অর্থনীতি কী? | বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতি কাকে বলে? আলোচনা কর
অর্থনীতি কি এবং কাকে বলে
অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়ে কোন মতৈক্যে পৌঁছতে পারেন নি। তবে এভাবে বলা যায় যে, মানুষের অসীম অভাব এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান সম্পর্কে আলোচনাই অর্থনীতির প্রতিপাদ্য বিষয়। সংক্ষেপে অর্থনীতির সংজ্ঞায় বলা যায় যে, যে শাস্ত্র অসীম অভাব এবং সীমিত সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও বণ্টনের জন্য আলোচনা করে থাকে, তাকেই অর্থনীতি বলে।
অর্থনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ Economics । Economics শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Oikonomia হতে। যার বাংলা প্রতিশব্দ দাঁড়ায় গার্হস্থ্য পরিচালনা। কিন্তু সে সময়ের গার্হস্থ্যের গণ্ডি পেরিয়ে অর্থনীতি আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। তাই অর্থনীতির সংজ্ঞাও ব্যাপকতা লাভ করেছে। অসীম অভাব ও সীমিত সম্পদের সমন্বয় করতে গিয়ে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়, সে সমস্যার প্রেক্ষিতে অর্থনীতির সংজ্ঞাকে চারটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যায়। যথা:
ক. সম্পদের দৃষ্টিকোণ থেকে
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণের মতে, অর্থনীতি একটি সম্পদের বিজ্ঞান। সম্পদের বিজ্ঞান হিসেবে সম্পদ অর্জন, উৎপাদন কাজে এ সম্পদ ব্যবহার এবং এর মধ্যে দিয়ে প্রাপ্ত দ্রব্য ও সেবার ভোগ নিয়ে যে বিজ্ঞানে আলোচিত হয় তাকে অর্থনীতি বলা হয়।
অর্থনীতির জনক এ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘Wealth of Nation’ গ্রন্থে অর্থনীতিকে সম্পদের বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, “অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ অনুসন্ধান করে।” J. S. Mill এর মতে, “সম্পদের উৎপাদন ও তা বণ্টনের ব্যবহারিক বিজ্ঞানই হল অর্থনীতি।” Concise Oxford Dictionary তে অর্থনীতিকে “The practical science of production and distribution of wealth” বলা হয়েছে।
- S. Mill, Walker ও J. B. Sey প্রমুখ অর্থনীতিবিদ এ সংজ্ঞার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করলেও রাস্কিন, ডব্লিউ.মরিস, কার্লাইল প্রমুখ অর্থনীতিবিদ সংজ্ঞাটির সমালোচনা করেন এবং একে ‘যক্ষের বাণী’ বলেছেন। অধ্যাপক মার্শালবলেছেন, “অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য সম্পদ নিয়ে আলোচনা নয়, বরং মানবকল্যাণ নিয়ে আলোচনাই মুখ্য।” তাই সম্পদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাপ্ত সংজ্ঞাটি ত্রুটিপূর্ণ।
খ. কল্যাণের দৃষ্টিকোণ থেকে
অধ্যাপক মার্শাল সম্পদের চেয়ে কল্যাণের দিকে অধিক গুরুত্বারোপ করেন। মার্শাল এর মতে, “রাজনৈতিক অর্থনীতি বা অর্থনীতি মানবজীবনের সাধারণ কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে, তা বিশ্লেষণ করে ব্যক্তি ও সমাজের কার্যাবলির সে অংশ যা কল্যাণের বস্তুগত প্রয়োজনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বিষয়ের ব্যবহার ও অর্জন প্রক্রিয়াকে।” তিনি আরও বলেছেন, এ বিষয়টি ব্যক্তি ও সমাজের সেসব কার্যাবলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, যাদের দ্বারা মুখ ও কল্যাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রাপ্তি ও ব্যবহার সম্ভব। মার্শাল এর সংজ্ঞার দৈনন্দিন কার্যাবলি অবশ্যই আর্থিক, অনার্থিক নয়।
পরবর্তীকালে অনেক অর্থনীতিবিদ মার্শাল এর সংজ্ঞাকে সমর্থন করলেও এল. রবিঙ্গ সংজ্ঞাটিকে বর্জন করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেছেন, সংজ্ঞাটিতে কেবল বস্তুগত বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে, অবস্তুগত দ্রব্যকে বিবেচনায় আনা হয় নি। বস্তুগত সম্পদ ছাড়াও এমন অনেক সেবাধর্মী বিষয় বিদ্যমান যা যথেষ্ট অর্থনৈতিক মূল্য বহন করে।
গ. স্বল্পতার দৃষ্টিকোণ থেকে
স্বল্পতাই মানবজীবনের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর মূল উৎস। অসীম অভাব ও সীমিত সম্পদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে অধ্যাপক এল. রবিঙ্গ অর্থনীতির সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, “Economics is a science which studies human behavior as a relationship between ends and scarce means which have alternative uses.” অর্থাৎ, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী মানব আচরণকে বিশ্লেষণ করে।” রবিঙ্গ এর এ সংজ্ঞায় তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়। যথা:
- i. মানুষের অভাব সীমাহীন
- ii. সম্পদ সীমিত এবং
- iii. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার বিদ্যমান
তাই রবিন্স এর এ সংজ্ঞায় অর্থনীতির সামগ্রিক বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়েছে। রবিন্স এর সংজ্ঞাটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হলেও পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদ হিকস্, ফ্রেসার, রবার্টসন, ক্যালডর প্রমুখ কর্তৃক সংজ্ঞাটি সমালোচিত হয়েছে। কেবল স্বল্পতা বা দুষ্প্রাপ্যতা থেকে অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয় না, সম্পদের প্রাচুর্য থেকেও সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। যেমন: ১৯৩০ সালের মহামন্দার কারণ স্বল্পতা নয়, বরং অতি উৎপাদন ছিল প্রধান কারণ। রবিন্স এর সংজ্ঞাটিকে অনেক সময় স্থবির ও অপর্যাপ্ত বলে সমালোচনা করা হয়। স্থিতীয় অর্থনীতিতে এ সংজ্ঞাটি গ্রহণযোগ্য হলেও গতিশীল অর্থনীতিতে তা প্রয়োগযোগ্য নয়। তাই বর্তমানকালে রবিন্স এর স্বল্পতার সংজ্ঞার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ঘ. প্রবৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে
প্রবৃদ্ধি ভিত্তিক সংজ্ঞার প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন। তাঁর মতে, “Economics is the study of how men and society choose, with or without the use of money, to employ scarce productive resources which could have alternative uses, to produce various commodities over time and distribute them for consumptions now and in the future among various people and groups of society.”
এ সংজ্ঞাতে রবিন্স এর বক্তব্য স্থান পেয়েছে, আবার এটি গতিশীলও বটে। কাজেই রবিন্স এর সংজ্ঞাকে সম্প্রসারিত করে স্যামুয়েলসন কর্তৃক প্রদত্ত সংজ্ঞাটি অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য।
অর্থনীতিকে কি বিজ্ঞান বলা যায়? অর্থনীতি কি ধরণের বিজ্ঞান?
অর্থনীতি বিজ্ঞান কি না এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে জানতে হবে বিজ্ঞান বলতে কি বুঝায়। সাধারণত বিজ্ঞান বলতে জ্ঞানের সুশৃঙ্খল ধারাকে বুঝানো হয়; যা কারণ ও ফলাফলের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্দেশ করে। এ জ্ঞান পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষার দ্বারা নির্ণীত হয় এবং এ নির্ণীত জ্ঞান হতে সাধারণ বিধি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিজ্ঞানের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে, বিজ্ঞানের অন্তর্গত বিষয়গুলো সহজে পরিমাপযোগ্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অর্থনীতিতে বিষয়গুলোকে অধিকাংশই অর্থের মাধ্যমে, পরিমাপ করা সম্ভব। সে প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানের এ বৈশিষ্ট্য অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয়। অর্থনীতিকে বিজ্ঞান বলার সপক্ষে নিম্নলিখিত যুক্তির অবতারণা করা যায় :
১. অর্থনীতিতে সাধারণ সূত্রের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব : অর্থনীতি পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ প্রভৃতি পদ্ধতির সাহায্যে মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কার্যকলাপ আলোচনা করে এবং এদের মধ্যে পারস্পরিক কার্যকারণ সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে সাধারণ সূত্র প্রতিষ্ঠা করে। এসব সূত্রের বাস্তব প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রেই সার্থক হয়েছে বলে অর্থনীতিকে বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত করা যায়।
২. অর্থনীতির বিষয়বস্তু পরিমেয় : প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীরা পরিমাপ নিয়ে আলোচনা করেন। অর্থনীতিবিদগণ মানুষের অর্থনীতির আলোচিত ঐসব কাজ নিয়ে আলোচনা করেন, যাদের পরিমাণ অর্থের মাধ্যমে পরিমাপ করা সম্ভব। সুতরাং, বিষয়সমূহ অর্থের অঙ্কে পরিমাপযোগ্য এবং পরিমেয়। এক্ষেত্রে অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে বিজ্ঞান বলে গণ্য করা যায়।
৩. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আলোচনা ও অর্থনীতিবিদগণ : অর্থনীতির আলোচনা বা সমস্যা সমাধানে পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ, পরীক্ষানিরীক্ষা প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করে থাকেন, এ কারণেও অর্থনীতিকে বিজ্ঞান বলা যায়।
উপরিউক্ত কারণে অর্থনীতিকে বিজ্ঞান বলে অভিহিত করা হলেও অর্থনীতিকে পূর্ণ বিজ্ঞান বলা যায় না। এর কারণগুলো নিম্নরূপ,
১. মানব আচরণ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী বিপজ্জনক : মানুষ ইচ্ছা শক্তিসম্পন্ন জীব। তাদের স্বাধীন সত্তা আছে। তাই মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের মধ্যে সাধারণভাবে সামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলেও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, সকল মানুষ সকল পরিস্থিতিতে একই আচরণ করবে। কাজেই অর্থনীতিকে খাঁটি বিজ্ঞান বলা যায় না।
২. মানব আচরণ সঠিকভাবে পরিমাপযোগ্য নয়: মানব আচরণ অত্যন্ত জটিল বিষয়। কাজেই অর্থনীতিতে অর্থের মাধ্যমে মানুষের আচরণের যে পরিমাপ করা হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক হয় না। যেমন- দাম বৃদ্ধি পেলে চাহিদা কমবে এটা সত্য কিন্তু কি পরিমাণ চাহিদা কমবে তা বলা কঠিন। সুতরাং, অর্থনীতিকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলা যায় না।
৩. অর্থনীতির সূত্রগুলো আনুমানিক : মানুষের অন্তর্নিহিত বোধশক্তি, অনুভূতি ও আবেগ পরিমাপের কোন সঠিক যন্ত্র নেই। অর্থনীতিবিদগণ এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও অনুমানের উপর নির্ভর করে বলে অর্থনীতির সূত্রসমূহকে ‘অনুমানসিদ্ধ’ সূত্র বলা হয় ।
উপরিউক্ত কারণে অর্থনীতিকে প্রকৃত বা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলা যায় না। এটি সত্য যে, অর্থনীতির মৌলিক কিছু প্রশ্নে অর্থনীতিবিদরা একমত হতে পারেন না। তবে তার জন্য অর্থনীতিকে বিজ্ঞান না বলার কোন হেতু নেই। মতভেদ থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে বিজ্ঞান বলা যাবে। বিজ্ঞান বিশেষণে অর্থনীতিকে বিশেষিত করতে কেউ কেউ আবার এ কারণে আপত্তি তোলেন যে, প্রকৃত বিজ্ঞান হিসেবে পদার্থ ও রসায়নবিদ্যার মত অর্থনীতি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক কোন আভাস দিতে পারে না। তবে এ যুক্তির ভিত্তিতে অর্থনীতিকে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকার না করলে প্রচলিত অনেক বিজ্ঞানই আর বিজ্ঞান থাকে না। কেননা, অর্থনীতিবিদ কর্তৃক বাণিজ্য চক্রের মন্দা সম্পর্কে পূর্বাভাস বরং আবহাওয়া বিজ্ঞানের মন্দার পূর্বাভাস অপেক্ষা অনেক সময় সঠিক বলে বিবেচিত হয়। কাজেই আবহাওয়া বিজ্ঞানকে যদি বিজ্ঞান বলা যায়, তবে অর্থনীতিকে আরও বেশি করে বিজ্ঞান বলা যায়। তবে এটি রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ন্যায় নিখুঁত বিজ্ঞান নয়। মূলত অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান।