সাইবার ক্রাইম মামলা করার নিয়ম, সাইবারক্রাইম এড়িয়ে চলার কয়েকটি পদ্ধতি
সাইবার ক্রাইম
আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আমাদের যতই সামাজিক যোগাযোগ করার সরকার হয়ে যাচ্ছে তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে বিভিন্ন অপরাধ। অর্থাৎ আমাদের অজান্তেই আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য ছবি অথবা ভিডিও অপব্যবহার করে কেউ ব্ল্যাকমেইল করে নানারকম হয়রানি করতে পারে। এক্ষেত্রে হয়তো আপনি নিজেও জানবেন না আপনার তথ্য বা ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং সেই থেকে অনেকে আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ধরনের অপরাধে সাধারণত সাইবার ক্রাইম বা সাইবার অপরাধ বলা হয়।
আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা লোকলজ্জার ভয়ে এইসকল ব্যাপারে প্রতিকার চাওয়া তো দূরের কথা সাধারণভাবে কারো কাছে প্রকাশ করতেও ভয় পান। এভাবে আমাদের মধ্যেই যে কেউ এই ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন। তাই আজকে আমরা জানার চেষ্টা করব সাইবার ক্রাইম কি। এবংসাইবার ক্রাইম মামলা করার নিয়ম, সাইবারক্রাইম থেকে বাঁচার উপায় সমূহ।
কি ধরনের সাইবার ক্রাইম হতে পারে
আপনার যে সকল সামাজিক অ্যাকাউন্ট রয়েছে যেমন সেটা হতে পারে আপনার ফেসবুক অথবা ইমেইল অথবা ইউটিউব এর তথ্য চুরি করে কেউ সেগুলো হ্যাক করতে পারে। অথবা কেউ আপনার নামে একটা ফেক আইডি খুলে সেখানে কিছু আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে আপনার সামাজিক অবস্থানকে হেম্পার করতে পারে। অথবা আপনাকে ফাঁসানোর জন্যে অন্য কারো ছবি আপনার নামে একটি আইডি খুলে সেখানে পোস্ট করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ভাবে আপনাকে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করে নিতে পারে। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁস এক ধরনের সাইবার ক্রাইম।
সাইবার ক্রাইম মামলা করার নিয়ম
আপনার সাথে যদি এই ধরনের সাইবার ক্রাইম হয় তখন আপনি যদি কারো কাছে প্রকাশ করতে না পারেন তবুও আপনার জন্য কয়েকটি রাস্তা খোলা থাকবে। নিম্নোক্তভাবে অভিযোগ করা যেতে পারে।
- আপনার নিকটস্থ থানায় গিয়ে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ দাখিল করতে পারেন
- ইমেইলের মাধ্যমে আপনি আপনার প্রতি সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে জানাতে পারেন cyberhelp@dmp.gov.bd এই ঠিকানায়।
- এছাড়া কেউ যদি সরাসরি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করে তবে সে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ডিভিশনের সাইবার ক্রাইম ইউনিট অফিসে গিয়ে সরাসরি কথা বলতে পারে /ঠিকানাঃ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ৩৬ শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্মরণী, রমনা, ঢাকা।
সাইবারক্রাইম এড়িয়ে চলার কয়েকটি পদ্ধতি
আপনি যদি নিজেকে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চান তবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো নিতে পারেন।
- যদি কাউকে অচেনা মনে হয় অথবা তার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না পান তবে তাকে ফেসবুকে আপনার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করবেন না।
- আপনার যে সকল ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন সেই সকল তথ্য ফেসবুকের কখনো পাবলিক করে রাখবেন না।
- আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে প্রাইভেসি সেটিংস চেক করুন
- অন্য কেউ যেন আপনাকে ট্যাগ করে পোস্ট করতে না পারে সেই অপশনটি বন্ধ করে রাখুন।
- কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কোন ধরনের উস্কানিমূলক ছবি বা ভিডিও শেয়ার করবেন না
- যদি কোন লিংক সন্দেহজনক হয় তবে সেই লিঙ্কে ক্লিক করবেন না।
- কখনোই কারো সাথে কোনো ধরনের পাসওয়ার্ড এবং লগইন করার আইডি শেয়ার করবেন না।
- সন্দেহজনক মেসেজ বা ইমেইল এর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই
- আপনার প্রিয়জনের কোন বিপদ বা দুর্ঘটনার কথা বলে যদি কেউ আপনার সাথে যোগাযোগ করে তবে আগে যাচাই করে নিবেন আপনার প্রিয়জনের সম্পর্কে।
- যদি কেউ লটারির লোভ দেখায় তবে এই সকল লুবের ব্যাপার থেকে নিজেকে সংযত রাখুন। এবং তারা যদি কৌশলে আপনার কাছ থেকে তথ্য নিতে চায় তবে সেই ব্যাপারে সচেতন থাকুন অথবা তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকুন।
- যদি কেউ সাইবার অপরাধ সংঘটিত করে তবে তার প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করা হয় সেজন্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন।
অভিযোগ করার পদ্ধতি
যখন কোন সংঘটিত সাইবার অপরাধ সম্পর্কে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে তথ্য দিতে যাবেন তখন বেশ কয়েকটি ব্যাপার আপনার মাথায় রাখতে হবে। যে অপরাধ সম্পর্কে আপনি তথ্য দিতে যাচ্ছেন তার কিছু তথ্য প্রমাণাদি আপনার সাথে রাখুন। সাইবার অপরাধ এর স্ক্রিনশট ভিডিও অডিও অথবা যেকোন ফাইল অথবা এই সংশ্লিষ্ট যে সকল তথ্য সংরক্ষণ করা যায় তা আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে জানিয়ে দিন। যদি ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করতে চান তবে কন্টাক্ট এ টাচ করে আপলোড করে দিন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সফট কপি দেয়া যেতে পারে। সর্বোপরি সাইবার ক্রাইম ইউনিট অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।
সাইবার অপরাধ বা সাইবার ক্রাইম এর কয়েকটি নমুনা
সাইবার বুলিং
কেউ যদি আপনাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জ্বালাতন করে এবং আপনার সম্মানহানি করার চেষ্টা করে তবে সেটা সাইবার বুলিং এর ক্ষেত্রে পড়ে। অর্থাৎ যদি অনলাইনের মাধ্যমে কোনো উপায়ে আপনাকে উত্তপ্ত করে তাহলে সেটা চাইবার বলেন। এক্ষেত্রে আপনি সরাসরি আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
আইডি হ্যাক
অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় ফেসবুক আইডি হ্যাক করে অনেকেই সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রাইভেট করা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিতে পারে। এক্ষেত্রেও আপনি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
সেক্সুয়াল এবিউস
সেক্সুয়ালি এবুকস করা হচ্ছে আরেক ধরনের সাইবার ক্রাইম। এমন হতে পারে যে আপনার ছবি ব্যবহার করে কেউ আইডি খুলতে পারে। সেই আইডি থেকে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল ছবি এবং কন্টাক্ট পোস্ট করতে পারে। এছাড়া আপনার ছবির সাথে কাটছাঁট করে অন্য কারো ছবি এনে জোড়া দিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারে। এবং আপনি যখন এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুজবে তখন আপনার কাছে বিপুল অঙ্কের টাকা আছে আপনাকে হেনস্থা করতে পারে। তাই আপনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকুন এবং এই ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
হ্যাকিং
অনলাইনে ডাটা বা তথ্য চুরির মাধ্যমে আপনার প্রতিষ্ঠানের সুনাম ধ্বংস করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধন করতে পারে। এই ধরনের সাইবার ক্রাইম কে বলা হয় হ্যাকিং। এই হ্যাকিং থেকে মুক্তির জন্য আপনার পাসওয়ার্ডটি বারবার পরিবর্তন করুন এবং শক্ত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। আপনার পাসওয়ার্ড কারো সাথে শেয়ার করবেন না। এবং এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করবেন না যা সহজে অনুমেয় যেমন আপনার নাম হতে পারে অথবা আপনার জন্ম তারিখ।
সাইবার ক্রাইম যেভাবে কমানো যেতে পারে
এক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। সাইবারক্রাইম ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের সাইবার ক্রাইম বিরোধী কর্মসূচি পালন করা যেতে পারে। জাঁ-লুপ রিসেটের (ইএসএসইসি আইএসআইএসে রিসার্চ ফেলো) মতে, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অভিগম্যতা সাইবার অপরাধ কে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। কারণ যারা হ্যাকিং করে থাকে তারা ধীরে ধীরে বিপুল পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছে এবং সেই জ্ঞান ব্লগিংয়ের মাধ্যমে শেয়ার করায় নতুনরাও এই ধরনের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে হ্যাকিং করতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে।
সাইবারক্রাইম বন্ধ করতে আইন প্রণয়ন
সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে যেহেতু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যথেষ্ট আইন নেই তাই হ্যাকাররা সাধারণত এই সকল দেশ বাছাই করে নেয়। তাই যে সকল দেশগুলোতে সাইবার ক্রাইম এর মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে নতুন নতুন আইন প্রয়োগ করে সাইবারক্রাইম কমানো যেতে পারে। শুধু আইন তৈরি করার মাধ্যমেই সাইবারক্রাইম কমানো যাবে না এর জন্য উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে জনসচেতনতা
সাইবারক্রাইম বন্ধ করতে জনসচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক মানুষের উপরে থাকে এবং সেখান থেকেই তথ্য চুরি হয়। তাই এই সকল তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকলে ভোগান্তির মাত্রা কমতে পারে।