সিয়াম কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কি কি
প্রশ্ন: সিয়াম কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? পূর্ববর্তী উম্মাতের উপর কি সিয়াম ফরজ ছিল? এই উম্মাতের উপর কখন থেকে সিয়াম ফরজ করা হয়েছে?
▬▬▬▬▬▬▬▪️????▪️▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: রামাযান’ হিজরী চান্দ্রবর্ষের আরবী মাসের নবম মাস। رَمَضَانُ শব্দটি মূল শব্দ رَمَضَ হতে নির্গত। রামাদ্বন বা রমজান শব্দের অর্থ হলো অর্থ পুড়ে যাওয়া,জ্বলে যাওয়া,তীক্ষ্ম, প্রখর,আগুনে ঝলসানো। যেমন বলা হয়- رَمِضَتِ اَلْاَرْضُ ‘যমীন সূর্যতাপে পুড়ে গেছে’, رَمِضَتْ قَدَمُه ‘তার পা গরমে পুড়ে গেছে’, رَمِضَ الصَّائِمُ সায়েমের পেট ক্ষুৎ-পিপাসায় জ্বলে যাওয়’,কাবাব বানানো, ঘাম ঝরানো, চর্বি গলানো, জ্বর, তাপ ইত্যাদি।অতএব অধিক জ্বলে পুড়ে খাক হওয়াকে রামাযান رَمَضَانُ বলা হয়। কেননা রামাদ্বনে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় সিয়াম পালনকারীর পেটে আগুন জ্বলে; পাপতাপ পুড়ে ছাই হয়ে সিয়াম পালনকারী নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এ মাসের নাম রামাদান।(আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৩; আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব, পৃ. ৮৩১)। সাওম পালনকারীকে ‘সায়েম’ বলা হয়। ফার্সিতে বলা হয় রোযা এবং রোযা পালনকারীকে বলা হয় রোযাদার। এর শাব্দিক অর্থ হল পানাহার ও নির্জনবাস থেকে বিরত থাকা। অভিধানে শব্দটির অর্থ সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোন কিছু থেকে বিরত থাকা। সাওম পালনকারীকে ‘সায়েম’ বলা হয় এজন্য যে সে খাদ্য, পানীয় ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থেকেছে। আর চুপ থাকা ব্যক্তিকে ‘সায়েম’ বলা হয়, কেননা সে কথা বলা থেকে বিরত থেকেছে। এমনিভাবে যে ঘোড়া খাদ্য খাওয়া থেকে বিরত রয়েছে তাকেও ‘সায়েম’ বলা হয়। ইবন আরাবী রহ. বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যখন গাছের নিচে ছায়া নিচ্ছে তখন তাকে বলা হয় ‘সমার রজুল।”(লোকটি) ছায়ায় থেকে চলাফেরা থেকে বিরত থেকেছে। লাইস (রহ.) বলেছেন, সাওম হলো খাদ্য ও কথা বলা থেকে বিরত থাকা।” যেমন: কুরআনে এসেছে, অতঃপর তুমি খাও, পান কর এবং চোখ জুড়াও। আর যদি তুমি কোনো লোককে দেখতে পাও তাহলে বলে দিও, ‘আমি পরম করুণাময়ের জন্য চুপ থাকার মানত করেছি। অতএব, আজ আমি কোনো মানুষের সাথে কিছুতেই কথা বলব না।” (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ২৬)। ঘোড়া যখন খাদ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকে তাকে বলা হয় ‘সমাল ফারাস’, আবার সাওম অর্থ কোনো কাজ না করা। বলা হয়, ‘সমাতির রিহ’ বাতাস যখন থেমে থাকে। সুফিয়ান ইবন উয়াইনাহ (রহ.) বলেছেন, সাওম অর্থ ধৈর্য। কেননা মানুষ খাদ্য, পানীয় ও স্ত্রী সহবাস থেকে ধৈর্য ধারণ করে। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পড়েন, কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে কোনো হিসাব ছাড়াই। (সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১০ তাহযীবুল লুগাহ ১২/১৮২, লিসানুল আরব: ১২/৩৫০)
.
পরিভাষায় রামাযান হল সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়াম রাখার নিয়তে পানাহার, সমস্ত খাদ্যদ্রব্য ও স্ত্রী সম্ভোগ হতে বিরত থাকা। (কিতাবুল ফিক্বহিল মুইয়াসসার, পৃ. ১৪৯ ‘সিয়াম’ অধ্যায়-৪)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সিয়ামের নিয়তে খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নামকে সিয়াম বলে।’ (ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-১১৪৫)। শরী‘আতে ঈমান, সালাত ও যাকাতের পরেই সাওমের স্থান। যা ইসলামের চতুর্থ রুকন।
▪️সিয়ামের প্রকারভেদ :
_______________________
সিয়াম সর্বমোট চার প্রকার। যথা: (১). ফরজ সিয়াম (২). নফল সিয়াম (৩). মাকরূহ সিয়াম (৪). হারাম সিয়াম।
.
প্রথমত: ফরয সিয়াম আবার ৪ প্রকার। যেমন: (ক). রামাযান মাসের সিয়াম (খ). ফরজের কাযা সিয়াম (গ). কাফফারার সিয়াম এবং (ঘ). মান্নতের সিয়াম।
.
দ্বিতীয়ত: নফল সিয়াম আবার কয়েক ধরনের। যেমন: (ক). শাওয়াল মাসের ছয়টি সিয়াম। (খ). যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের সিয়াম। (গ). আরাফাতের দিনের সিয়াম। (ঘ). মুহাররম মাসের সিয়াম। (ঙ). আশুরার সিয়াম। (চ). প্রতি চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫- এ তিন দিনের সিয়াম (ছ). সাপ্তাহিক সোম ও বৃহস্পতিবারের সিয়াম। (জ). শাবান মাসের সিয়াম। (ঝ). দাঊদ (আঃ)-এর সিয়াম (ঞ). বিবাহে অসামর্থ ব্যক্তিদের সিয়াম।
.
তৃতীয়ত: মাকরূহ সিয়াম কয়েক ধরনের। যেমন: (ক). হাজ্জ পালনরত অবস্থায় হাজীদের জন্য আরাফাতের দিনের সিয়াম। (খ). একটানা বিরতীহীনভাবে সিয়াম পালন। (গ). পানাহার বিহীন সিয়াম। (ঘ). শুধুমাত্র জুমুআর দিনের সিয়াম। (ঙ). শুধুমাত্র শনিবারে সিয়াম।
.
চতুর্থত: হারাম সিয়াম আবার কয়েক ধরনের। যেমন: (ক). দু’ ঈদের দিন এবং কুরবানীর ঈদের পরবর্তী ৩ দিন (খ). সন্দেহ পূর্ণ দিনের (৩০শে শাবান) সিয়াম। (গ). স্বামীর উপস্থিতে তার বিনা অনুমতিতে স্ত্রীর নফল সিয়াম। (ঘ). মহিলাদের হায়েয নিফাসকালীন সময়ের সিয়াম। (ঙ). গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সিয়াম।ইত্যাদি।
.
▪️সিয়ামের ইতিহাস:
_______________________
পবিত্র কুরআনের ভাষ্য থেকে বোঝা যায় যে, পূর্ববতী নবী-রাসূল ও তাদের উম্মতদের উপরও সিয়াম ফরয ছিল। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হল, যেমন তা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর।’ (সূরা বাক্বারাহ; ২/১৮৩)। এই আয়াত থেকে বুঝা যায় যে,পূর্ববর্তী সকল উম্মতের জন্য সিয়াম ফরয ছিল। অবশ্য ইসলামে, খ্রিষ্টান ও ইয়াহুদী ধর্মের পূর্বের ধর্মাবলম্বী মানুষরা কিভাবে বা কোন পদ্ধতিতে সিয়াম পালন করত, তাদের উপর নির্দিষ্ট ভাবে রমাদ্বনের সিয়াম ফরয ছিল কি-না কিংবা তাদের উপর ফরযকৃত সিয়ামের সংখ্যা ও ধরণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে সরাসরি বিশুদ্ধ কোন বর্ননা পাওয়া যায়না। তবে ইয়াহুদ ও খ্রিষ্টানরা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জিনিস থেকে বিরত থেকে রোযা পালন করত। তাওরাত ও ইঞ্জীলের বর্তমান সংস্কারগুলো থেকেও জানা যায় যে, আল্লাহ তাআলা রোযাকে তাঁর পূর্ববর্তী বান্দাদের উপর ফরয করেছিলেন। সহীহ বুখারী-মুসলিমের একটি হাদীসে পাওয়া যায় যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদ্বীনায় এলেন, তখন দেখলেন; ইয়াহুদীরা আশূরার দিনে রোযা পালন করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এটা কি এমন দিন যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখছ?’’ ইয়াহুদীরা বলল, ‘এ এক মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ মূসা ও তাঁর কওমকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন এবং ফিরআঊন ও তার কওমকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। তাই মূসা এরই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই দিনে সিয়াম পালন করেছিলেন। আর সেই জন্যই আমরাও এ দিনে সিয়াম রেখে থাকি।’ এ কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘মূসার স্মৃতি পালন করার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে আমরা অধিক হকদার।’’ সুতরাং, তিনি ঐ দিনে রোযা রাখলেন এবং সকলকে সিয়াম রাখতে আদেশ দিলেন। (সহীহ বুখারী হা/২০০৪, সহীহ মুসলিম হা/১১৩০)
.
এছাড়াও সাহাবী ও তাবেঈদের পক্ষ থেকে কিছু আসার এসেছে। যেমন: মুআয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, তাদের উপর প্রতি মাসে তিনটি করে ও আশূরার সিয়াম ফরয ছিল। আর সিয়ামগুলো মুসলিমরা মদীনা আসার পূর্ব পর্যন্ত নয় বরং মদীনাতে গিয়েও ১৭ বা ১৯ মাস পালন করেছেন। রাসূল (ﷺ) মদীনায় হিজরত করলে ঐগুলো নফল হিসাবে থেকে যায় এবং রমাদানের সিয়াম ফরয করা হয়। (মুসতাদরাকে হাকেম হা/৩০৮৫; মুসনাদে আহমাদ হা/২২১৭৭)।
.
প্রসিদ্ধ তাফসীরবিদ মুয়ায, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু, আতা, কাতাদা ও দাহহাক (রহ.) বর্ণনা করেন, নূহ আলাইহিস সালাম হতে শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রত্যেক নবীর যুগেই প্রতি মাসে তিনটি করে সিয়ামের বিধান ছিল। পরবর্তীতে ইহা রমাযানের সাওম দ্বারা রহিত হয়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর: ১/৪৯৭, তাফসীরে কুরতবীঃ ২/২৭৫, তাফসীরে ত্বাবারী; ৩/৪১১, তাফসীরে মানারঃ ২/১১৬)। মুজাহিদ রহ. বলেন, প্রত্যেক জাতির উপর রমাদানের সিয়াম ফরয ছিল। শা‘বী ও অন্যান্যরা বলেন, ইহুদী ও নাসারাদের উপর রমাদ্বনের সিয়াম ফরয করা হয়। পরে তারা সময়ের পরিবর্তন করে। ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তারা সুস্থ হওয়ার জন্য আরো দশটি করে সিয়াম পালনের মানত করলে পরে তা ৫০টিতে রূপান্তরিত হয়। হাসান বসরীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন; হ্যাঁ, আমাদের পূর্ববর্তী সকল উম্মতের উপর এক মাস সিয়াম ফরয ছিল। (তাফসীরে ইবনু কাসীর খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪৯৭) । হাফেয ইবনু জারীর আত-তাবারী এসকল বর্ণনার সমন্বয় করে বলেন, ইব্রাহীম (আঃ)-এর পরবর্তী সকল নবী ও তাদের অনুসারীদের প্রতি একমাস সিয়াম পালন ফরয ছিল। আর এরও পূর্ববর্তী যারা ছিল তাদের উপর আইয়ামে বীযের তিনটি সিয়াম ফরয ছিল। (তাফসীরে তাবারী খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪১২)। তাফসীরে কুরতুবীর লেখক বলেন; আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রত্যেক মাসে তিন দিন ও আশুরার দিনে সাওম ফরয ছিল, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তী ইয়াহূদী সম্প্রদায়ের ওপর মাসে তিন দিন ও আশুরার দিনে সাওম ফরয ছিল। পরবর্তীতে রমযান মাসের দ্বারা এ সাওম রহিত হয়। মুআয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, উক্ত তিন দিনের সাওম নির্দিষ্ট কয়েক দিনের সাওমের দ্বারা রহিত হয়। অতঃপর উক্ত কয়েক দিনের সাওম আবার রমযানের সাওম দ্বারা রহিত হয়। (তাফসীরে কুরতবী: ২/২৭৫)
◾এই উম্মতের উপর কখন সিয়াম ফরজ হয়েছে:
_______________________________________
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে- ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ। এ সকল মৌলিক ভিত্তির মধ্যে এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সিয়াম হচ্ছে চতুর্থ রুকন এবং অন্যতম বুনিয়াদী ইবাদত। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, “ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের উপর।” আর তা হল: (১) “একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনও মাবূদ নেই এবং মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা, (৩) যাকাত প্রদান করা, (৪) রামাযানের সিয়াম (রোজা) পালন করা এবং (৫) কাবা ঘরের হজ্জ সম্পাদন করা।” (সহীহ বুখারী হা/৮ ও সহীহ মুসলিম হা/১৯, তিরমিযী হা/২৬০৯, নাসায়ী হা/ ৫০০১)। উক্ত হাদীসের ব্যখ্যায় শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, শাহাদাতায়নের মাধ্যমেই বাহ্যিকভাবে কোন লোক ইসলামের গণ্ডীরমধ্যে আছে বলে সাব্যস্ত হয়। এই শাহাদাতায়নের সাথে সালাত ও অন্যান্য স্তম্ভকে তার দিকে নিসবাত করা হয়েছে এজন্য যে, তা ইসলামের সর্বাপেক্ষা বাহ্যিক আলামত। তা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই তার ইসলাম পূর্ণতা লাভ করে। কোন ব্যক্তি তা পরিত্যাগ করলে সে ইসলামের বন্ধন খুলে ফেলেছে বলে অনুভূত হয়। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ভিত্তি ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত বস্তু এক নয়। তাহলে এর জবাব হলো সবগুলো স্তম্ভের সমন্বয়েই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। এর কোন একটি বাদে সবগুলো পাওয়া সম্ভব নয়। অথবা বলা যায় যে, ইসলাম অর্থ সাধারণভাবে আত্মসমপর্ণের নাম, বিশেষ কোন আত্মসমর্পণের নাম নয়। যাতে এটা আবশ্যক হয় যে, ভিত্তি ও তার উপর প্রতিষ্ঠিত বস্তু একই। অর্থাৎ- সাধারণ আত্মসমর্পণ সঠিক হওয়া নির্ভর করে ঐ সমস্ত কাজ সম্পাদনের উপর যা করণীয় আবশ্যক। হাদীসে শুধুমাত্র পাঁচটি জিনিসের উল্লেখের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এজন্য যে, ‘ইবাদাত হয়তো শুধুমাত্র কথার দ্বারা পালন হয়; যেমন শাহাদাতায়ন। অথবা পরিত্যাগ করার মাধ্যমে পালন হয়; যেমন সওম অথবা কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে পালন হয়। তা হয়ত শারীরিক কর্ম যেমন- সালাত, অথবা আর্থিক কর্ম যেমন যাকাত অথবা শারীরিক ও আর্থিক উভয়টিই যেমন হাজ্জ। (মিশকাতুল মাসাবিহ হা/৪; ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য;)
.
মহাবিজ্ঞান ও হিকমতময় মহান আল্লাহর একটি হিকমত ও অনুগ্রহ এই যে, তিনি বান্দার উপর যে আদেশ-নিষেধ আরোপ করেছেন তার মধ্যে বহু বিষয়কেই পর্যায় অনুক্রমে ধীরে ধীরে ফরয অথবা হারাম করেছেন। অনুরূপ তাঁর এক ফরয হলো সিয়াম বা রোযা। যা তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর উপর একসাথে সেটা ফরজ করেন নি বরং পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু করে ফরয করেছেন। যেমন:
.
প্রথম পর্যায়ঃ প্রিয় নবী রাসূল (ﷺ) প্রত্যেক মাসে ৩টি করে সিয়াম পালন করতেন। আর এ দেখে সাহাবাগণও (রাঃ) তাঁর অনুসরণে ঐ সিয়াম রাখতেন। যাতে করে সিয়াম পালনের অভ্যাস তাদের জন্য সহজ হয়ে ওঠে।
.
দ্বিতীয় পর্যায়ঃ কুরাইশদল জাহেলী যুগে আশূরার সিয়াম পালন করত। (সহীহ বুখারী হা/১৮৯৩,মুসলিম হা/ ১১২৫)। অতঃপর রাসূল (ﷺ) মক্কা থেকে হিজরত করে মদ্বীনায় এলে মূসা (আ)-এর অনুকরণে তাঁর স্মৃতি পালন করে আশূরার দিনে খুব গুরুত্বের সাথে সিয়াম রাখলেন এবং সাহাবাদেরকেও এ সিয়াম রাখতে আদেশ করলেন। তখন এ সিয়াম রাখা ফরয ছিল।
.
তৃতীয় পর্যায়ঃ- অতঃপর সিয়ামের বিধান নিয়ে কুরআন কারীমের উপর্যুক্ত আয়াত অবতীর্ণ হলো। কিন্তু শুরুতে তখনও সিয়াম পূর্ণ আকারে ফরয ছিল না। যার ইচ্ছা সে সিয়াম রাখত এবং যার ইচ্ছা সে সিয়াম না রেখে গরীব মিসকীনকে খাদ্য দান করত। তবে সিয়াম রাখাটাই আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় ছিল। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহর বলেন, যারা রোযা রাখার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সিয়াম রাখতে চায় না, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। যে ব্যক্তি খুশীর সাথে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তোমরা সিয়াম রাখ, তাহলে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণপ্রসূ; যদি তোমরা উপলব্ধি করতে পার। (সূরা বাকারাহ; ২/১৮৪)
.
চতুর্থ পর্যায়ঃ অতঃপর স্থায়ীভাবে দ্বিতীয় হিজরীর কোন মাসে সিয়াম ফরজ হয়। এটি নিয়ে কিছুটা মতানৈক্য রয়েছে। যেমন; কেউ বলেছেন শাবান মাসে, কেউ বলেছেন রমাদ্বন মাসে।ইবনু ইসহাক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ২য় হিজরী সনে রামাদানের সিয়াম ও যাকাতুল ফিৎরা ফরয করা হয়। যাতে যাকাতের নিসাবসমূহ বর্ণিত হয় (মির‘আত ৬/৩৯৯)। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, দ্বিতীয় হিজরি সনে রমাদ্বন মাসে সিয়াম পালন ফরজ করা হয়েছে। রাসূল (ﷺ) ৯ টি রমাদ্বন মাসের সিয়াম পালন করেছেন। অতঃপর ১১ হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের মৃত্যুবরণ করেছেন। (ইমাম নববী, আল-মাজমূ, খন্ড:৬ পৃষ্ঠা: ২৫০, ইসলামী সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৭৬৪৯) তবে অধিক বিশুদ্ধ মত হলো দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসের ২৮ তারিখ সোমবারে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ভারপ্রাপ্ত মুসলিমের পক্ষে পূর্ণ রমাদ্বনের সিয়াম ফরজ হয়। (ফিকহুস সুন্নাহ; ১/৩৮৩ দ্রঃ)। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, রমাযান মাস; যে মাসে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম রাখে। (সূরা বসকারাহ ২/১৮৫)
.
সুতরাং, সামর্থ্যবান ভারপ্রাপ্ত (জ্ঞানসম্পন্ন সাবালক) গৃহবাসীর জন্য মিসকীনকে খাদ্যদানের বিধান রহিত (বাতিল) হয়ে গেল এবং বৃদ্ধ ও চিররোগীর জন্য তা বহাল রাখা হলো। অনুরূপ (কিছু উলামার মতে) এ বিধান গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মহিলার জন্যও বহাল করা হলো; যারা গর্ভকালে বা দুগ্ধদান কালে সিয়াম রাখলে তার সন্তানের বিশেষ ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করে। মুসলিমদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত এই ছিল যে, রোযার বহু কষ্টভার তিনি লাঘব করে দিয়েছেন। যেমন; শুরুর দিকে এ সিয়াম ফরয ছিল এশার নামায বা রাত্রে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর থেকে পর দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ, রাত্রে একবার ঘুমিয়ে পড়লে পানাহার ও স্ত্রী-সহবাস হারাম হয়ে যেত। এতে মুসলিমরা বড় কষ্টবোধ করতে লাগলেন। সময় লম্বা থাকার কারণে তাঁরা বড় দুর্বল হয়ে পড়তেন। অতঃপর মহান আল্লাহর তরফ থেকে সে ভার হালকা করা হলো। পরিশেষে ফজর উদয়কাল থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত কাল পর্যন্ত হলো সিয়াম রাখার সময়।
.
আনসার গোত্রের সিরমাহ নামক এক ব্যক্তি রোযা রাখা অবস্থায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতেন। একদিন তিনি বাড়ি ফিরে এসে এশার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়লেন এবং কোন প্রকার পানাহার না করেই তাঁর ফজর হয়ে গেল। সুতরাং এ অবস্থাতেই পরদিন রোযা রাখলেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে সেই কঠিন দুর্বল ও ক্লিষ্ট অবস্থায় দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কি ব্যাপার! আমি তোমাকে বড় দুর্বল দেখছি যে?’’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি গতকাল কাজ করার পর যখন এলাম তখন (পরিশ্রান্ত হয়ে) শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে গেলাম। তারপর ফজর হয়ে গেলে আবার সিয়াম রেখে নিলাম। (সহীহ বুখারী হা/১৯১৫, আবূ দাঊদ হা/২০২৯)। উমার (রাঃ) এক রাত্রে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর উঠে স্ত্রী-মিলন করে ফেললেন। তিনি মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এসে ঘটনা উল্লেখ করলেন। অতঃপর এই সবের পরিপ্রেক্ষীতে আল্লাহর বিধান অবতীর্ণ হলো, রোযার রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোষাক এবং তোমরা তাদের পোষাক। আল্লাহ জানতেন যে, তোমরা আত্ম-প্রতারণা করছ। তাই তো তিনি তোমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব, এখন তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করতে পার এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা (সন্তান, শবেকদর, সকল বৈধ বস্ত্ত বা আল্লাহর তরফ থেকে কোন কিছুর ব্যাপারে অব্যাহতি) লিখে রেখেছেন তা কামনা কর। আর তোমরা পানাহার কর; যতক্ষণ রাত্রির কালো রেখা হতে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশ না পায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। (সূরা বাকারাহ; ২/১৮৭, আবু দাঊদ ২০২৮, তাফসীর ইবনে কাসীর খন্ড:১ পৃষ্ঠা:২৯১)। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রামাদানের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।