Blog

গরু মোটাতাজাকরণ

1 min read

গরু মোটাতাজাকরণ

গৃহপালিত পশুদের মধ্যে গরু মোটাতাজা করে বিক্রয় করা খুবই লাভজনক । কেননা খুব অল্প সময়ে অল্প পুজিতে অল্প খরচে গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করলে ভালো মানের দাম পাওয়া যায়। অল্প সময়ে ষাঁড় বাছুর কে সুষম খাদ্য খাওয়ায়ে দৈহিক বৃদ্ধি করে গরু মোটাতাজা করা হয়। তাই আজকে আমাদের আর্টিকেলের বিষয়টি হলো গরু মোটাতাজাকরণ

কতটা লাভজনক গরু মোটাতাজাকরণ

গৃহপালিত পশুদের মধ্যে গরু পালনে এখন সবচেয়ে বেশি লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি। যেহেতু আমাদের বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম এবং বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব কুরবানীর ঈদে বিপুল পরিমান চাহিদা তো রয়েছেই, তাছাড়া মানুষ এখন প্রচুর মাংস খায়। আর মাংসের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গরুর মাংস।

সারা বিশ্বেই কিন্তু জনপ্রিয়তার দিক থেকে গরুর মাংস এক নম্বরে। সুতরাং দেশের পাশাপাশি গরুর মাংস রপ্তানি করারও কিন্তু বড় সুযোগ আছে। তাছাড়া গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্প দুগ্ধ খামারের (ডেইরি) চেয়ে কম ঝুঁকির। খরচও কম। কারণ গাভীর যত্ন, চিকিৎসা ও খাবারের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয়। আবার দুধের বাজার এখনো অনিশ্চিত। দেশের বেশিরভাগ ছোট ও মাঝারি খামরিকে দুধের দৈনিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। ফলে এসব খামারির এক একটা দিন শুরু হয়ই অনিশ্চয়তা নিয়ে। কিন্তু মোটাতাজাকরণ খামারে সে ঝামেলা নেই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে যারা ধীরে ধীরে এগোতে চান তাদের জন্য প্রায় নিশ্চিত লাভের উদ্যোগ হতে পারে গরু মোটাতাজাকরণ খামার। আর এ ধরনের খামার থেকে একসাথে বড় অংকের টাকা হাতে আসে। ফলে চাইলে খুব দ্রুতই বড় উদ্যোগ নেওয়ার সামর্থ্যও তৈরি হয়।তবে আমাদের দেশের বেশিরভাগ গরু মোটাতাজাকরণ খামারিরা বিদেশি গরু পালন করে থাকে ।

গরু মোটাতাজাকরণ খামারি বেশি লাভের আশায় শুধু বিদেশী জাতের বড় সাইজের গরু পালন করতে চান। তারা এক গরুতেই এক মৌসুমে 10 থেকে 15  লাখ টাকা তুলে আনার স্বপ্ন দেখেন। এ কারণে আজকাল কুরবানীর ঈদের বাজারে প্রায়ই বিশাল আকৃতির হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান ষাঁড় দেখা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এ ধরনের গরু পালন করা বেশ পরিশ্রমের ও ব্যয়সাপেক্ষ। এসব গরুর রোগবালাইও বেশি। গরমের সময় দিনের দুতিনবার গোসল করানোর পরও ২৪ ঘণ্টা দিনরাত ফ্যান চালিয়ে রাখতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এসব গরু বিক্রি করা।

কেননা এতো বড় গরু তো কোটিপতি ব্যবসায়ী শিল্পপতি ছাড়া কেউ কিনতে চায় না। তাই বিক্রি করতে হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম নিতে হয়। কিন্তু আজকাল মানুষের মধ্যে একা একটা গরু কুরবানী দেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন কুরবানীর হাটে এখন ছোট বা মাঝারি সাইজের দেশী বা সঙ্কর জাতের ষাঁড় বেশি বিক্রি হয়। দামও ভালোই পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, এখন দেশী কিছু সঙ্কর জাতের ষাঁড় দিয়ে গরু মোটাতাজাকরণ শুরু করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর দেশী গরুর খাবার খরচ যেমন কম, এদের রোগবালাইও একেবারে কম। ফলে কম বিনিয়োগে বেশি লাভ করতে পারবেন।

দেশী বা সঙ্কর গরু মোটাতাজাকরণের কিছু সুবিধা

  • অল্প সময়ে (৪-৬ মাস) অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়।
  • মূলধন বা পুঁজি দ্রুত ফেরত আসে।
  • আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি কম।
  • খরচের তুলনায় লাভ বেশি।
  • বেকারত্ব ও দারিদ্রতা দূর করা যায়।
  • রোগব্যাধি কম হয়।

বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় উৎসব হল ঈদুল আজহা।ঈদুল আজহার ৩/৪ মাস আগে গরু মোটাতাজা করার কাজ শুরু করলে লাভবান হওয়া যায়। গরু মোটাতাজা করার জন্য গরু নির্বাচন, গরুর বাসস্থান নির্মাণ, কৃমি মুক্তকরণ, গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্য খাওয়াতে হয়।

গরু নির্বাচন

গরু মোটাতাজাকরণের জন্য গরু নির্বাচন করার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এবং খুব সতর্কতার সাথে কোন গরুটাকে নির্বাচন করতে হবে। কেননা গরু মোটাতাজাকরণের পদ্ধতিটি ওই গরুটার উপর প্রয়োগ করা যাবে কি না মাথায় রাখতে হবে। মাংসের গরুর জন্য উন্নত দেশের বিশেষ জাত রয়েছে। বিদেশি গরুর জন্য উন্নত খাদ্য ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তাই দেশীয় গরু মোটাতাজাকরণ অধিক লাভজনক। ২-২.৫ বছরের গরুর শারীরিক বৃদ্ধি ও গঠন মোটাতাজাকরণের জন্য বেশি ভালো। এঁড়ে বাছুরের দৈহিক বৃদ্ধির হার বকনা বাছুরের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তবে বাছুরের বুক চওড়া ও ভরাট, পেট চ্যাপ্টা ও বুকের সঙ্গে সমান্তরাল, মাথা ছোট ও কপাল প্রশস্ত, চোখ উজ্জ্বল ও ভিজা ভিজা, পা খাটো প্রকৃতির ও হাড়ের জোড়াগুলো স্ফীত, পাঁজর প্রশস্ত ও বিস্তৃত, শিরদাঁড়া সোজা হতে হবে।

গরু মোটাতাজাকরণের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা খুবই জরুরী

গরুটা রোগাক্রান্ত কিনা ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। গরুর রক্ত, মল, জিহবা, পায়ের ক্ষুর, নাড়ীর স্পন্দন ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হবে। বিভিন্ন রোগের টিকা দিতে হবে।

গরু মোটাতাজাকরণ ঔষধ তালিকা

প্রোবায়োটিকস, প্রিবায়োটিকস ও মিনারেল সাপ্লিমেন্টস

জৈব পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণ ঔষধ। প্রোবায়োটিকস, প্রিবায়োটিকস ও মিনারেল সাপ্লিমেন্টস গরুর পাকস্থলির মাইক্রোফ্লোরা ও উপকারি ব্যাকটেরিয়ার উন্নতি ঘটায় বা সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ফলে গরুর দীর্ঘ দিন খাবারের রুচি ভালো থাকে এবং পুষ্টিগুণও শোষিত হয় ভালো ফলে গরুর বৃদ্ধি ভালো থাকে। বাজারে এধরণের প্রোবায়োটিকস, প্রিবায়োটিকস ও মিনারেল সাপ্লিমেন্টস বিভিন্ন কম্পাণির বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়।আপনি চাইলে এসকল নিউট্রেশনাল ঔষধ এক বা একাধিক বার গরুকে খাওয়াতে পারেন। যেমন- বায়োলাক বোলাস, এসিলাক প্লাস বোলাস, বায়োগাট পাওডার ইত্যাদি।

লিভার টনিক

গরু মোটাতাজাকরণ ঔষধ এর মধ্যে লিভার টনিক অন্যতম। মোটাতাজাকরণের গরু কৃমি মুক্ত করণের পর পর বা যেকোন সময় গরুকে এই লিভার টনিক খাওয়ানো যায়। লিভার টনিক গরু মোটাতাজা করণে ও গরু সুস্থ্য রাখতে দারুন কাজ করে। নিম্নে কিছু লিভার টনিকের নাম দিচ্ছি আপনি চাইলে যেকোন একটি এক বা একাধিক বার খাওয়াতে পারেন।

  1. হেপাএমাইন ১০০ মিলি (এসিআই এনিমেল হেল্থ)
  2. লিভা ভেট ১০০ মিলি (স্কয়ার)
  3. লিভাটন ১০০ মিলি (গ্লোব ফার্মাসিটিক্যালস)
  4. সুপারলিভ ১ লিটার (এবিআই)
  5. রেনালিভ ১ লিটার (রেনাটা)

ক্যালসিয়াম

গরু মোটাতাজাকরণ ঔষধ হিসাবে ক্যালসিয়মের ব্যবহার প্রচুর হয়ে থাকে। ক্যালসিয়াম গরুর শরীরের হাঁড়ের গঠন শক্ত, মজবুত ও মোটা করে। গরুর শারীরিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ষাঁড় গরু সাধারনত ঘাস ও দানাদার খাদ্য থেকে ক্যালসিয়াম গ্রহন করে। যদি পর্যাপ্ত কাঁচা ঘাসের অভাব বা দানাদের খাদ্যে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়ামের অভাব থাকে তাহলে অবশ্যই গরুকে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে হবে। নিম্নে কিছু ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টের নাম উল্যেখ করলাম এর যেকোন একটি খাওয়ালে চলবে।

  1. রেনাক্যাল পি, ১ লিটার ও ৫ লিটার (রেনাটা)
  2. সানক্যালভেট ওরাল, ১ লিটার ও ৫ লিটার (এলানকো)
  3. ক্যালভেট পি, ১ লিটার (এসিআই)
  4. ডিসিপি প্লাস ১ কেজি, ৫ কেজি ও ১০ কেজি (অপসোনিন)
  5. ডিসিপি গোল্ড ১ কেজি ও ৫ কেজি (এসিআই)
  6. ভিটামিন, মিনারেল ও এমায়নো এসিড সাপ্লিমেন্ট

গরু মোটাতাজাকরণ ঔষধ

গরুর শরীরে কোন একটি ভিটামিনের অভাব থাকলে আশানুরুপ উৎপাদন আসবে না। আর তাই দুই থেকে তিন মাস পর পর প্রতিটি গরুকে তিন থেকে পাঁচ দিন ভিটামিন, মিনারেল ও এমায়নো এনিড সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে হবে। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং গরুর মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।এর মধ্যে এগুলি অন্যতম,

  1. রেনাভিট ডিবি (রেনাটা)
  2. মেগাভিট ডিবি (এলানকো)
  3. ক্যালফসটনিক (এসিআই)
  4. ডিবি ভিটামিন (স্কয়ার)

মানুষের ধারণা হল গরু মোটাতাজাকরণের জন্য বিশেষ কোন ঔষধের প্রয়োগ করতে হয়। এটা একদমই ভুল ধারনা। আসলে এ কাজের জন্য গরুকে আলাদা কোন বিশেষ কিছু খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। একটা গরুর স্বাভাবিক যে পরিচর্যার প্রয়োজন হয় অনেকে বিশেষ ধরনের হরমোন ও স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ খাইয়ে থাকে, যা কখনোই উচিত নয় । এতে গরু হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যেতে পারে বা গরুর যকৃৎ স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং তলপেটে পানি জমতে পারে। এছাড়া এটা জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

বাসস্থান নির্মাণ

প্রতিটি গরুর জন্য দৈর্ঘ্য ৮ ফুট, প্রস্থ ৬ ফুট ও উচ্চতা ৮ ফুট জায়গা প্রয়োজন। ঘরের ভেতর আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা। ঘরের মেঝে একদিকে ঢালু রাখা। ঘরের ভেতর খাদ্য ও পানি পাত্র থাকবে।

কৃমিমুক্তকরণ

গরু ক্রয় করার পরেই গরুর পেট থেকে কৃমি মুক্ত করতে হবে। অন্যথায় গরুর খাদ্যের বিরাট অংশ খেয়ে গরুকে পুষ্টিহীন ও রক্ত শূন্য করে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমির ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।

সুষম খাদ্য খাওয়ানো

সঠিক পরিমাণে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ালে ষাঁড় বাছুরের ওজন প্রতিদিন প্রায় এক কেজি পর্যন্ত বাড়ে। ১০০-১৫০ কেজি ওজনের একটি ষাঁড় বাছুরকে প্রতিদিন ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড় ৩-৪ কেজি, সবুজ কাঁচা ঘাস ১০-১২ কেজি, চালের কুঁড়া ১ কেজি, গমের ভুসি ১.২৫ কেজি, তিলের খৈল ৪০০ গ্রাম, হাড়ের গুঁড়া ৫০ গ্রাম, লবণ ৫০ গ্রাম ও ঝোলাগুড় ২৫০ গ্রাম খাওয়াতে হয়। পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে। ইউরিয়া ও খড় প্রক্রিয়াজাত করার ৭ দিন পর খাওয়াতে হবে। অন্যথায় বিষাক্ততা দেখা দিবে। এক বছরের কম বয়সের বাছুর কে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। অন্য কোনভাবে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না।

গরু মোটাতাজাকরণের পর গোসত কতটুকু হবে মাপার জন্য সূত্র হচ্ছে:

গরুর ওজন (কেজি) = ০.০০০১ Xদেহের দৈর্ঘ্য সেমি X {বুকের বেড় (সেমি)}২। গরুর কাঁধ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দেহের দৈর্ঘ্য। বুক বরাবর পরিধি ফিতা দিয়ে মেপে বুকের বেড় পরিমাপ করা যায়। এই মান সূত্রে বসিয়ে হিসেব করে গরুর ওজন নির্ণয় করা যায়।

গরু মোটাতাজাকরণের সময়

গরু মোটাতাজা করার উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর/জানুয়ারী অথবা জুন/জুলাই। এ সময় আবহাওয়া একটু ঠান্ডা থাকে বলে রোগব্যধি কম হয়। তবে বর্ষাকাল ছাড়া যেকোন সময়ই করা যায়। ঈদুল আজহার ৩/৪ মাস আগে গরু মোটাতাজাকরণ শুরু করলে লাভবান হওয়া যায়।

আশা করি আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন গরু মোটাতাজা করনের পদ্ধতি সম্পর্কে।ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন এবং গরু মোটাতাজাকরণের পদ্ধতিটি ভালোভাবে প্রয়োগ করবেন।

Rate this post
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

Leave a Comment

x