পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী মানসা মূসা ‘র হজ্জে যাবার গল্প

পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ধনী হিসেবে পরিচিত মালীর মানসা মূসা। বর্তমান বিশ্বের বিল গেটস, অ্যালন মাস্ক বা কার্লোস স্লিমের চেয়েও ধনী ছিলেন আফ্রিকার মানসা মূসা।
তিনি ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সোনার (Gold) মূল্যমান নির্ধারণ করতে পারেন; তাঁর কাছে এতো পরিমাণ সোনা ছিলো।
মানসা মূসা জন্মগ্রহণ করেন ১২৮০ সালে।
১৩১২ সালে তাঁর ভাই অভিযানে গেলে তিনি সিংহাসনের দায়িত্ব পান। তাঁর রাজ্যের আশেপাশের ২৪ টি রাজ্য তিনি জয় করেন।
বলা হয়ে থাকে, তৎকালীন সময়ে যে ব্যক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অঞ্চল শাসন করতেন, তিনি ছিলেন মানসা মূসা। স্বর্ণ এবং লবণ ছিলো তাঁর মূল সম্পদ।

১৩২৪ সালে মানসা মূসা হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তাঁর সাথে ছিলো প্রায় ৬০,০০০ হজ্জযাত্রী।
যাদের মধ্যে ১২,০০০ ছিলো সৈন্য এবং দাস। দাসদের প্রত্যেকের কাছে ছিলো ৪ পাউন্ড করে সোনার বার।
এছাড়াও তাঁর সাথে ছিলো ৮০টি উট, যাদের প্রত্যেকের পিঠে ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ড করে সোনা ছিলো।
এতো বিপুল পরিমাণে সম্পদ নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাস এর আগে এবং এর পরে কেউ কখনো হজ্জে যায়নি।
মানসা মূসার বাহিনী যখন হজ্জে যাচ্ছিলো, তখন মনে হচ্ছিলো স্বর্ণের বহর নিয়ে একটি কাফেলা যাচ্ছে।

স্বর্ণ বিতরণ

যাত্রাপথে মানসা মূসা আশেপাশের মানুষদের মধ্যে স্বর্ণ বিতরণ করেন। মিসরে তখন মামলুক সুলতানরা শাসন ক্ষমতায় ছিলো।
তিনি মিসরবাসীকে অসংখ্য স্বর্ণ দান করেন।
বিখ্যাত পর্যটক আল-উমরী মানসা মূসার মিসর সফরের ১২ বছর পর মিসরে গিয়ে দেখেন এক যুগ পরও মিসরবাসী মানসা মূসার গুণগান গাচ্ছে।
হজ্জে যাবার পথে মানসা মূসা অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করেন। যেসব জায়গায় মসজিদ কম ছিলো, তাঁর সেনাবাহিনীর সাহায্যে সেসব এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করা হয়।

১৩২৪ সালে মক্কাবাসী অভূতপূর্ব এক হজ্জযাত্রী দেখে। তখনকার সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা যখন ছিলো নাজুক, তখন আফ্রিকার ৬০,০০০ মানুষ একসাথে হজ্জ করতে এসেছে। আফ্রিকার এতো বিপুল সংখ্যক মানুষ একসাথে ইতোপূর্বে হজ্জ করেছে বলে জানা যায় না। সুদূর আফ্রিকার মানুষ জীবনে প্রথমবারের মতো মক্কা-মদীনা দেখতে পায়। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহর দুটো দেখে প্রাণ জুড়ায়।

মানসা মূসার কাছে অঢেল সম্পদ ছিলো। তিনি দেখলেন তাঁর রাজ্যে জ্ঞানের বিস্তার ঐরকম নেই। অথচ মক্কা-মদীনায় অনেক সম্পদ না থাকলেও সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, দার্শনিক, স্থপতিরা আছেন। এতো সম্পদ দিয়ে কী হবে, যদি মানুষের মধ্যে জ্ঞানচর্চা না থাকে?
হজ্জের সফরে মানসা মূসা একটি নতুন পরিকল্পনা আঁটেন। তিনি সেখানকার স্কলারদের তাঁর রাজ্যে নিয়ে যেতে চান। তাঁদেরকে অনেক সম্মানী অফার করেন। আন্দালুসের বিখ্যাত আর্কিটেক্ট আবু ইসহাককে তিনি রাজি করান।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

আবু ইসহাককে যে সম্মানী দেয়া হয়, সেটার বর্তমান মূল্যমান ধরা হয় ৮.২ মিলিয়ন ইউএস ডলার।
যা বাংলাদেশের বর্তমান বাজেটের শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত টাকার চেয়েও বেশি!
মানসা মূসা সানকৌরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো প্রায় ২৫,০০০ যা হাল আমলের অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজের চেয়েও বেশি।
মানসা মূসার উদ্যোগে মালিতে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়, যে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১০ লক্ষাধিক; তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী একটি লাইব্রেরি হিশেবে সেটা পরিচিত ছিলো।

মালিকে তিনি এমনভাবে গড়ে তুলেন যে, সেই আফ্রিকার একটি অঞ্চল হয়ে উঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু।
পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়ালেখা করতে যেতেন। শিক্ষার্থীদেরকে স্কলারশিপ দেয়া হতো।
আব্দুর রহমান আল-তামিমী নামে হিজাজের একজন ফক্বীহ মালিতে যান।
তিনি মক্কা-মদীনার স্কলার হওয়া সত্ত্বেও মালির স্কলারদের কাছে জ্ঞানার্জনের পূর্বে তাঁকে ফেজ যেতে হয় প্রাথমিক পড়াশোনার জন্য।
মধ্যযুগে মুসলিম সভ্যতাগুলো যখন পতনের মুখে, তখন মালিতে গড়ে উঠে নতুন করে একটি সভ্যতা।
যে সভ্যতার অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট ছিলো মানসা মূসার হজ্জযাত্রা।

আরিফুল ইসলাম
২২ জুন ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *