মিশ্র অর্থনীতি কি | মিশ্র অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য কি কি
মিশ্র অর্থনীতি কি
মিশ্র অর্থনীতি (Mixed economy) : পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে মিশ্র অর্থব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানা ও বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ বিরাজ করে তাকে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলে। মিশ্র অর্থব্যবস্থায় পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে সহাবস্থানই হল মিশ্র অর্থ ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য। এ ব্যবস্থায় বেসরকারি খাতের উপর কতকগুলো কাজ ছেড়ে দেওয়া হয় এবং কতকগুলো কাজ সরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন বলেছেন, “মিশ্র অর্থনীতি বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝায় যেখানে উৎপাদন ও ভোগ কার্য সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার সাথে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটেছে।” বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশের অর্থনীতিতে ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র কোনটাই কার্যকর হয় না। ফলে সেসব দেশে ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং সাথে সাথে সীমিত পর্যায়ে কিছু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মিশ্র অর্থব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশে মিশ্র অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান।
মিশ্র অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য
মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো লক্ষ্য করা যায়।
১. ব্যক্তিগত মালিকানা : মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পত্তি ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত। তবে সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার সুযোগ থাকলেও কিছু কিছু সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির হাতে দেওয়া হয় না। আবার বিশেষ বিশেষ সম্পত্তির ক্ষেত্রে (যেমন- কৃষি জমি, শহরে আবাসিক জমি প্রভৃতি) ব্যক্তিগত মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
২. সরকারি মালিকানা : মিশ্র অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত মালিকানা ও উদ্যোগের স্বাধীনতা, ভোগকারীর সার্বভৌমত্ব ও স্বয়ংক্রিয় মূল্য ব্যবস্থা বজায় থাকলেও এদের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়া হয়। দেশে মূল ও ভারী শিল্প স্থাপন, জাতীয় নিরাপত্তামূলক প্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় বাণিজ্য সরকারি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৩. সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহাবস্থান : মিশ্র অর্থব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি অবস্থান করে। অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় বাণিজ্য পরিচালনা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসহ বড় শিল্প ব্যক্তি উদ্যোগের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার দেশের মৌলিক ও ভারী শিল্প, জাতীয় নিরাপত্তা ও জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ আমদানি, রপ্তানি প্রভৃতি সরকারি উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি খাত একে অপরের সাথে পরিপূরক সম্পর্ক বজায় রাখে।
৪. স্বয়ংক্রিয় দামব্যবস্থা : মিশ্র অর্থনীতিতে স্বয়ংক্রিয় মূল্য ব্যবস্থার দ্বারা উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগ কার্যসম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে দ্রব্যের দাম তার চাহিদা ও যোগান দ্বারা নির্ধারিত হলেও দাম ব্যবস্থা যাতে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত হয় সেজন্য সরকার বিভিন্ন হাতিয়ারের সাহায্যে (যেমন- কর আরোপ করে, সুদের হার হ্রাসবৃদ্ধি করে ইত্যাদি) দাম প্রক্রিয়ার কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৫. মুনাফার উপস্থিতি : মিশ্র অর্থ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফা লোপ করা হয় না, বরং বেসরকারি উদ্যোগে মুনাফার ভিত্তিতে কাজকর্ম সম্পাদিত হয়। তবে বেসরকারি খাতে মুনাফার অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও সরকার জনস্বার্থে দাম ও মুনাফা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
৬. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা : মিশ্র অর্থব্যবস্থায় কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যকলাপে সরকার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এক্ষেত্রে সরকার নিজস্ব উদ্যোগে কৃষি, শিল্প প্রভৃতি উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। জাতীয় পরিকল্পনার মধ্যে বেসরকারি উদ্যোগের পরিকল্পিত কার্যক্রমও যুক্ত হয়। যেমন- বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলোতে সরকারি খাতে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও কি পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে তা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৭. শ্রমিকের স্বার্থসংরক্ষণ : মিশ্র অর্থব্যবস্থায় সরকার শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি ও কাজের দীর্ঘতম সময় নির্ধারণ, শিল্প বিরোধের নিষ্পত্তি, ছুটি নির্ধারণ ইত্যাদি পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদেরকে শোষণের হাত থেকে রক্ষা করে।
মিশ্র অর্থনীতিতে একদিকে যেমন সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ন্যায় কতকগুলো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে তেমনি অন্যদিকে, ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার ন্যায় কতকগুলো ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা রয়েছে। মিশ্র অর্থব্যবস্থায় পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার গুণাবলির সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার গুণাবলির সংমিশ্রণ থাকায় বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ দেশে মিশ্র অর্থব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে।