স্বপ্নের পদ্মা সেতু প্রবন্ধ রচনা (১,২০০ শব্দ) । (PDF Download) । Padma Bridge bangla Paragraph

স্বপ্নের পদ্মা সেতু

ভূমিকা : সাধারণভাবে বলা হয়, স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তা কখনো বাস্তবে পরিণত হয় না। কেননা স্বপ্ন তো কল্পনা। কিন্তু কিছু কিছু স্বপ্ন বা কল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। তার জন্য দকার হয় দৃঢ় প্রতীতী, উদ্যোগ, শ্রমনিষ্ঠা, একাগ্রতা ও সাধনা। মানুষের নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন অন্য মানুষকে আশান্বিত ও আত্মবিশ্বাসী করে। সেই আশা, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় প্রতীতী স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তবের পদ্মা সেতু নির্মাণে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাস ও সভ্যতার বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত সন্তান। এ দেশের মানুষের উদ্যম ও কর্মস্পৃহার সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু, বিশ্বস্ততা, গৌরব ও অহংকারের সমুজ্জ্বল প্রতীক পদ্মা সেতু ।

শুরুর ইতিহাস : AECOM-এর ডিজাইনে পদ্মা নদীর উপর বহুমুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প ‘পদ্মা বহুমুখী সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১১ সালে এবং শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। পুরো প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯২ কোটি ডলার, যার এডিবির ঋণ সহায়তা ৬১.৫ কোটি ডলার। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার, জাইকা ৪১.৫ কোটি ডলার, আইডিবি ১৫.৫ কোটি ডলার, আবুধাবি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ ৩ কোটি ডলার ঋণসহায়তা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরামর্শক নিয়োগে তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগে গত ২৯শে জুন ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা বাতিল করে। ফলে পদ্মা সেতুর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাংকের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে এ দেশের মানুষ কিছু সময়ের জন্য দুঃখে ক্ষোভে হতাশায় নিমজ্জিত হয় ।

অনন্য সাহসী সিদ্ধান্ত : ভবিষ্যৎ তো তারই জন্য, যে স্বপ্ন দেখত ভালোবাসে, স্বপ্নের পিছু ছুটতে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ এ স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়নের রূপকার। তারা সাহসী ও সংগ্রামী। প্রবল বন্যার সঙ্গে, ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা এ দেশের মানুষ সাময়িকভাবে হতাশ হলেও পরক্ষণেই তেজোদীপ্ত হয়ে ঘুড়ে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে আমাদের সরকারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা এদেশের সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অনন্য ও সাহসী সিদ্ধান্ত।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের রূপরেখা : পদ্মা সেতু প্রকল্প বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সেতু প্রকল্প ।

প্রকল্পের নাম— পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। বাহক – যানবাহন ও ট্রেন। ক্রস- পদ্মা নদী

স্থান- লৌহজং, মুন্সীগঞ্জের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর।

নির্মাণ শুরু— ৭ ডিসেম্বর, ২০১৪।

নকশা— AECOM

উপাদান— কংক্রিট, স্টিল ।

মোট দৈর্ঘ্য— ৬.১৫০ মি. (২০,১৮০ ফুট)

প্রস্থ- ১৮.১০ মি. (৫৯.৪ ফুট)

নির্মাণকারী- চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লি.

নির্মাণকাজের বিন্যাস : পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ সাতটি ভাগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো :

ক. মূল সেতু নির্মাণের দায়িত্বে আছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। কার্যাদেশ পেয়েছে ২৬ নভেম্বর, ২০১৪। চুক্তি অনুযায়ী ১২.১৩৩.৩৯ কোটি টাকায় ৪৮ মাসের মধ্যে তাদর কাজ শেষ করার কথা। মূল সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হবে নতুন নতুন কৌশল ও প্রযুক্তি। এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০১৮ সালে।

খ. নদীশাসনের কাজ পেয়েছে সিনোহাইড্রো কর্পোরেশন লিমিটেড, চায়না। চুক্তিমূল্য ৮,৭০৭.৮১ কোটি টাকা। কার্যাদেশ অনুযায়ী জমি হস্তান্তর, যন্ত্রপাতি ও নির্মাণসামগ্রী ক্রয় ও প্রক্রিয়াকরণ, ঠিকাদারের আবাসন, Stack Yard, Casting Yard ইত্যাদি নির্মাণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নদীশাসনের কাজ পুরোদমে চলছে।

গ. ১২৯০ কোটি টাকায় বাংলাদেশের আব্দুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়াভিত্তিক এইচ.সি.এম. (জেভি) যৌথভাবে মাওয়া ও জাজিরায় সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ করছে। সংযোগ সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও তারা নিশ্চিত করবে। মূল সেতু যেখানে নামবে সেই নাওডোবা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সংযোগ সড়ক, সংযোগ সেতু, কালভার্ট, সার্ভিস এলাকা ও সেনাক্যাম্প নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। একই গতিতে চলছে মাওয়া এলাকার কাজ ।

ঘ. ভূমিগ্রহণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য মোট ১৪০৮.৫৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে জমির মোট অতিরিক্ত বদলিমূল্য প্রদান করা হয়েছে ৩১.১২.১৪ সাল পর্যন্ত ৫০০.৭১ কোট টাকা। এখানে মোট প্লটের সংখ্যা ২৬৯৮, আবাসিক প্লট ২৬১৮, বাণিজ্যিক প্লট ৮৮। ক্ষতিগ্রস্তদের হস্তান্তর করা হয়েছে ৯৭৭ টি প্লট।

ঙ. পরিবেশ উন্নয়নে ২০১২ সাল থেকে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং অদ্যাবধি মোট ৫৫.১৫০টি বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। পদ্মার দুই পারের সাইটে (রিসোর্ট এরিয়া) আরও লক্ষাধিক বৃক্ষ রোপণের প্রক্রিয়া চলছে।

চ. মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে কোরিয়ান এক্সপ্রেস ওয়ে। এজন্য ব্যয় হবে ৩৮৩ কোটি টাকা । ছ. সেনাবহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন ১৩৩ কোটি টাকায় সংযোগ ও সার্ভিস এলাকার পরামর্শকের কাজ করছে।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এক বছর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিযুক্ত থাকবে।

সেতু প্রকল্প এলাকায় কর্মচাঞ্চল্য : পদ্মা সেতুর নির্মাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে বহু সংখ্যক প্রকৌশলী, হাজার হাজার শ্রমিক, পরামর্শক ও বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা। প্রথম দিকে ২০০ বিদেশিসহ প্রায় দুই হাজার লোকের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছিল। প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু হওয়ার পর প্রায় দুই হাজার বিদেশিসহ প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২০ হাজার লোক বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে। পরোক্ষভাবে নানা কাজে সহায়তায় রয়েছে আরও অন্তত ৫ হাজার লোক। তাছাড়া কৌতূহলী হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিনই নিরাপদ দূরত্বে থেকে মূল সেতুর নির্মাণকাজ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ প্রত্যক্ষ করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এ সেতু চালু হলে ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা এবং রেলপথে যুক্ত হবে অধিকাংশ জেলা। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর আর্থ- সামাজিক উন্নয়ন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ১.২ শতাংশ। যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ অতীতের দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ ও ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পাবে। সড়ক বা রেলপথে যাতায়াত হবে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ। তাছাড়া মংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে যোগাযোগের কারণে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে কর্মসংস্থানেরও যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হবে। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটবে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হবে পদ্মা সেতুকে ঘারে। রাজধানীর সীমানা পরিবর্ধিত হয়ে ঢাকা হয়ে উঠবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মনোহর নগরী। সারা বাংলাদেশের এমনকি বিশ্বেরও দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে পদ্মা বহুমুখী সেতুকে ঘিরে কীভাবে বাংলাদেশ তার আর্থসামাজিক অবস্থানকে পরিবর্তন ও সুদৃঢ় করছে।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু : কেউ ভাবতে পারেনি বিশাল পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মিত হবে, পদ্মার দুই পারের বিস্তীর্ণ এলাকার কোটি মানুষ সুন্দর সেতুর উপর দিয়ে যাতায়াত করবে। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণের পর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষ আশান্বিত হয়েছে কোনোদিন হয়তো পদ্মায়ও সেতু নির্মিত হবে। মানুষের এই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে স্বপ্ন দেখিয়েছে বর্তমান সরকার। স্বপ্নের পদ্মা সেতু হবে সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে কার্যকর একটি বহুমুখী সেতু। এটি দ্বিতলবিশিষ্ট, এর উপর দিয়ে চলবে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। এর আশপাশে থাকবে বাগান ও ফোয়ারা। উভয় তীরে গড়ে উঠবে পর্যটনকেন্দ্রিক স্থাপনা ও পরিবেশ। এ সেতুর নকশার ধরণাটাই এমন, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে রুচিসম্মত সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সবচেয়ে গর্বের কথা হলো, পদ্মা সেতুর দুই তীরে হংকয়ের আদলে শহর গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এটি হবে মানুষের মিলনমেলার এক অনুপম স্থাপত্য নিদর্শন ।

পদ্মা সেতুর অগ্রগতি : চীন থেকে এসেছে ভারী যন্ত্রপাতি। জার্মানি থেকে এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার। পাইলিং শুরু হওয়ার পর মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে। একে একে বসানো হয় ৪১টি স্প্যান। তারপর দ্বিতল সেতুর রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো শেষ হয় ২০২১ সালের ২০ জুন। আর সড়কপথের স্ল্যাব বসানো শেষ হয় ২৩ আগস্ট। এর মধ্য দিয়ে ৬.১৫ কি.মি. পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রকাশ পেল ।

২০১৮ সালেই সেতুর দুই প্রান্তের সঙ্গে সড়ক, টোলপ্লাজা এবং নির্মাণ অবকাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু সেতুতে

পিচঢালাই, স্থানে স্থানে মসৃণ করা এবং বাতি ও আলোকসজ্জার কাজ চলছে।

পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ২৩ জুন ২০২২ উদ্বোধনের জন্য পুরোদমে এখন ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে । দেওয়া হচ্ছে ১০০ মিলি পুরুত্বের দুই স্তরের কার্পেটিং।

উপসংহার : পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। বাংলাদেশ নানা কারণেই একটি লক্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্বশীল দেশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সচল অর্থনীতির সফল চাবিকাঠি পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে এ দেশের আরও একধাপ অগ্রগতি হবে। পৃথিবীর মানচিত্রে নিজ গৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

PDF ডাউনলোড করতে নিচের ডাউনলোড ফাইলে ক্লিক করুন

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *