ্ত এস্ট্রোজেন নিঃসরণ দিতে পারে। এস্ট্রোজেনের ক্রমবর্ধমান ক্ষরণে প্রাথমিক ফলিকল ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে ওঠে। পিটুইটারী গ্রন্থির FSH পরোক্ষভাবে এ ঘটনাকে প্রভাবিত করে থাকে।

(খ) ডিম্ব নিঃসরণ দশা (Ovulation phase) : ডিম্বথলি থেকে যে প্রক্রিয়ায় ডিম্বাণু বের হয়ে আসে তাকে ডিম্বনিঃসরণ বলে। সাধারণত ১৪ তম (° ২) দিনে বর্ধনশীল প্রাথমিক ফলিকলটি গ্রাফিয়ান ফলিকলে পরিণতি পায় এবং এটা হতে ডিম্বাণু স্খলিত হয়ে ফ্যালোপিয়ান নালীতে চলে আসে। এ সময় FSH ক্ষরণ বন্ধ হয়ে পিটুইটারী গ্রন্থি হতে LH ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ডিম্বাণু ত্যাগ করা গ্রাফিয়ান ফলিকলে কর্পাস লুটিয়াম গঠিত হয়।

(গ) কর্পাস লুটিয়াম দশা (Corpus luteal phase) : এ দশার স্থায়িত্বকাল ১৫শ দিন থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত। এ সময়ে LH হরমোনের প্রভাবে কর্পাস লুটিয়াম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায় এবং এটা হতে প্রোজেস্টেরণ ক্ষরিত হতে থাকে। প্রোজেস্টেরনের প্রভাবে অন্য সব প্রাথমিক ফলিকলের বৃদ্ধি বন্ধ থাকে। নিঃসরিত ডিম্বাণু ১৯তম দিনের মধ্যে নিষিক্ত না হলে এটা নষ্ট হয়ে যায়।

(ঘ) রজঃস্রাবীয় দশা (Menstrual phase) : এ দশা ২৮ তম দিনের শেষে শুরু হয় এবং ৪–৬ দিন স্থায়ী হয়। এ সময় কর্পাস লুটিয়াম লোপ পায় এবং জরায়ু হতে বিনষ্ট ডিম্বসহ রজঃস্রাব ঘটে।

চিত্রঃ ডিম্বাশয় চক্র
চিত্রঃ ডিম্বাশয় চক্র

২. জরায়ু চক্র (Uterine cycle)

রজঃচক্রের মধ্যে জরায়ুর অভ্যন্তরে যে সকল পরিবর্তন সাধিত হয় তাকে জরায়ু চক্র বলে । জরায়ুচক্রে পরিবর্তনসমূহকে ৪টি দশায় ভাগ করা হয়। যথা-

(ক) পুনঃগঠন দশা (Regenerative Phase) ৪ রজঃস্রাব সমাপ্তির পর অর্থাৎ ৪র্থ – ৬ষ্ঠ দিনে জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। পিটুইটারী গ্রন্থির FSH এর প্রভাবে পুনরায় এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষসমূহ দ্রুত বিভাজনের মাধ্যমে জরায়ু প্রাচীর স্ফীত হতে শুরু করে এবং রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

(খ) ক্রমবর্ধনশীল দশা (Proliferative phase) : ৫ম দিবস হতে ১৪ শ দিবস পর্যন্ত এ দশার স্থায়িত্ব। এ সময় কালে এন্ডোমেট্রিয়াম বিকশিত হয়ে পুরু হয় এবং এতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। এস্ট্রোজেন হরমোনের প্রভাবে এ পরিবর্তন সংঘটিত হয়।

চিত্রঃ হরমোন ও জরায়ু চক্রের মধ্যে সম্পর্ক
চিত্রঃ হরমোন ও জরায়ু চক্রের মধ্যে সম্পর্ক

 

(গ) প্রো-জেস্টেশনাল দশা (Progestational phase) : এ দশার স্থায়িত্ব ১৫শ দিন থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত। এ সময়ে প্রোজেস্টেরণ হরমোনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াম আরও স্ফীত হয় এবং এতে অতিমাত্রায় রক্ত প্রবাহ ঘটে । ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলে কর্পাস লুটিয়াম প্রোজেস্টেরন হরমোন ক্ষরণ অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হয় না। ফলে শেষের দিকে এন্ডোমেট্রিয়াম ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে।

(ঘ) রজঃস্রাবী দশা (Menstrual phase) : এটি রজঃচক্রের শেষ দশা বা অন্য আর একটি রজঃচক্রের সূত্রপাত দশা। এ দশার স্থায়িত্ব ৪ থেকে ৬ দিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২৮ দিন পর পর এ চক্রের আবির্ভাব ঘটে। প্রোজেস্টেরনের অভাবে এন্ডোমেট্রিয়ামের রক্ত জালিকা হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। ফলে রক্ত, এন্ডোমেট্রিয়ামের ভগ্নাংশ ও মিউকাসসহ অনিষিক্ত ডিম স্রাব হিসেবে বাইরে নির্গত হয়।

রজঃ চক্র নিয়ন্ত্রণে হরমোনের ভূমিকা (Role of hormone in menstrual cycle control)

সম্পূর্ণ রজঃচক্র প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পিটুইটারী গ্রন্থি নিঃসৃত গোনাডোট্রাপিক হরমোনের প্রভাবে প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত ঘটে। FSH ডিম্বাশয়ে পৌঁছানোর পর ফলিকল কোষসমূহকে ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণে উদ্বুদ্ধ করে। ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরণের প্রভাবে রজঃচক্রের ৪–১৫ তম দিনের মধ্যে ডিম্বাণুর গঠন সম্পূর্ণ হয় এবং গ্রাফিয়ান ফলিকলের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। এ সময় জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষসমূহ দ্রুত বিভাজনের মাধ্যমে জরায়ু প্রাচীর স্ফীত হতে থাকে। ১৪-১৫ দিনের মধ্যে গ্রাফিয়ান ফলিকল থেকে ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান নালীতে চলে আসে। তখন FSH ক্ষরণ বন্ধ থাকে এবং LH ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। এ হরমোনের প্রভাবে ডিম্বত্যাগ করা গ্রাফিয়ান ফলিকলে কর্পাস লুটিয়াম গঠিত হয়। এবং সেখান থেকে প্রোজেস্টেরন নামক হরমোন ক্ষরিত হয়। এর প্রভাবে অন্য সকল প্রাথমিক ফলিকলের বৃদ্ধি সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে এবং জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামে রক্ত সঞ্চালন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। রজঃচত্রের ২৮তম দিনের শেষে ডিম্বাশয়ের কর্পাস লুটিয়াম লোপ পায়। ফলে প্রোজেস্টেরন ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। প্রোজেস্টেরনের অভাবে ও প্রোলাকটিনের প্রভাবে জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের রক্ত জালিকা বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। একেই রজঃস্রাবী দশা বলে।

Similar Posts