বায়োফ্লক (Biofloc) পদ্ধতিতে মাছ চাষ
যেকোনো কাজে যদি আপনার সুন্দর পরিকল্পনা এবং সুষ্ঠু পরিচর্যা থাকে তবে সে কাজটি যেমন দেখতে ভালো লাগবে এবং আপনাকে তার সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিবে। কিন্তু যদি এমন হয় যে আপনি যে কাজটা করছেন সেটা তেমন পরিকল্পনা যুক্ত নয় এবং ঢিলেঢালা ব্যবস্থাতে কাজটি আপনি পরিচালনা করছেন তবে সেই কাজটি আপনাকে যেমন সফলতা এনে দিবে না তেমনি আপনাকে সম্মান এনে দিতে পারবে না। যেমন ধরুন আজকে আমি (biofloc) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ নিয়ে কথা বলবো। এটি হচ্ছে একটি সুন্দর পরিকল্পনা দ্বারা পরিচালিত মৎস্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা। যদি আপনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সুন্দর পরিচালনার মাধ্যমে (biofloc) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করেন তবে আপনি অধিকতর সফলতার সম্ভাবনা নিয়ে থাকবেন।
(Biofloc) বায়োফ্লক কি?
আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা (Biofloc) বায়োফ্লক শব্দটা শুনেছেন কিন্তু (Biofloc) বায়োফ্লক আসলে কি সে সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নাই। আবার (Biofloc) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ বলতে কি বুঝায় সেটি সম্পর্কেও ধারণা নাই। অথবা যারা বায়োফ্লক সম্পর্কে শুনেছেন (Biofloc) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে চান তারা জানতে চান (Biofloc) বায়োফ্লক আসলে কি। বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার আগে (Biofloc) বায়োফ্লক আসলে কি সেটা জানতেই হবে।বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করার আগে প্রথমেই আপনাকে জেনে নিতে হবে বায়োফ্লক আসলেই কি। চলুন আমরা জেনে নেই বায়োফ্লক সম্পর্কে। বায়ু অর্থ হচ্ছে জীবন এবং ফ্লক অর্থ হচ্ছে ভাসমান কনা। (Biofloc) বায়োফ্লক হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যেখানে একটি পাত্রে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয় এবং সেখানে কৃত্রিম ভাবে মাছ চাষ করা হয়। যেহেতু এখানে কৃত্রিম ভাবে মাছ চাষ করা হয় তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকার ব্যবস্থা থাকতে হয় কারণ এখানে প্রাকৃতিক পানি ব্যবহার করা হয় না। এর নাম বায়োফ্লক করা হয়েছে কারণ এখানে থাকা মাছ যে মলমূত্র ত্যাগ করে সেখান থেকে অ্যামোনিয়ার দারাজে ব্যাকটেরিয়া বা শৈবাল তৈরি হয় তা পানিতে উৎপন্ন নাইট্রোজেন ঘটিত জৈব বর্জ্য কে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে এমোনিয়া গ্যাস না হতে দিয়ে নিজেদের বংশ বাড়ায় এবং এটি হচ্ছে ক্লক। এই ফ্লক এ প্রচুর পরিমাণ পুষ্টি উপাদান থাকে এবং সেখান থেকে মাছ তাদের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে নেয়।
(Biofloc) বায়োফ্লক মাছ চাষে আসলে একটি কৌশল প্রয়োগ করা হয়ে থাকে সেটি হচ্ছে পানিতে কৃত্রিমভাবে অনুজীব এবং শৈবাল পানি থেকে নাইট্রোজেন শোষণ করে নেয় এতে যেমন একদিকে পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ এই উপাদানগুলো মাছ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বর্তমান সময়ে যেহেতু জমির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে তাই (Biofloc) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় এবং অল্প পানিতে অধিক মাছ ফলানো যায়। কারণ মাছ গুলো তাদের নিষ্কৃত নিজস্ব মলমূত্র কে গ্রহণ করে যে সকল ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব জন্মগ্রহণ করে তাদের কি মাছ আবার খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
(Biofloc) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সুবিধা
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এতে জমির পরিমাণ কম লাগে। কারণ একটি পুকুর খনন করতে গেলে বিশাল একটি জায়গার প্রয়োজন এবং তার চারপাশে যে পার থাকে সেটি অনেকটা জায়গা দখল করে নেয় ফলে পুকুরের আয়তন কমে যায়। কিন্তু বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে যেহেতু এটি কৃত্রিম জলাধার তাই পারের তেমন প্রয়োজন হয় না। এটা ইটের তৈরি একটা চৌবাচ্চা এর মত হতে পারে অথবা যদি কেউ চায় তবে আর রড দ্বারা জালাই করে একটা খাঁচার মতো তৈরি করে সেখানে শক্ত পলিথিনের মতো আবরণ ব্যবহার করে যেটা পানিকে বাহিরে আসতে দেবে না এরকম কাগজের ভিতর পানি দিয়ে মাছ চাষ করতে পারে।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ মাছ উৎপাদনের খরচ প্রায় 30 শতাংশ কমে যায়। কারণ এটি প্রাকৃতিক এবং পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া যেখানে মাছের খাবার অণুজীবগুলো সংরক্ষণ করে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে মাজ গুলো খুবই দ্রুততার সহিত বৃদ্ধি পায়। তাই অল্প সময়ে অধিক উৎপাদন সম্ভব যা একজন উদ্যোক্তা কে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা এনে দিতে পারে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ এর অসুবিধা
যেহেতু বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা টি একটি কৌশলগত ব্যাপার যারা এই কৌশলটি ভালোভাবে ধরতে পারবে না তারা বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে পারে। যেমন বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে গেলে আপনাকে নাইট্রোজেন এবং কার্বন এর তারতম্য খুব ভালোভাবে বুঝতে হবে। যদি নাইট্রোজেন এবং কার্বনের উপস্থিতি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে না পারেন তবে আপনার এই পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়বে। বায়োফ্লক পদ্ধতি যেহেতু একটি কৃত্রিম পদ্ধতি তাই এখানে একটি কৃত্তিম পানিপ্রবাহ তৈরি করতে হয় যেখানে সর্ব নিয়ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। যেহেতু সবাই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ব্যাপারটি এখনো পরিপূর্ণভাবে জানেনা তাই যদি সবকিছু মেনে ভালোভাবে না করতে পারে সেখানে লাভের চেয়ে বরং অনেকটা ক্ষতি হয়ে যাবে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে গেলে কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপার সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে এবং পানির রাসায়নিক অবস্থা বুঝার মত দক্ষতা থাকতে হবে।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে যেসকল মাছের চাষ করা যায়
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে আপনি এমন সব মাছ চাষ করতে পারেন যে মাছগুলো সাধারণত দীর্ঘজীবী হয়ে থাকে। দীর্ঘজীবী বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে যারা সাধারণত কঠিন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে। যেমন হতে পারে তেলাপিয়া শিং-মাগুর চিংড়িসহ আরো কিছু প্রজাতির মাছ।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে গেলে কি কি লাগে
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে প্রথমেই যা প্রয়োজন হবে তা হচ্ছে পানি ধরে রাখার মতো পর্যাপ্ত জায়গা। আপনি আপনার ঘরের ভিতরে বা বাহিরে যে কোন জায়গায় বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে পারবেন তবে তার জন্য আপনাকে একটি টেংকি অথবা চৌবাচ্চা প্রয়োজন হবে। টিডিএস মিটার, পিএইচপি মিটার, অ্যামোনিয়া টেস্ট কিট, বৈদ্যুতিক মোটর, বিদ্যুৎ, মাছের খাবার এবং প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে গেলে আপনার প্রয়োজন হবে।
বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষে কেমন লাভ হয়
আপনি যদি বায়োফ্লক পদ্ধতিতে খুব ভালোভাবে মাছ চাষ করতে পারেন তবে আপনার লাভের অংশ টাই বেশি থাকবে। কারণ যেহেতু খাবার খরচ কম এবং কম জায়গায় আপনি অধিক মাছ চাষ করতে পারতেছেন তাই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে লাভ থাকে। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা অল্পতেই বেশি লাভের আশায় না জেনেই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে আসে তারা সাধারণত ক্ষতির সম্মুখীন হন।
বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে কত দিন পরে মাছ বিক্রির উপযোগী হয়
মৎস্য কর্মকর্তা মাইমুনা জাহান জানান, যদি কেউ সঠিক পদ্ধতিতে এবং সঠিক নিয়ম মেনে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে তবে সাধারণত তিন মাসের মধ্যেই মাছগুলো বিক্রির উপযোগী হয়। যেহেতু পুকুরের চেয়ে বায়োফ্লক এ মাছগুলো খুব বেশি কাছাকাছি থাকে তাই খাবার অপচয় যেমন হয় না তেমনি সবগুলো খাবার মার্কেটে পাড়ায় মাছের ওজন টা খুব তাড়াতাড়ি আসে।
আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করেছে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ সম্পর্কে। শুধু একটি আর্টিকেল পড়ে আপনি বায়োফ্লক এর মাধ্যমে মাছ চাষের ব্যাপক এবং বিস্তারিত জানতে পারবেন না। আপনি যদি বায়োফ্লক এর মাধ্যমে মাছ চাষ করতে চান তবে সবচেয়ে ভালো হবে যারা বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করেছে তাদের কাছ থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা নেওয়া। আপনি বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে এমন একটি মৎস্য খামারে কিছুদিন যদি ভিজিট করেন অথবা তাদের কার্যক্রম গুলো পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে আপনি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন সেই অভিজ্ঞতা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। কারণ এই অভিজ্ঞতা যদি আপনি পরিশ্রম করতে পারেন তাহলে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে আপনি ঠকবেন না বরং আপনার প্রতি মাসে কিছু-না-কিছু লাভ থাকবেই।