টাঙ্গাইলের মসজিদে ৯৪ বছর ধরে ২৪ ঘণ্টাই চলে কোরআন তেলাওয়াত
কুরআনের প্রতিটি আয়াতে যেমন রয়েছে বিশ্বমানবতার হেদায়াত ও মুক্তির বারতা তেমনি কুরআন তিলাওয়াতে রয়েছে বিশ্বাসীদের জন্য অফুরান সওয়াব ও পুরস্কারের ঘোষণা।
এদিকে, টানা ৯৪ বছর ধরে অবিরত কোরআন তেলাওয়াত চলছে ৭০০ বছরের পুরনো টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি নওয়াব শাহী মসজিদে। ব্যাপারটি বিস্ময়কর হলেও এমনই কার্যক্রম চলছে সেখানে। ১৯২৯ সাল থেকে শুরু হওয়া কোরআন তেলাওয়াত নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে ২৪ ঘণ্টাই। এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি তেলাওয়াত। মুক্তিযুদ্ধকালে চলছে এ কার্যক্রম। কর্তৃপক্ষের নিযুক্ত পাঁচজন কোরআনে হাফেজ মসজিদ কম্পাউন্ডের একটি কক্ষে ধারাবাহিকভাবে কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন।
জানা গেছে, সেলজুক তুর্কি বংশের ইসপিঞ্জার খাঁ ও মনোয়ার খাঁ নামে দুই ভাই ১৬ শতাব্দীতে ঐতিহ্যবাহী এককক্ষ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, সম্রাট আকবরের সময় এই দুই ভাই ধনবাড়ীর অত্যাচারী জমিদারকে পরাজিত করার পর এ অঞ্চলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং এ মসজিদটি নির্মাণ করেন।
নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী প্রায় ১১৭ বছর আগে এ মসজিদটি সম্প্রসারণ করে আধুনিক রূপ দেন। তিনি বাংলাভাষার প্রথম প্রস্তাবক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যুক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সংস্কারের আগে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ দশমিক ৭২ মিটার (৪৫ ফুট)। প্রস্থ ছিল ৪ দশমিক ৫৭ মিটার (১৫ ফুট)। পরবর্তীতে মসজিদটি বর্গাকৃতির ও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মোগল স্থাপত্যের বৈসাদৃশ্যপূর্ণ করা হয়েছে। মোগল স্থাপত্য-রীতিতে তৈরি এই মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝের মার্বেল পাথরগুলো নিপুণভাবে কারুকার্যমণ্ডিত। সংস্কারের কারণে প্রাচীনত্ব কিছুটা বিলীন হলেও মসজিদের সৌন্দর্য-শোভা অনেক বেড়েছে। মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য পূর্ব দিকের বহু খাঁজে চিত্রিত তিনটি প্রবেশপথ, উত্তর ও দক্ষিণে আরও একটি করে সর্বমোট পাঁচটি প্রবেশ পথ রয়েছে।
প্রায় ১০ কাঠা জায়গায় নির্মিত মসজিদটির চর্তুদিক থেকে ৪টি প্রবেশ পথ এবং ৯টি জানালা এবং ৩৪টি ছোট ও বড় গম্বুজ রয়েছে। বড় ১০টি মিনারের প্রত্যেকটির উচ্চতা ছাদ থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু।
মসজিদের দোতলার মিনারটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। ৫ ফুট উচ্চতা এবং ৩ ফুট প্রস্থের মিহরাবটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন। মসজিদের মেঝে ও দেয়াল কাঁচের টুকরো দিয়ে নকশা ও মোজাইক করা। ভেতরের পুরো অংশ জুড়ে চীনা মাটির টুকরো দিয়ে অধিকাংশ স্থানে ফুলের নকশা করা হয়েছে।
৩০ ফুট উচ্চতার মিনারের মাথায় স্থাপিত ১০টি তামার চাঁদ মিনারের সৌন্দর্য্য কয়েকগুণ করেছে। মসজিদে ১৮টি হাড়িবাতি সংরক্ষিত রয়েছে। যেগুলো শুরুর যুগে নারিকেল তেলের মাধ্যমে আলো জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। মোগল আমলে ব্যবহৃত ৩টি ঝাড়বাতিও রয়েছে। সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদে একসঙ্গে ২০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে।
মসজিদের পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট ও কবরস্থান। যেখানে দাফন করা হয়েছে নওয়াব বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীকে। তার ওয়াকফকৃত সম্পদের মাধ্যমে মসজিদ, মাদরাসা ও ঈদগাহ পরিচালিত হয়।
পূর্বদিকের তিনটি প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিমের দেয়ালে ৩টি মিহরাব রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটির অষ্টভুজাকারের, দুই পাশে রয়েছে বহু খাঁজবিশিষ্ট খিলান। তাছাড়াও সেটিতে ফুলের রকমারি নকশা রয়েছে। অন্য দু’টি মিহরাবও বহু খাঁজবিশিষ্ট তবে কারুকার্যহীন খিলানযোগে গঠিত। প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর শান বাঁধানো ঘাটের বিশাল একটি দীঘি রয়েছে। তাতে মুসল্লিরা ওজু করেন। তাছাড়াও মসজিদের আশপাশে সুপ্রশস্ত ও খোলামেলা অনেক জায়গা রয়েছে। যা দর্শনার্থীদের মনে বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি করে।