১৯০৫ সালের দরিদ্র আইন কমিশন কি | এর প্রেক্ষাপট এবং সুপারিশ
বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ইংল্যান্ড এ উন্নত প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয়। তাই তাদের অনেক কয়লা খনি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বেকার সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে। সরকারি, বেসরকারি কোনভাবেই বেকার সমস্যা মোকাবিলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে জাতীয় জরুরি তহবিল গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
দরিদ্র আইন কমিশন গঠনের প্রেক্ষাপট
ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেকার সমস্যার সমাধান এবং দরিদ্র আইনগুলোর সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে ১৯০৫ সালে লর্ড জর্জ হ্যামিলটন (Lord George Hamilton) কে সভাপতি করে ১৮ সদস্য সমন্বিত রাজকীয় কমিশন, ‘Royal Commission on the Poor Laws and Relief of Distress‘ গঠন করেন। কমিশনে ১৭ সদস্যের মধ্যে মাত্র চার জন ছিল বিভিন্ন সংখ্যালঘিষ্ঠ বিরোধী দলের। এরা হলেন, ফ্যারিয়ান সোসাইটির মিসেস ব্যাটরিক, ট্রেড ইউনিয়ন ও লেবার পার্টির জর্জ ল্যান্ডসব্যারি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধি ফ্রান্সিস চান্ডলার এবং রেভারেন্ড। কমিশনের সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য ছিল। পরিশেষে কমিশন ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯০৫ দরিদ্র নিরসনের সুপারিশ সরকারের নিকট পেশ করে।
১৯০৫ সালের দরিদ্র আইন কমিশনের সুপারিশ
১৯০৫ সালে দরিদ্র আইন কমিশন নিম্নলিখিত সুপারিশমালা পেশ করে-
- ১. ১৮৩৪ সালের দরিদ্র আইনের বিধান অনুসারে গঠিত দরিদ্র আইন ইউনিয়ন এবং অভিভাবক বোর্ডের পরিবর্তে কাউন্টি কাউন্সিল গঠন করা এবং স্থানীয় সাহায্য সংস্থার প্রশাসনগুলোকে তিন অঞ্চলে ভাগ করা।
- ২. প্রচলিত শাস্তিমূলক দরিদ্র সাহায্য কর্মসূচির বিলোপ সাধন করে মানবিক ও কল্যাণধর্মী সরকারি কর্মসূচি প্রবর্তন করা।
- ৩. মিশ্র দরিদ্রাগার বিলুপ্ত করে মানসিক রোগী ও পশ্চাৎপদ ব্যক্তিদের হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং শিশুদেরকে দত্তক পরিবারে বা আবাসিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা।
- ৪. বৃদ্ধদের জাতীয় পেনশন, দরিদ্রদের বিনামূল্যে চিকিৎসা, বেকার ও অক্ষমদের জন্য সামাজিক বীমা কর্মসূচি চালু করা এবং বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
১৯০৫ সালের দরিদ্র আইন কমিশনের উপর্যুক্ত বাস্তবমুখী সুপারিশমালা ইংল্যান্ডের সমাজসেবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনয়ন করে। দরিদ্রদের সাহায্যদানের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। দরিদ্র আইন কমিশনের সুপারিশের উপর ভিত্তি করে কতকগুলো সামাজিক আইন প্রণীত হয়। এসব আইনগুলো হলো : ১৯০৬ সালের খাদ্য আইন, ১৯০৭ সালের শিক্ষা আইন, ১৯০৮ সালের বৃদ্ধকালীন পেনশন আইন, ১৯০৯ সালের শ্রমিক বিনিয়োগ আইন, ১৯১১ সালের জাতীয় বীমা আইন, ১৯২৫ সালের বিধবা, এতিম ও যুদ্ধকালীন পেনশন আইন, ১৯৩৪ সালের বেকারত্ব আইন ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের দরিদ্রদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়, ১৯০৫ সালের দরিদ্র আইন তার মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ আইন প্রণয়নের ফলে দারিদ্র্য সমস্যা পুরোপুরি সমাধান সম্ভব না হলেও দরিদ্রদের সাহায্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯০৫ সালের দরিদ্র আইন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ইংল্যান্ডে প্রণীত সামাজিক আইন
এ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ইংল্যান্ডে নিম্নোক্ত সামাজিক আইনগুলো পাস হয়।
১. ১৯০৬ সালের খাদ্য আইন: ১৯০৬ সালের খাদ্য আইন অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ের জন্য দুপুরে খাদ্যের ব্যবস্থা করা হয়।
২. ১৯০৭ সালের শিক্ষা আইন : এ আইনের অধীনে বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
৩. ১৯০৮ সালের বৃদ্ধ ভাতা আইন : ১৯০৮ সালের বৃদ্ধ ভাতা আইন অনুযায়ী ৭০ বছর ঊর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সাপ্তাহিক ভাতা হিসেবে ৫ সিলিং অর্থ সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।
৪. ১৯০৯ সালের শ্রমিক বিনিময় আইন: এ আইনের মাধ্যমে ট্রেড বোর্ড গঠন করে শ্রমিকদের চাকরি সহায়তা, শ্রমিক গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং চাকরিদাতাদের দক্ষ ও যোগ্য শ্রমিক পেতে সাহায্য করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
৫. ১৯১১ সালের জাতীয় বীমা আইন : এ আইনের মাধ্যমে পরিমিত আয়ের শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য বীমা (Health insurance) চালু করা হয়।
৬. ১৯২৫ সালের পেনশন আইন : এ আইনের অধীনে তিন শ্রেণীর জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়। এরা হলো ৬০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী বিধবা, ৬৫ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী প্রবীণ এবং ১৬ বছরে কম বয়সী শিশু।
উপরিউক্ত আইনগুলো ছাড়াও ১৯০৫ সালের রয়েল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে ইংল্যান্ডে আরও কিছু সামাজিক আইন প্রবর্তিত হয়। এগুলোর মধ্যে ১৯৩৪ সালের বেকারভাতা আইন, ১৯৩১ সালের National Economy Act ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, রয়েল কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সামাজিক বীমা আইন প্রণীত হয়। তবে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সামাজিক বীমা আইন প্রণীত হয় জার্মানিতে I