সুশাসন কাকে বলে? সুশাসনের প্রকৃতি ও ধরণ, উপাদান বা ভিত্তি কি?

বর্তমান রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি মার্জিত, কাঙ্ক্ষিত ও সুসংগঠিত রূপ হলো সুশাসন। সুশাসন ধারণাটি মূলত শাসন এর সাথে সু প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে।সুশাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Good Governance. ইংরেজি এই Governance শব্দটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ Kubernaein থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ হলো – To steer. সুতরাং সুশাসনের অর্থ হলো – নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। চলুন এবার তাহলে সুশাসন কাকে বলে? সুশাসনের প্রকৃতি ও ধরণ, উপাদান বা ভিত্তি কি? এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।

সুশাসন কাকে বলে? সুশাসন কি?

যে শাসন ব্যবস্থায় সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, তাকেই সুশাসন বলা হয়।

ম্যাককরনী (MacCorney)-এর মতে, “সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগনের, শাসকের সাথে সাশিতের সম্পর্ক।”

বিশ্বব্যাংকের মতে সুশাসনের সংজ্ঞা হলো, “Governance is the manner in which power is exercised in the management of a country’s economic and social resources for development.” অর্থাৎ, “সুশাসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সমাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়।”

পিয়েরে ল্যান্ডেল মিলস ও ইসমাইল সেরাজিল ডিন এর মতে, “জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং ন্যায্য অধিকার উপভোগের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা চর্চার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা প্রক্রিয়া হলো সুশাসন।”

UNDP এর মতে, “একটি দেশের সার্বিক স্তরের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের বিধিবদ্ধ চর্চার বা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন।”

মারটিন মিনোগের মতে, “বৃহৎ অর্থে সুশাসন হচ্ছে কতিপয় উদ্যােগের সমাহার ও একটি সংস্কার কৌশল যা সরকারকে আরও বেশি গণতান্ত্রিক মুক্তমনা, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলে।”

Harris এর মতে, “সুশাসন এমন এক সার্বজনীন ভূমিকা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজের ধারা যা আপনা থেকেই নিয়ম-কানুন ও সেসবের কার্যকারিতার সংঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করে।”

এক কথায় বলা যায়, যে শাসন ব্যবস্থায় আইনের শাসন, দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণে অংশগ্রহণ গনতান্ত্রিক উপায়ে সুনিশ্চিত হয় তাকেই সুশাসন বলে।

শাসন ও সুশাসনের ধারণা ও সংজ্ঞা (Concept of Governance and Good Governance): পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র মানব সভ্যতার বিবর্তনের ফসল। যুগের পর যুগ ও বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বিভিন্ন শক্তি ও উপাদানের সমন্বয়ে এসবের উদ্ভব ঘটেছে। এসব সংগঠন গড়ে উঠেছে মানব জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদানের জন্য। এ সকল সংগঠনের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য একসময় শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আদিতে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসন প্রবর্তনের মূল লক্ষ্য ছিল জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মনুসংহিতায় লক্ষ্য করা যায় যে, রাজা প্রজাদের নিকট থেকে উৎপন্ন ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ রাজস্ব আদায় করতো। এর বিনিময়ে রাজা প্রজাদের নিরাপত্তা বিধান করতো। প্লেটো, এরিস্টটল, ইবনে খালদুন প্রমুখ দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ বিশ্বাস করতেন যে, উত্তম জীবন গড়ে তোলার জন্যই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব’ (The State exists to Promote good life.।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটলে রাষ্ট্রের কার্যাবলি ও দায়-দায়িত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নানাবিধ সমস্যা ও জটিলতা বৃদ্ধি পেলে তা নিরসনকল্পে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতেও জনকল্যাণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হতে থাকে। বৃদ্ধি পেতে থাকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের (Welfare state) ধারণা। এরপর থেকে আধুনিক রাষ্ট্র ‘জনগণের বন্ধু, দার্শনিক ও পরিচালকে’ (Friend, Philosopher and Guide) পরিণত হয়। বর্তমানে জনকল্যাণই রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হয়। এজন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে সুশাসনের ) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে তথ্যের সহজলভ্যতার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও দক্ষতা, সুশাসনের প্রয়োজনীয়তাকে আবশ্যকীয় করে তুলেছে।
বিশ্বব্যাংক ও UNDP-এর মতে, সুশাসনের মাধ্যমেই একটি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহকে প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের অধিকার ভোগ করতে পারে। এছাড়াও একটি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সে রাষ্ট্রে টেকসই উন্নয়ন সাধিত হয়। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশের জন্যও প্রয়োজন সুশাসন। এজন্যই ‘সুশাসন’ বিষয় সম্পর্কিত তাত্ত্বিক মিশেল ক্যামডেসাস (Michel Camdessus) বলেছেন যে, ‘রাষ্ট্রের সব ধরনের উন্নয়নের জন্য সুশাসন অত্যাবশ্যক’ (Good Governance is important for countries at all stages of development)। জাতিসংঘের আফ্রিকা অঞ্চলের বিশেষ উপদেষ্টা ইব্রাহিম গানবারি সুশাসনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বলেছেন যে, ‘যে সমস্ত রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শুধুমাত্র সে সমস্ত দেশেই ঋণ মওকুফ করা হবে’।
শাসন (Governance): Good Governance বা সুশাসন সম্পর্কে আলোচনার আগে জানা প্রয়োজন ‘শাসন’ বা শাসনের ব্যবস্থা’ বা ‘Governance’ বলতে কী বোঝায়। ‘গভর্নেন্স’ একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, ক্ষেত্র এবং প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ কারণে তাত্ত্বিকদের মধ্যে ‘গভর্নেন্স’ বিষয়ে সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ করা যায়৷
‘গভর্নেন্সকে’ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শাসনের ব্যবস্থা’ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। ল্যান্ডেল মিলস এবং সেরাজেল্ডিন (Landell Mills and Serageldin)-এর মতে, ‘জনগণ কীভাবে শাসিত হয়, কীভাবে রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি পরিচালিত হয়, কীভাবে দেশের রাজনীতি আবর্তিত হয় এবং একই সাথে এ সকল প্রক্রিয়া কীভাবে লোকপ্রশাসন ও আইনের সাথে সম্পর্কিত সে বিষয়কেই ‘গভর্নেন্স’ বলে।
The Oxford English Dictionary-তে শাসনের প্রক্রিয়া, শাসনের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব, ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হিসেবে গভর্নেন্সকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯৯৪ সালে বিশ্ব ব্যাংক প্রদত্ত সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, ‘সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো গভর্নেন্স।’
হালফ্যানি (Halfani) ও অন্যান্য গবেষকগণ সহমত পোষণ করে বলেন যে, ‘গভর্নেন্স হলো সরকারের এমন এক ব্যবস্থা যার লক্ষ্য কেন্দ্রীভূত থাকে রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের মধ্যে বৈধ সম্পর্ক ও উন্মুক্ত যোগাযোগ নিশ্চিত করা এবং সে সাথে কার্যকরী ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, নির্বাচনি প্রক্রিয়া স্থাপন এবং প্রতিনিধিত্বকারী দায়িত্বশীল সরকারি কাঠামোকে ক্রিয়াশীলকরণ।’
অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান-এর মতে, “শাসন হলো এমন একটি ধারণা যেখানে কর্তৃপক্ষ উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করে” (Governance is such a concept Ag authorities exercise for the organizational management to sustain development)।
ডি. কউফম্যান ও অন্যরা (D. Kaufmann & others) মনে করেন যে, যে প্রক্রিয়ায় শাসকবর্গ নির্বাচিত হন, জবাবদিহি করেন, নিরীক্ষিত ও পরিবর্তিত হন; সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সরকারি দক্ষতা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নির্ধারিত হয় এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে জনগণের অংশগ্রহণের মাত্রা বিবেচিত হয় তাকেই গভর্নেন্স বলে।
সুশাসন (Good Governance): ‘গভর্নেন্স’ প্রপঞ্চটির সাথে ‘সু’ প্রত্যয় যোগ করে ‘সুশাসন’ (Good Governance) শব্দটির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। এর ফলে ‘গভর্নেস্’-এর নরমেটিভ উপাদানের প্রকাশ ঘটেছে। এর ফলে সুশাসনের অর্থ দাঁড়িয়েছে নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করে যে, সুষ্ঠু গভর্নেন্স বা সুশাসন চারটি প্রধান স্তম্ভের ওপর নির্ভরশীল। এ চারটি স্তম্ভ হলো- ১. দায়িত্বশীলতা ২. স্বচ্ছতা, ৩. আইনি কাঠামো ও ৫. অংশগ্রহণ।
সুশাসনকে একক কোনো ধারণার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত বা বিশ্লেষণ করা যায় না। কেননা সুশাসনের ধারণাটি হলো বহুমাত্রিক। বিভিন্ন তাত্ত্বিক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা ‘সুশাসন’ ধারণাটির সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।
তারা ‘সুশাসন’ ধারণাটি বিশ্বব্যাংকের উদ্ভাবিত একটি ধারণা। একটি উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক সর্বপ্রথম উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ‘সুশাসন’ ধারণাটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় সর্বপ্রথম ‘সুশাসন’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। এতে উন্নয়নশীল দেশের অনুন্নয়ন চিহ্নিত করা হয় এবং বলা হয় যে, সুশাসনের অভাবেই এরূপ অনুন্নয়ন ঘটেছে। শুধু তাই নয়, সুশাসন নিশ্চিতকরণের জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তা’ পূরণের শর্তে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের ঋণ সাহায্য ও প্রকল্প সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
 
সুশাসনের সংজ্ঞা (Definition of Good Governance): সুশাসনকে একক কোনো ধারণার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। কেননা সুশাসনের ধারণাটি বহুমাত্রিক। তবে এরপরও বিভিন্ন তাত্ত্বিক, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা সংস্থা ‘সুশাসন’ ধারণাটির সংজ্ঞা প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। এগুলো নিম্নরূপঃ
বিশ্ব ব্যাংক (World bank)-এর মতে, “সুশাসন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়” (Good Governance is a manner in which power is exercised in the management of a country’s economic and social resources for development.)।
পিয়েরে ল্যান্ডেল মিলস্ এবং ইসমাইল সেরাজেলডিন (Pierre Landell, Mills and Ismail Serageldin) তাদের লিখিত ‘Governance and the Eternal Factor’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বলেছেন যে, “গভর্ন্যান্স বলতে বোঝায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার ব্যবহার যা একটি রাষ্ট্রকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে জনগণের সুষ্ঠু চাহিদা ও তাদের বৈধ অধিকার উপভোগের বাধ্যবাধকতা।”
অধ্যাপক ড. মহব্বত খান-এর মতে, “সুশাসন হলো একটি দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সম্পদের কার্যকরী ব্যবস্থা। তবে ব্যবস্থাটি হবে উন্মুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায্য সমতাপূর্ণ।”
UNDP-এর মতে, “একটি দেশের সার্বিক স্তরের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্বের চর্চার বা প্রয়োগের পদ্ধতিই হলো সুশাসন” (Good Governance is the exercise of economic, Political and administrative authority to manage a country’s affairs at all levels.)।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান (Kofi Annan) বলেছেন, “সুশাসন মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করে, গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা এবং সক্ষমতাকে প্রবর্তন করে।
ভি. কে. চোপড়া (V. K. Chopra) বলেন, “সুশাসন হলো শাসনের একটি পদ্ধতি যা সমাজের মৌলিক মূল্যবোধগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে চিহ্নিত করতে সমর্থ, সেখানে মূল্যবোধগুলো হচ্ছে মানবাধিকারসহ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক- সাংস্কৃতিক বিষয়ক এবং একটি দায়বদ্ধ ও সৎ প্রশাসনের মাধ্যমে এই মূল্যবোধগুলো অন্বেষণ করা” (Good governance is a system of governance that is able to Unambiguously identify the basic values of the society where values are economic, political and socio-culture issues including human rights and pursue these values through and accountable and honest administration.)।
জি. বিলনে (G. Bilney)-এর মতে, “Good Governance is the effective management of a country’s Social and economic resources in a manner that is open, transparent, accountable and equitable)।
মারটিন মিনোগের মতে, “বৃহৎ অর্থে সুশাসন হচ্ছে কতিপয় উদ্যোগের সমাহার ও একটি সংস্কার কৌশল যা সরকারকে আরো বেশি গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করার জন্য সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলে।”
The Social Encyclopaedia তে ‘সুশাসন’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, “এটি সরকার পরিচালনা অপেক্ষা একটি বিস্তৃত ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।” (It is a broader concept than Government, which is specially concerned with the role of Political authorities in maintaining social order within a defined territory and the exercise of executive power)।
চাই ‘সুশাসন’ সম্পর্কে একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন ম্যাককরনী (MacCorney)। তার মতে সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সাথে সুশীল সমাজের, সরকারের সাথে শাসিত জনগণের, শাসকের সাথে শাসিতের সম্পর্ককে বোঝায়’ (Good governance is the relationship between civil society and the state, between government an governed, the ruler and ruled)।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কর্তৃক সুশাসনের সঙ্গা প্রদানের সময় কাল

সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান সাল
বিশ্বব্যাংক (WB) ১৯৯২
এডিবি (ADB)
আইএমএফ (IMF)
আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (AFDB)
জাতিসংঘ (UN)
ইউএনডিপি (UNDP)
আইডিএ (IDA)

প্রতিষ্ঠানবাদীদের মতে, “অর্থনৈতিক প্রণোদনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশ ও সম্প্রসারণ ঘটাতে সক্ষম নয় সে রাষ্ট্রের পক্ষে ক্রমাগত ত টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া লালন করাও সম্ভব নয়। প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশ ও সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হলো সুশাসন।”

সুশাসনের প্রকৃতি ও ধরণ

শাসনব্যবস্থার একটি ইতিবাচক দিক হলো সুশাসন, যা জনকল্যাণ নিশ্চিত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে। এর প্রকৃতি হলো দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে মানবাধিকার নিশ্চিত করা ও মানবাধিকার সংরক্ষণ করা। সুশাসনের দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। এগুলে হলো –

  • বিশ্বব্যাংক এবং
  • পশ্চিমা বিশ্বের পন্ডিত ও তাত্ত্বিকদের মতবাদ

বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানের সময় সেসব দেশকেই অগ্রাধিকার দিবে যেসব দেশে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকবে। বিশ্বব্যাংক মনে করে জবাবদিহিতার মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

পশ্চিমা বিশ্বের পন্ডিত ও তাত্ত্বিকগণের মতে, “সুশাসন হলো গণতান্ত্রিক শাসন এবং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা তারা সুশাসনের ৪ টি দিকের কথা বলে। এগুলো হলো –

  • সুশাসন হলো অধিকতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা।
  • সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য আইনের উপর রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত।
  • রাজনৈতিক প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। জনগণের কাছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ জবাবদিহিতা করতে হবে।
  • শাসন কাঠামোর অন্যতম দিক হবে প্রশাসনিক দক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

সুশাসনের ভিত্তি বা উপাদানসমূহ

বিশ্বব্যাংক প্রবর্তিত সুশাসনের ধারণাটি মূলত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রযুক্ত কতগুলো শর্ত বা বিষয়ের সমন্বিত রূপ। এসব শর্ত বা বিষয়গুলোকেই সুশাসনের উপাদান বলা হয়। এর উপাদানগুলো হলো –

  • মূল্যবোধ
  • ঔচিত্যবোধ
  • স্বচ্ছতা
  • ন্যায়বিচার
  • দায়বদ্ধতা
  • অংশগ্রহণ
  • দায়িত্বশীলতা
  • সমতা
  • দক্ষ প্রশাসন ইত্যাদি।

তবে সুশাসনের উপাদানসমূহ সংস্থা ও রাষ্ট্রভেদে ভিন্নরূপ হয়ে থাকে।

বিশ্বব্যাংকের মতে সুশাসনের উপাদান

১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক এক রিপোর্টে সুশাসনের ৪ টি উপাদানের কথা বলেছে। এগুলো হলো –

  • সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা
  • যথাযথ বা বৈধ উন্নয়ন কাঠামো
  • দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা
  • স্বচ্ছতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ

তবে বিশ্বব্যাংকের অভিমত অনুসারে সুশাসনের ৬ টি উপাদান থাকা উচিত। এগুলো হলো –

  • বাকস্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা
  • আইনের শাসন
  • নিয়ন্ত্রণ গুণ
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অহিংসতার অনুপস্থিতি
  • সরকারের কার্যকারিতা
  • দুর্নীতি দমন

জাতিসংঘের মতে সুশাসনের উপাদান

জাতিসংঘ সুশাসনের ৮ টি উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করেছে। এগুলো হলো –

  • মতামতের উপর নির্ভরশীল
  • দায়বদ্ধতা
  • অংশগ্রহণ
  • কার্যকরী ও দক্ষ প্রশাসন
  • আইনের শাসনের অনুসারী
  • স্বচ্ছতা
  • জবাবদিহিতা
  • ন্যায়বিচারপ্রবণ

UNDP-এর মতে সুশাসনের উপাদান

UNDP এর পূর্ণরূপ হলো United Nations Development Program. ১৯৯৭ সালে UNDP সুশাসনের ৯ টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো –

  • অংশীদারত্ব (Perticipation)
  • আইনের শাসন (Rule of Law)
  • স্বচ্ছতা (Transparency)
  • সংবেদনশীলতা (Responsiveness)
  • জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা (Consensus orientation)
  • সাম্য (Equity)
  • কার্যকরীতা ও দক্ষতা (Effectiveness and Efficiency)
  • দায়বদ্ধতা (Accountability )
  • কৌশলগত লক্ষ্য (Strategic Vision)

IDA-এর মতে সুশাসনের উপাদান

IDA এর পূর্ণরূপ হলো The International Development Association. এটি ১৯৯৮ সালে সুশাসনের ৪ টি উপাদানের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। এগুলো হলো-

  • জবাবদিহিতা (Accountability)
  • অংশগ্রহণ (Participation)
  • ভবিষ্যদ্বাণী (Predictabiliy)
  • স্বচ্ছতা (Transparency)

UNHRC এর মতে সুশাসনের উপাদান

UNHRC সুশাসনের উপাদান ৫ টি উপাদানের কথা বলেছেন। এগুলো হলো –

  • Transparency
  • Responsibility
  • Accountability
  • Participation
  • Responsiveness

ESCAP এর মতে সুশাসনের উপাদান

ESCAP সুশাসনের ৯ টি উপাদানের কথা বলেছে। এগুলো হলো –

  • মৌলিক অধিকার
  • নাগরিক অংশগ্রহণ
  • আইনের শাসন
  • দায়িত্বশীলতা
  • স্বচ্ছতা
  • সকলের মতের ঐক্য
  • জবাবদিহিতা
  • সাম্যও সর্বভুক্তিকরণ
  • কার্যকারিতা ও দক্ষতা

কৌটিল্যের মতে সুশাসনের উপাদান

কৌটিল্যের মতে সুশাসনের ৪ টি উপাদান রয়েছে। এগুলো হলো –

  • আইনের শাসন
  • প্রশাসনের দায়িত্বশীলতা
  • ন্যায়বিচার ও যৌক্তিকতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
  • দুর্নীতিমুক্ত শাসন

সুশাসনের উপাদানকে আবার ২ ভাগে ভগ করা যায়। যথাঃ

  • প্রাতিষ্ঠানিক উপাদান
  • অপ্রাতিষ্ঠানিক উপাদান

প্রাতিষ্ঠানিক উপাদানসমূহ হলো –

  • স্বাধীন নির্বাচন কমিশন
  • কার্যকর সংসদ
  • সুদক্ষ আমলাতন্ত্র
  • স্বাধীন বিচার বিভাগ
  • শক্তিশালী স্থানীয় সরকার
  • স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন

অপ্রাতিষ্ঠানিক উপাদানসমূহ হলো –

  • বৈধ রাজনৈতিক ব্যবস্থা
  • সফল ও কার্যকর নেতৃত্ব
  • সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
  • রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
  • সরকারের দায়িত্বশীলতা
  • কার্যকর শাসন
  • আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা
  • বিকেন্দ্রীকরণ
  • সম্পদের সুষম বন্টন
  • মানবাধিকারের অংশগ্রহণ
  • নারীর ক্ষমতায়ন
  • সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থা
  • দুর্নীতির মূলোৎপাটন।

কোন সংস্থার মতে সুশাসনের উপাদান কয়টি?

সংস্থার নাম উপাদান গৃহীত সাল
বিশ্বব্যাংক ১৯৯৪
এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ১৯৯৫
জাতিসংঘ
UNDP ১৯৯৭
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (IDA) ১৯৯৮
আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক (AfDB) ১৯৯৯
কৌটিল্যের মতে ৪ টি

সুশাসনের প্রতিবন্ধকতা

সুশাসন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিম্নের প্রতিবন্ধকতাসমূহ পরিলক্ষিত হয়।

  • অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব
  • রাজনৈতিক অস্থিরতা
  • সামাজিক অসাম্য
  • বাক স্বাধীনতার উপর সরকারের হস্তক্ষেপ
  • ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব
  • দলীয়করণ
  • বিজ্ঞ নেতার অভাব
  • জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাব
  • অপরাজনীতি
  • বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতার অভাব
  • আইনের শাসনের অনুপস্থিতি
  • নাজুক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ইত্যাদি।

সুশাসন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর

০১. সুশাসনের মূল ভিত্তি কি?

  • মূল্যবোধ
  • আইনের শাসন
  • গণতন্ত্র
  • আমলাতন্ত্র

উত্তরঃ আইনের শাসন

০২. সুশাসনের পূর্বশর্ত হচ্ছে –

  • মত প্রকাশের স্বাধীনতা
  • নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা
  • নিরপেক্ষ আইন ব্যবস্থা
  • প্রশাসনের নিরপেক্ষতা

উত্তরঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতা

০৩. উৎপত্তিগত অর্থে Governance শব্দটি কোন ভাষা থেকে এসেছে?

  • ল্যাটিন
  • গ্রিক
  • হিব্রু
  • ফারসি

উত্তরঃ গ্রিক

০৪. UNDP সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কয়টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন?

  • ৬ টি
  • ৭ টি
  • ৮ টি
  • ৯ টি

উত্তরঃ ৯ টি

০৫. বিশ্বব্যাংকের মতে সুশাসনের উপাদান কয়টি?

  • ৩ টি
  • ৪ টি
  • ৫ টি
  • ৬ টি

উত্তরঃ ৬ টি

০৬. সুশাসন শব্দটি সর্বপ্রথম কোন সংস্থা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে?

  • জাতিসংঘ
  • বিশ্বব্যাংক
  • UNDP
  • IMF

উত্তরঃ বিশ্বব্যাংক

০৭. সুশাসনের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা কোনটি?

  • দারিদ্র্য
  • অর্থনীতি
  • দুর্নীতি
  • রাজনীতি

উত্তরঃ দুর্নীতি

০৮. কোন বছর UNDP সুশাসনের সংঙ্গা প্রবর্তন করেন?

  • ১৯৫
  • ১৯৯৭
  • ১৯৯৮
  • ১৯৯৯

উত্তরঃ ১৯৯৭

০৯. সুশাসনের পথে অন্তরায় –

  • আইনের শাসন
  • জবাবদিহিতা
  • স্বজনপ্রীতি
  • ন্যায়পরায়ণতা

উত্তরঃ স্বজনপ্রীতি

১০. আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ কোনধরণের?

  • ঊর্ধ্বমুখী
  • নিম্নমুখী
  • কল্যাণমুখী
  • পশ্চাৎমুখী

উত্তরঃ কল্যাণমুখী

১১. জাতিসংঘ সুশাসনের কয়টি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছে?

  • ৫ টি
  • ৬ টি
  • ৭ টি
  • ৮ টি

উত্তরঃ ৮ টি

১২. “সর্বোৎকৃষ্ট কল্যাণ সাধন রাষ্ট্রের লক্ষ্য” উক্তিটি কার?

  • থেলিস
  • প্লেটো
  • অ্যারিস্টটল
  • রুশো

উত্তরঃ অ্যারিস্টটল

১৩. “ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য” উক্তিটি কার?

  • লর্ড ব্রাইস
  • বিচারপতি হিউজেস
  • অধ্যাপক লাস্কি
  • আব্রাহাম লিংকন

উত্তরঃ অধ্যাপক লাস্কি

১৪. সমাজে একতা প্রতিষ্ঠা করে কোনটি?

  • নৈতিকতা
  • আইন
  • শৃঙ্খলাবোধ
  • সহনশীলতা

উত্তরঃ শৃঙ্খলাবোধ

১৫. “জবাবদিহিতার মাধ্যমেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব” অভিমতটি কার?

  • বিশ্বব্যাংক
  • ইইউ’র
  • আইডিবি’র
  • আইএমএফ’র

উত্তরঃ বিশ্বব্যাংক

তো আজ এপর্যন্তই থাকলো। আশা করি সুশাসন কাকে বলে? সুশাসনের প্রকৃতি ও ধরণ, উপাদান বা ভিত্তি কি? সম্পর্কে কিছুটা হলেও দিতে পেরেছি। আর্টিকেলটি পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না কিন্তু।

 

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “সুশাসন কাকে বলে? সুশাসনের প্রকৃতি ও ধরণ, উপাদান বা ভিত্তি কি?” আর্টিকেলটি পছন্দ হয়ে থাকলে, অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

Similar Posts