আয়রন সমৃদ্ধ খাবার এর তালিকা দেখে নিন কাজে লাগবে
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়টি হলো আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
শরীরে রক্ত উৎপাদনের জন্য আয়রন অতি দরকারী।এটি মেটাবলিজমে সহায়তা করে। আমাদের শরীর পর্যাপ্ত আয়রন না পেলে রক্তস্বল্পতায় ভুগতে পারে। রক্তস্বল্পতা থেকে ক্লান্তি, বমিভাব ও হার্টে সমস্যা (যেমন- অনিয়মিত হার্টবিট) হতে পারে। একারণে চিকিৎসকেরা গর্ভবতী নারী, ঘন মাসিকের নারী, শিশু বা অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে, মাংস বর্জনকারী লোক, ঘনঘন রক্তদাতা, পরিপাকতন্ত্রের রোগী ও কিছু ক্যানসার রোগীদের আয়রন সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করেন।
শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে দুর্বল ও ক্লান্ত লাগার পাশাপাশি মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। সাধারণত শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের আয়রনের ঘাটতি জনিত অ্যানেমিয়া হয়ে থাকে। আয়রনের ঘাটতি পূরণের জন্য প্রাণীজ আয়রন ও উদ্ভিজ আয়রন এই দুই ধরণের আয়রন গ্রহণ করা জরুরি।একজন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন পুরুষ মানুষের জন্য দৈনিক ৮ মিলিগ্রাম ও নারীদের জন্য প্রয়োজন ১৮ মিলিগ্রাম আয়রন। এছাড়া গর্ভবতী মহিলাদের শরীরে দৈনিক ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন হয়। তাই মিনারেলটির সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না। আপনি ডায়েটে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার সংযোজন করে দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে পারেন। এখানে আয়রন সমৃদ্ধ খাবারের তালিকা দেয়া হলো।
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
কলিজা একটি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
কলিজা অনেকেরই পছন্দের খাবার নয়, কিন্তু এটা হলো আয়রনের অন্যতম সর্বোত্তম উৎস। ৪ আউন্স কলিজাতে ৭ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি১২ এবং প্রোটিনও পাওয়া যায়। সাবধান, এতে উচ্চ পরিমাণে কোলেস্টেরলও রয়েছে। তাই বেশি পরিমাণে বা প্রতিদিন কলিজা খাবেন না। সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি কমিটি অন নিউট্রিশনের মতে, প্রতিসপ্তাহে একবারের বেশি কলিজা খাওয়া উচিত নয়।
গরুর মাংস
গরুর মাংসে দৈনিক প্রয়োজনীয় আয়রনের ১০ থেকে ২৪ শতাংশ পাওয়া যায়। মাংসের আয়রনকে হিমি আয়রন বলা হয়, যা শরীরে উদ্ভিজ্জ আয়রনের চেয়ে ভালোভাবে শোষিত হয়। মাংস খেতে না চাইলে আপনার ডায়েটে সেসব খাবারের পরিমাণ বাড়ান যা একজন ভেজিটারিয়ান আয়রনের চাহিদা মেটাতে খেয়ে থাকেন।
ফর্টিফায়েড সিরিয়াল
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মতে, নন-হিমি আয়রনের একটি উৎকৃষ্ট উৎস হলো ফর্টিফায়েড ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল। বিশেষ করে যারা মাংস এড়িয়ে চলেন তাদের জন্য এই খাবার শরীরে প্রয়োজনীয় আয়রন যোগাতে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। এক বাটি ফর্টিফায়েড সিরিয়ালে দৈনিক প্রয়োজনীয় আয়রনের ১০০ শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব। এর পাশাপাশি এক গ্লাস ভিটামিন সি সমৃদ্ধ অরেঞ্জ জুস পান করুন, যা শরীরকে আয়রন শোষণে সাহায্য করবে। পরামর্শটি দিয়েছে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক
রাজমা
মাংস অনাহারীদের জন্য নন-হিমি আয়রনের আরেকটি সমৃদ্ধ উৎস হলো রাজমা বা কিডনি বিনস। এক বাটি রাজমাতে প্রায় ৩ মিলিগ্রাম আয়রন পেতে পারেন।
মুরগির মাংস
আয়রনের অন্য একটি ভালো উৎস হলো মুরগির মাংস। হোয়াইট মিটের চেয়ে ডার্ক মিটে আয়রন একটু বেশি থাকে। মুরগির এক বাটি ডার্ক মিটে (পা বা উরুর মাংস) দৈনিক প্রয়োজনীয় আয়রনের ৮ শতাংশ পাওয়া যায়।
পালংশাক আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
বাজারে বা রাস্তায় পালংশাক চোখে পড়লেই কিনে ফেলুন, কারণ এটি হলো নন-হিমি আয়রনের একটি সর্বোৎকৃষ্ট উৎস। এক বাটি পালংশাক খেয়ে শরীরে ৪ মিলিগ্রাম আয়রন সরবররাহ করতে পারবেন। কেবল আয়রন নয়, শাকটিতে উচ্চ মাত্রায় অন্যান্য পুষ্টিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এক বাটি পালংশাকে আমাদের শরীরে প্রতিদিন যতটুকু ম্যাগনেসিয়াম প্রয়োজন তার ৪০ শতাংশ পাওয়া যায়।
ডিমের কুসুম
ডিমের সাদাংশের তুলনায় কুসুমেই সবচেয়ে বেশি পুষ্টি থাকে। একটি মধ্যম আকারের ডিমের কুসুম থেকে ০.৫ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়- ডিমের কুসুমে স্বাস্থ্যকর চর্বি, কোলাইন, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডি, ফোলেট ও সেলেনিয়ামও রয়েছে।
মসুর ডাল
আপনার জন্য সবচেয়ে বড় চমক মসুর ডালেই। এক বাটি মসুর ডালে প্রায় ১৪ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে। একারণে সম্ভবত এটাই শাকাহারীদের জন্য আয়রনের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উৎস।
কাজুবাদাম
সকল বাদামই আয়রনের ভালো উৎস, কিন্তু সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কাজুবাদামে। প্রতি আউন্স (প্রায় ১৭টি) কাজুবাদামে প্রায় ২ মিলিগ্রাম আয়রন পেতে পারেন। কাজুবাদামে ভলো পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, কপার, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ ও ফাইটেটসও পাবেন।
শিমের বিচি
শরীরে আয়রন যোগানোর একটি সুস্বাদু উপায় হলো শিম ও শিমের বিচি খাওয়া। আপনার জন্য আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, এক বাটি রান্নাকৃত শিমের বিচিতে প্রায় ৫.৪ মিলিগ্রাম আয়রন রয়েছে। শিমের বিচিকে রান্না করে অথবা ভেজে যেভাবেই খান না কেন, আয়রন পাবেন। আধ বাটি ভাজা শিমের বিচিতে প্রায় ২ মিলিগ্রাম আয়রন পাওয়া যায়।
টার্কি মুরগির মাংস
টার্কি মুরগির মাংস আয়রনসমৃদ্ধ সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর খাবার। সাদা টার্কি মুরগির চেয়ে ডার্ক টার্কি মুরগির মাংসে বেশি পরিমাণে আয়রন প্রোটিন থাকে। ডার্ক টার্কি মুরগির মাংসে জিংক, সেলেনিয়াম ও ভিটামিন বি এর কয়েকটি উপাদান রয়েছে যেগুলো সচরাচর লাল মাংসে পাওয়া যায়। টার্কি মুরগির মাংস খেলে মিটবে প্রোটিন ও আয়রনের চাহিদা।
সামুদ্রিক মাছ
সব ধরনের মাছেই আয়রন রয়েছে, তবে সামুদ্রিক মাছে আয়রনের পরিমাণ বেশি। মাছ আমিষের কারণে আমাদের কাছে পরিচিত হলেও এতে রয়েছে আমাদের শরীরের জন্য উপকারী আরও নানা পুষ্টি উপাদান।ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডসিড এক ধরনের স্বাস্থ্যকর চর্বি যা সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড হার্টের জন্য অনেক উপকারী। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখে। ফলে হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
এই স্বাস্থ্যকর চর্বি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। সমস্যা হলো সব জায়গায় সব সময় সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় না। আমাদের দেশি মাছেও আয়রন রয়েছে। তাই আয়রন ও আমিষের জন্য প্রতিদিন দেশি মাছ খাওয়া উচিত।
কুইনোয়া বা কাউন চাল
কাউন চাল হলো শস্যজাতীয় খাবার। অন্যান্য শস্য জাতীয় খাবারের তুলনায় কাউন চালে আমিষের পরিমাণ বেশি। কাউন চালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আয়রন থাকে। আয়রন ছাড়াও ফোলেট, ম্যাগনেসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ও অন্যান্য পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার হলো কাউন চাল। তাই আয়রন ও প্রোটিনসহ উল্লেখিত পুষ্টি উপাদান গুলো পেতে কাউন চাল খেতে পারেন।১৮৫ গ্রাম রান্না করা কাউন চালে প্রায় ২.২ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে।
ডার্ক চকোলেট
ডার্ক চকোলেট নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি মজাদার খাবার। ডার্ক চকোলেটে রয়েছে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের ভালোর জন্য ছোট বড় সবাই ডার্ক চকোলেট খেতে পারেন।এতে রয়েছে প্রিবায়োটিক ফাইবার। এই প্রিবায়োটিক ফাইবার আমাদের পেটে থাকা উপকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজন। তাছাড়া ডার্ক চকোলেটে আয়রন, কপার ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে প্রচুর পরিমাণে।ডার্ক চকোলেট কোলেস্টেরলের ভারসাম্য ঠিক রাখে যার ফলে হূদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। তবে সব ডার্ক চকোলেট সমান ভাবে তৈরি হয় না।মাত্র ২৮ গ্রাম ডার্ক চকোলেটে ৩.৪ গ্রাম আয়রন থাকে।
টেনিন একটি আয়রন সমৃদ্ধ খাবার
চায়ে টেনিন নামক এক ধরনের যৌগ থাকে। টেনিন আমাদের শরীরে আয়রন শোষণের হার হ্রাস করে। তাই খাবার গ্রহণের পর চা পান না করলে ভালো।
সোয়াবিন
সোয়াবিন শুধু আয়রনেরই উত্স নয়, এতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও সেলেনিয়ামও রয়েছে। নিয়মিত সোয়াবিন খেলে হার্টের অসুখ, ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। ভাল থাকে হাড়ের স্বাস্থ্যও।
ড্রাই ফ্রুট
ব্রেকফাস্টে খাবারের সঙ্গে খান কিসমিস, অ্যাপ্রিকট, কাজু বা আমন্ড। এই ধরনের খাবারে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। যা শরীরকে আয়রন শুষে নিতে সাহায্য করে। ব্রেকফাস্ট ছাড়াও দিনের অন্য সময় এক মুঠো বাদাম আপনার আয়রনের ঘাটতি মেটাতে পারে।
বিটরুট
আয়রনের ঘাটতি পূরণের ভালো উৎস এই সবজি। শীতকালীন এই সবজিতে আয়রন ছাড়াও রয়েছে কপার, প্রোটিন, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, সালফারসহ আরও অনেক উপাদান।
ব্রোকলি
জনপ্রিয় এই সবজি সুপার ফুড হিসেবে পরিচিত। এতে ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, আয়রন ফলিত,জিংক এবং ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে। এটি সেদ্ধ বা সাতলিয়ে খেলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
বাঁধাকপি
শীতকালীন আরেকটি জনপ্রিয় এই সবজিতে আয়রন, অনেক প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান রয়েছে। আয়রনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি এটি ওজন কমাতে, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক পেতে, ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান দূর করতে সহায়তা করে।
বেদানা
এই ফল শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এটি আয়রন, ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবারের ভালো উৎস। এতে থাকা এসকর্বিক অ্যাসিড শরীরে রক্ত চলাচলে সহায়তা করে।
আপেল
এটি আয়রনের ভালো উৎস এবং পুরো স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে।
কমলা
ভিটামিন সি এর ভালো উৎস এই ফল শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক পেতে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং দেহে পুষ্টি জোগাতে সহায়তা করে।
আয়রন আমাদের শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি খনিজ লবণ। শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে তাকে অ্যানিমিয়া বলা হয়। তাই অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে অর্থাৎ শরীরে আয়রনের ঘাটতি প্রতিরোধে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গুলো পর্যাপ্ত পরিমানে খেতে হবে।গর্ভাবস্থায় আয়রনের চাহিদা বেশি থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় ডায়েট চার্টে উচ্চ আয়রন সমৃদ্ধি খাবার গুলো রাখতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আয়রন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।