২১ শে ফেব্রুয়ারি রচনা |একুশে ফেব্রুয়ারি রচনা | অনুচ্ছেদ রচনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

২১ শে ফেব্রুয়ারি রচনা (১০০০,৫০০,২০০) শব্দ |একুশে ফেব্রুয়ারি রচনা PDF | অনুচ্ছেদ রচনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

২১ শে ফেব্রুয়ারি রচনা ১০০০ শব্দ

ভূমিকা :

বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি অমর , অক্ষয় এবং স্ব – মহিমায় প্রােজ্জ্বল একটি দিন । অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় চেতনার এক উর্বর উৎস । তেরাে কোটি বাঙালির কাছে এ দিনটি অবিস্মরণীয় । ১৯৫২ সালের ভাষা সংগ্রামের সুমহান স্মৃতির মালায় গাঁথা এ দিনটিকে বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে । রক্ত – রঞ্জিত এ একুশে ফেব্রুয়ারিতেই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বাংলার কিছু তরুণ তাদের তাজা প্রাণ অকাতরে আত্মোতৎসর্গ করে বাংলার ইতিহাসে লাভ করেছে অমরত্ব । এ চিহ্নিত দিনটি বাঙালি জাতীয়তাবােধের নবজন্মের দিন । এ দিনটির সাথে নির্যাতিত , শােষিত ও বঞ্চিত বাঙালি জাতির এক বিষাদবিধুর ইতিহাস জড়িত ।

পাকিস্তানি শাসকচক্রের ষড়যন্ত্র :

একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস খুবই বেদনাবহ । বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৯৫২ – এর ফেব্রুয়ারি অথবা পলাশ রাঙা ফাল্গুন এক ক্রান্তিলগ্ন । তখন পাকিস্তানি শাসনামল । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হতেই পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকচলে পরিকল্পিত শােষণ ও বঞ্চনায় এমনিতেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছিল ক্ষব্ধ। তদুপরি এদেশের চিরাচরিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত হানতে পাকিস্তানি শাসকচক্র ঘোষণা দেয় ‘ উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা । ‘ এর মূলে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষা , মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে বাঙালি জাতিকে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্য । তৎকালীন শাসকগােষ্ঠীর এটা ছিল বাঙালিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে ফেলার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ।

ভাষা আন্দোলন :

ভাষাপ্রেমী বাঙালির প্রতিরােধ আন্দোলনের মাধ্যমে শাসকগােষ্ঠীর অশুভ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেয় নি । এদেশের দামাল ছেলেরা এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে উঠল । রাজরােষ ও চক্রান্তের বিরূদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াল । তারা গড়ে তুলল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ । মিটিং , মিছিল আর শ্লোগানে মুখরিত করে তুলল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আকাশ – বাতাস । দুর্বার ভাষা আন্দোলনে দিশেহারা হয়ে পড়ল শাসকগােষ্ঠী , জারি হলাে ১৪৪ ধারা । ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তরুণদের দুর্জয় প্রতিবাদ মিছিলে ১৪৪ ধারার প্রতিরােধ ব্যহ চুরমার হয়ে গেল । আকাশে – বাতাসে ধ্বনিত হলাে ‘ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চইি । উপায়ান্তর না দেখে পাকিস্তানি শাসকচক্র নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বসল ছাত্র – জনতার মিছিলে । রাষ্ট্রভাষা বাংলার ন্যায্য দাবির পবিত্ৰ মিছিল রঞ্জিত হলাে বুকের রক্তে । সালাম , বরকত , রফিক , জব্বার , শফিউর প্রমুখ তরুণের বক্ষ – শােণিতে ঢাকার রাজপথে আঁকা হলো রক্তের আলপনা । অবশেষে রাজশক্তি মেনে নিল বাঙালির প্রাণের দাবি । বাংলা হলাে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ।

জাতীয় জীবনে একশের প্রভাব বা তাৎপর্য :

জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য খুবই অর্থবহ । একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত একটি দিনই নয় । এখান থেকেই বাঙালির জাতীয় জীবনে যে গতিশীল চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল , তাই একদা পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার , স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করেছিল । দিনের পর দিন বছরের পর বছর শােষিত , বঞ্চিত ও পােড়খাওয়া বাঙালি জাতি ইস্পাতকঠিন দৃপ্ত শপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল । একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে উজ্জীবিত করেছিল । একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাবেই বাঙালি জাতি এক জাগ্রত জাতি হিসেবে চিহ্নিত । এ জাগ্রত মানবশই বাংলাদেশের অন্যতম সক্রিয় সম্পদ । একুশের প্রেরণায় বাংলাদেশের কোটি কোটি মেহনতি মানুষ তাদের নিরলস শ্রম ও দেহ – নিঃসৃত প্রতিটি স্বেদবিন্দুর বিনিময়ে স্বকীয় মহিমায় বিভূষিত এক সােনার বাংলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল । একুশ বাঙালির জাতীয়তা , স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এক অকাট্য দলিল ।

বায়ান্ন থেকে একাত্তর :

মূলত বায়ান্ন সালে বাঙালি জাতীয়তাবােধের যে স্ফুরণ ঘটেছিল তা – ই ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে । ভাষাকে কেন্দ্র করেই গােটা জাতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়েছিল । একুশের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই ‘৬৯ সালে বাঙালিরা অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে । ১৯৭০ সালে নির্বাচনি বিজয়ের পরও যখন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে না দিয়ে বাঙালির ওপর চালানাে হলাে নির্মম হত্যাকাণ্ড তখন এদেশের মানুষ সংঘবদ্ধভাবে রুখে দাড়াল । দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর বাংলার মানুষ লাভ করল স্বাধীনতার সােনালি সূর্য । বায়ান্ন সালে যে চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল তারই পরিণতি ঘটে একাত্তরে । সেজন্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলন প্রাণশক্তি হিসেবে চিহ্নিত ।

একুশ আমার অহঙ্কার :

বাঙালি জাতির যতগুলাে অহঙ্কারের অনুষঙ্গা আছে তার মধ্যে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যতম । পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্যে অকাতর আত্মদানের নজির একমাত্র বাঙালিরই রয়েছে । বাঙালি জাতি ভাষার জন্যে আত্মদানের যে অহঙ্কার অর্জন করেছে তার প্রতি বিশ্ববাসী সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি জানিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘােষণার মধ্যদিয়ে । শিকাগােতে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্যে আত্মদানের স্বীকৃতিসরূপ ১ মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস হিসেবে উদযাপিত হয় । বাংলার মানুষের মাতৃভাষাপ্রীতির স্বীকৃতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে । এটা আমাদের জন্যে অবশ্যই অহঙ্কার ও গর্বের বিষয় । একুশ আমাদের দিয়েছে আত্মপরিচয়ের সম্মান , অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবনমানের প্রেরণা । আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিটা তৈরি হয়েছে একুশের কল্যাণেই ।

উপসংহার :

একুশ দুর্জয় ও দুর্বার বাঙালি জাতির এক কালজয়ী অমর ও অক্ষয় কীর্তির স্মৃতিময় প্রামাণ্য সনদ । একুশের নির্যাসকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে । জীবনের সর্বস্তরে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদেরকে মনে – প্রাণে খাঁটি বাঙ্গালি বলে প্রমাণ করতে হবে । কথনে , লিখনে , চিন্তনে ও পঠনে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করাই একুশের মূল দাবি ।

২১ শে ফেব্রুয়ারি রচনা

সূচি তালিকা

  • ভূমিকা:
  • আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট:
  • আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ:
  • আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদযাপন:
  • মাতৃভাষা ও সাহিত্য:
  • মাতৃভাষা ও বর্তমান বাংলাদেশ:
  • মাতৃভাষার বিকৃতি ও অবজ্ঞা:

 

ভূমিকা:

বিশ্বজুড়ে নানা অঞ্চল ভেদে মানুষের ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে উঠেছে শত সহস্ত্র ভাষা এবং সেই ভাষার অবলম্বনকারী নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠী। তেমনি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সন্তানেরা তাদের জন্মলগ্ন থেকে ঐতিহ্যগতভাবে যে নির্দিষ্ট ভাষাটির মাধ্যমে নিজেদের ভাব প্রকাশ করতে শেখে, সেটিই হল তাদের মাতৃভাষা। কোন গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তির মাতৃভাষা তার কাছে শুধুমাত্রই একটি সামান্য ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়।

সেই নির্দিষ্ট ভাষাটির সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে ইতিহাসের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক সংস্কৃতি তথা মহান আবেগ। মনের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা ভাবকে ছুঁয়ে প্রকাশ করে যে ভাষা, তার সাথে যে আবেগ জড়িয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। মানুষের সেই আবেগকে, প্রত্যেকের মাতৃভাষার সাথে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস তথা মহান সংস্কৃতিকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট:

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপটকে গোড়া থেকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দেরও আগে। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি তখনো। সেই সময়ে ভারতবর্ষ থেকে সদ্য বিভক্ত হয়ে যাওয়া পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান রূপে পরিচিত ছিল আজকের গৌরবময় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের প্রধান তথা বৃহত্তর অংশের জনগোষ্ঠী মূলত উর্দু ভাষাভাষী হলেও পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা ছিল বাংলা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানুষদের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়। মাতৃভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে বহু প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আবেগ। কোন ভাষার বিস্তৃতির সাথে সেই ভাষাগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও আবেগেরও বিস্তৃতি ঘটে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে ফেটে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পর থেকেই বাংলা ভাষার ওপর জোর জুলুম তীব্রতর হতে থাকে। এর প্রতিবাদে তীব্র হয় ভাষা আন্দোলনও।

১৯৫২ তে তা চরম আকার নেয়। ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত তরুণ ছাত্র ছাত্রীদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণে কয়েকটি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। এদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, সালাম, শফিউল, বরকত সহ অনেকেই।বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই মহান দিনটিকে স্মরণ করেই ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাতিসংঘ এই দিনে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ:

ইতিহাসে যতদূর জানা যায় তা হল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন কানাডার ভেঙ্কুভারে বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। তাদের সার্বিক উদ্যোগে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত হয় “মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড” নামে একটি সংগঠন।

এরপর আরও নানা সুধীজনের সহযোগিতায় বিভিন্ন ওঠাপড়ার শেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেই অধিবেশনেই মোট ১৮৮টি দেশের সমর্থন সহযোগে প্রস্তাবটি পাশ হলে তার পরের বছর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে জাতিপুঞ্জের সদস্য দেশগুলিতে যথাযথ মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে।

এরপরে ২০১০ সালের একুশে অক্টোবর সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে জাতিপুঞ্জ স্বয়ং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়। এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। তার পরের বছর মে মাসে জাতিপুঞ্জের ১১৩ সদস্য বিশিষ্ট তথ্য বিষয়ক কমিটিতে উক্ত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা লাভ করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদযাপন:

নিজের মাতৃভাষা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে পরম আদরের এবং হয়তো সবচেয়ে কাছের একটি বিষয়। সেই ভাষার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত একটি দিনকে মানুষ পরম উৎসাহের সাথে পালন করে থাকে। এই দিনটিতে পৃথিবীজুড়ে মানুষ মেতে ওঠে নিজের ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসের গৌরবময় চর্চায়। সমগ্র বিশ্বজুড়ে ভাষার এমন ব্যাপক উদযাপন আর কোন দিন দেখা যায় না। এ যেন এক ভাষা মহোৎসব।

ভাষাভিত্তিক এই উদযাপনের সম্ভবত সবচেয়ে নির্মল রূপটি দেখা যায় বাংলাদেশে। নিজের ভাষাকে ভালোবেসে এতোখানি আত্মোৎসর্গের ইতিহাস আর কোন জাতির আছে কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে স্মরণ করে করে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়। দেশের রাষ্ট্রপতি প্রধান মন্ত্রী তথা বড় বড় বিদ্বজ্জনেরা এই দিনটিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে বাংলাদেশের ইতিহাসের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন।

শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরার উদ্দেশ্যে দেশজুড়ে এই দিনে আয়োজিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বরাও এই দিনটিতে বাংলাদেশের সমবেত হয়ে থাকেন। টেলিভিশন ও রেডিও জুড়ে ভাষা আন্দোলনের মহিমা প্রচারিত হতে থাকে। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে ঢাকায় একুশে বইমেলার আয়োজন করে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য:

মানুষের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত। মাতৃভাষা ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে পারে। সংকটের মুখে পড়তে পারে কোন জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ভাষা সাহায্য করে মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা আবেগকে প্রকাশ করতে। তাই সেই ভাষার প্রতি উৎসর্গিত একটি দিনের তাৎপর্যও আমাদের সমাজ জীবনে অসীম। এই তাৎপর্য কোন নির্দিষ্ট জাতি কিংবা ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা সকল সীমানা পেরিয়ে আজ সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন স্রোতে বিশ্বায়িত।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে মানুষ শেখে নিজের ভাষার সাথে সাথে এ পৃথিবীর সকল ভাষাকে সম্মান করতে। এই দিনটির দ্বারা মানুষ নিজেদের জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে। নিজেদের ভাষার মহোৎসব পালনের মাধ্যমে আপন ভাষা তথা জাতির ইতিহাসের প্রতিটি মানুষের মন অনুসন্ধিত্সু হয়ে ওঠে।

স্বাভাবিকভাবে সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ হয় সমগ্র মানব সমাজ। তাছাড়া একে অপরের ভাষাকে সম্মান করতে শেখার মধ্যে দিয়ে মানব সভ্যতা পারস্পারিক সহাবস্থানের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ওঠে। আমাদের মনে রাখা দরকার পারস্পরিক সম্মান এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া মানবসভ্যতার টিকে থাকা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন মানব সভ্যতা তথা সুস্থ সংস্কৃতির টিকে থাকার লড়াই এর মুকুটে তেমনি একটি পালক যোগ করে দেয়।

মাতৃভাষা ও সাহিত্য:

মাতৃভাষা এবং সাহিত্যচর্চা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই বক্তব্যটির প্রকৃত অর্থকে বুঝতে গেলে সর্বপ্রথম আমাদের সাহিত্যের স্বরূপ অনুধাবন করতে হবে। সাহিত্য হল আমাদের মনের ভেতরকার সেই সব কল্পনা যাকে আমরা ভাষার মাধ্যমে জীবন্ত রূপ দিতে চাই। এ-বিশ্বে যা কিছু প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক, তা কিছুই সুন্দর। মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজের মনের অন্দরমহলে সাহিত্যিক কল্পনার রূপ দান করে আপন মাতৃভাষায় চিন্তার মাধ্যমে।

তাই কোন মানুষ যদি নিজের মাতৃভাষায় দুর্বল হয়, তার পক্ষে সমৃদ্ধ সাহিত্যকে রূপ দান করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন সাহিত্য গড়ে উঠলেও তা নিজের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে সুন্দরকে পাশ কাটিয়ে হয়ে পড়ে দুর্বল।

খেয়াল করলে দেখা যাবে এই পৃথিবীতে বিশ্বমানের যত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে প্রত্যেকটির পিছনে লেখক বা লেখিকার মাতৃভাষার অবদান সবথেকে বেশি। কারণ নিজের মাতৃভাষায় যত স্নিগ্ধ বা নির্মল ভাবে চিন্তা করা যায় পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় অসীম জ্ঞান থাকলেও আবেগের অভাব হেতু চিন্তার সেই স্নিগ্ধতা বা গভীরতা, কোনটাই আসেনা।

মাতৃভাষা ও বর্তমান বাংলাদেশ:

বাংলাদেশ বরাবরই নিজের মাতৃভাষার রক্ষার প্রতি অপরের তুলনায় অধিক সচেতন এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যে ভাষাকে রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছিল শত শত তরুণ, হাজারো প্রাণ ঝরে গিয়েছিল অকালে; সেই ভাষার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দক্ষিণ এশিয়ার বুকে ক্ষুদ্র এই দেশটির মাতৃভাষা বাংলা; বাংলা ভাষাকে এই দেশ নিজের মায়ের মত করে ভালোবাসে।

বলা হয়ে থাকে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে পরম যত্নে বাংলাদেশ বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর বুকে নিজের এক অন্যতম স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ প্রমাণ করে দিয়েছে এই ভাষার অবলম্বনকারী মানুষ নিজের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে রক্ষায় রক্ত ঝরাতেও পিছুপা হয়না।

মাতৃভাষার বিকৃতি ও অবজ্ঞা:

বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী অপসংস্কৃতির ব্যাপক চর্চায় ছাড় পায়নি মাতৃভাষাও। এ কথা সত্য যে ভাষা হল মানুষের ভাব প্রকাশের একটি প্রাণবন্ত ও প্রগতিশীল মাধ্যম। পৃথিবীর প্রত্যেকটি ভাষার মধ্যে অন্য অনেক ভাষার প্রভাব সর্বদাই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তা বলে নিজের মাতৃভাষাকে বিকৃত করে অন্য ভাষা থেকে ধার করা শব্দবন্ধের সংযোজন কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্বায়নের কালে মানুষ যতই বিশ্ব নাগরিক হতে চাইছে নিজের মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা ততই বেড়ে চলেছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে কোন মানুষ পৃথিবীর অন্য কোন ভাষাকে আদর্শরূপে আয়ত্ত করতে পারে না। মাতৃভাষা কোন একটি জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে।

তদপুরি সার্বিক সামাজিক চরিত্রকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও মাতৃভাষার অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই কোন সমাজে মাতৃভাষায় অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ,  ভাষার বিকৃতি এবং অবজ্ঞা সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনে, যা পরবর্তীতে একটি জনগোষ্ঠীর পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহার:

মাতৃভাষা হল মায়ের ভাষা। মা যেমন তার সন্তানকে স্নেহের বন্ধনে আগলে রাখে, তেমনি মাতৃভাষাও একটি নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ইতিহাসের স্নিগ্ধ বন্ধনে জড়িয়ে রাখে। সেজন্যেই মাতৃভাষা আমাদের সকলের কাছে পরম আবেগের। নিজেদের এই আবেগকে রক্ষা করার জন্য আমাদের অনতিবিলম্বে সচেতন হতে হবে।

নিজেদের ইতিহাসকে ও ভাষার ঐতিহ্যকে আপন করে নিয়ে বর্জন করতে হবে বিকৃতি ও অপসংস্কৃতিকে। নতুন প্রজন্মকে বিশ্বায়িত করার সাথে সাথে তাদের আপন ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যাপারেও সচেতন করে তুলতে হবে প্রতিনিয়ত। আমাদের মনে রাখতে হবে নিজেদের মাতৃভাষার চর্চায় আছে “প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি”। এই লক্ষ্যগুলি সফল হলে তবেই আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন সার্থক হয়ে উঠবে।

 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারি রচনাটি পড়ে আপনার কেমন লাগলো আপনার ব্যাক্তিগত মতামত কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান।আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি সবার থেকে সুন্দর ও আপনার মনের মতো করে একটি রচনা তুলে ধরার। এখানে নেই এমন রচনা পাওয়ার জন্য রচনাটির নাম কমেন্ট করে জানান।দ্রুততার সঙ্গে আমরা উক্ত রচনাটি যুক্ত করার চেষ্টা করবো।সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *