পৌরনীতি

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি ও ফলাফল আলােচনা করাে | চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি লেখাে।

1 min read

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি

চিরস্থায়ী ব্যবস্থার প্রথম প্রস্তাবক ছিলেন স্কটিশ চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ডাফ। লর্ড কর্নওয়ালিশ সর্বপ্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন (১৭৯৩ খ্রি. ২২ মার্চ)।

[1] রাজস্ব আদায়ে পরীক্ষানিরীক্ষা: ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর থেকেই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে। খুব সহজভাবে অথচ বেশি পরিমাণে কীভাবে রাজস্ব আদায় করা যায় এ নিয়ে কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ভূমি ব্যবস্থার উদ্ভাবন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষারই ফলশ্রুতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

[2] সমকালীন অর্থনীতিবিদদের প্রভাব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম প্রবক্তা আলেকজান্ডার ডাফ বাণিজ্যের উন্নতির লক্ষ্যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন, তিনি বলেন, রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত করা গেলে কৃষিব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে, আর কৃষির উন্নতি ঘটলে বাণিজ্যও সমৃদ্ধ হবে। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কৃষিকলাবিদ হেনরি পাত্তুলাে প্রাকৃতিক সম্পদকেই আয়ের মূল উৎস বলে উল্লেখ করে উল্লেখ করে জমিতে চিরস্থায়ী ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করেন।

[3] কোম্পানির গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের গরিষ্ঠ অংশ দীর্ঘদিন ধরে জমিদারদের জমা (নির্ধারিত রাজস্ব) চিরতরে নির্দিষ্ট করার পক্ষে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস যখন পাঁচসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন তখনই ফিলিপ ফ্রান্সিস, ডেকারেজ, মিডলটন প্রমুখ কর্মচারীবৃন্দ ভূমিরাজস্বের হার স্থায়ী করার দাবি তােলেন। তাদের এই দাবিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ও কোম্পানির বাের্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি জান্ট্রাস প্রভাবিত হন।

[4] পিটের আইন ও পরিচালক সভার প্রভাব: পিটের ভারতশাসন আইনে (১৭৮৪ খ্রি.) বারবার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার পরীক্ষনিরীক্ষার ক্ষতিকর প্রভাবকে লক্ষ রেখে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুপারিশ করা হয়। এর দুবছর পরে কোম্পানির পরিচালক সভা ঘনঘন রাজস্বব্যবস্থা পরিবর্তনের তীব্র সমালােচনা করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশকে বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ভারতে পাঠায়।

[5] কর্নওয়ালিশের প্রচেষ্টা: গর্ভনর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসে লর্ড কর্নওয়ালিশ রাজস্ব হার, জমার পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালান। অবশেষে তিনি বাংলা, বিহার (১৭৮৯ খ্রি. ১০ ফেব্রুয়ারি) এবং উড়িষ্যার (১৭৯০ খ্রি.) জমিদারদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের কথা ঘােষণা করেন, যা দশসালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত হয়। পরিচালক সভার অনুমােদন পেয়ে দশসালা বন্দোবস্তকে রূপান্তরিত করা হয় (১৭৯৩ খ্রি. ২২ মার্চ)।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল

[1] জমির স্বত্ব দান: জমির ওপর জমিদারদের স্বত্ব দান করায় জমিদাররা আরও বেশি করে কৃষিব্যবস্থায় মূলধন বিনিয়ােগ করে কৃষিকাজের সম্প্রসারণ ঘটানাের চেষ্টা করে।

[2] কৃষকবিদ্রোহ: বিভিন্ন মধ্যস্বত্ব ও উপস্বত্বভােগীরা অধিক খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে কৃষক শােষণের মাত্রা বাড়ায়। এরা নির্ধারিত খাজনা ছাড়াও বিভিন্ন বেআইনি কাজ থেকে খাজনা আদায় করে। এসবের ফলে কৃষক সমাজে যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্মায় তারই অনিবার্য পরিণতি উনিশ শতকে সংঘটিত একের পর এক কৃষকবিদ্রোহ।

[3] জমিদারি অবসান: বছরের শেষে চড়া রাজস্ব শােধ করা অনেক জমিদারের পক্ষেই সম্ভব হত না। ফলে, সূর্যাস্ত আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিন অতিক্রান্ত হওয়ায় বহু জমিদার তাদের জমিদারি হারান। এইভাবেই রাজশাহী, দিনাজপুর, নদিয়া, বীরভূমের জমিদারির অবসান ঘটে।

[4] মধ্য ও উপস্বত্বভােগীর উদ্ভব: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন পর্যায়ে ইজারাদার, দর ইজারাদার পত্তনিদার প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের মধ্যস্বত্বভােগীর উদ্ভব ঘটে। কোম্পানির সঙ্গে জমিদারের যেমন চুক্তি হত, তেমন জমিদারদের সঙ্গেও মধ্যস্বত্বভােগীদের চুক্তি সম্পাদিত হত।

[5] কৃষকদের দূরবস্থা: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছিল কৃষকদের। কারণ জমির ওপর জমিদাররা মালিকানা স্বত্ব পেলেও কৃষকরা তা পায়নি। জমিদার খেয়ালখুশি মতাে কৃষক প্রজাকে তার জমি থেকে উৎখাত করতে পারতেন।

[6] গ্রামীণ পরিকাঠামাের ভাঙন: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। মধ্যস্বত্বভােগী সুদখাের ও মহাজনরা মিলে গ্রামীণ কৃষিজ অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়।

[7] মহাজনশ্রেণির আবির্ভাব: মধ্যস্বত্বভােগীরা রাজস্ব আদায়ের নামে কৃষক প্রজাদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু করে। কৃষকরা বাধ্য হয় মহাজনশ্রেণির কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে। সুদ ও আসল মিলিয়ে মােট দেনার পরিমাণ যা দাঁড়াত তা কখনােই কৃষক প্রজারা শােধ করতে পারত না। ফলে মহাজনরা তাদের সর্বস্ব গ্রাস করে নিত।

[8] ব্রিটিশ অনুগত সম্প্রদায়ের উদ্ভব: সূর্যাস্ত আইনের শিকার হয়ে যেসব জমিদার জমিদারি হারান, তাদের জমিদারি ক্রয় করে নতুন এক জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবার, রানাঘাটের পালচৌধুরী পরিবার, কাশিমবাজারের নন্দী পরিবার, শােভাবাজারের দেব পরিবার প্রভৃতি।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাবলি

দেওয়ানি লাভের পর লর্ড কর্নওয়ালিশ দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ দিতে চাইলে ইংল্যান্ডের বাের্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি হেনরি জান্ট্রাস ও প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট তা অনুমােদন করেন। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তগুলি হল-

  • [1] বংশপরম্পরা জমি ভােগদখল করে আসছেন এরূপ জমিদাররা বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে খাজনা দিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে জমির স্বত্ব ভােগ করতে পারবে।

  • [2] জমিদাররা ও ইজারাদাররা আদায় করা রাজস্বের ১০ ভাগ সরকারি কোশাগারে জমা দেবেন, এক ভাগ নিজেরা ভােগ করবেন।

  • [3] সূর্যাস্ত আইন অনুসারে বাংলা সালের হিসেবে বছরের শেষ দিনে সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বেই বাকি রাজস্ব জমা করতে হবে, না হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত হবে।

  • [4] অদূর ভবিষ্যতে কোনাে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেও রাজস্বের ছাড় দেওয়া হবে না।

  • [5] জমিদাররা ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত কোনাে বিবাদের বিচার করার অধিকার পাবে না।

  • [6] ভবিষ্যতে জমিদারদের আয় বাড়লেও কোম্পানির আদায় করা নির্ধারিত রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x