Modal Ad Example
পড়াশোনা

দ্বৈত শাসন বলতে কী বোঝায়? | দ্বৈত শাসন কী?

1 min read

দ্বৈত শাসন বলতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নবাবের যৌথ শাসন ব্যবস্থাকে বোঝায়।

১৭৬৫ সালে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ দিল্লিতে মোঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন। দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানির পক্ষে রবার্ট ক্লাইভ বাংলার নবাব নজম-উদ-দৌলাকে বার্ষিক ৫৩ লক্ষ টাকা দেন। বিনিময়ে ইংরেজ কোম্পানি রাজস্ব আদায়, সামরিক ব্যবস্থা এবং প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব পায়। যদিও দেশ শাসনের দায়িত্ব আগের মতোই নবাবের হাতে ছিল। এভাবে কোম্পানি লাভ করে দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব পান ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। এই অদ্ভুত শাসনব্যবস্থাই দ্বৈত শাসন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ব্যবস্থায় বাংলার নবাব সামান্য বৃত্তিভোগী কর্মচারীতে পরিণত হলেন । আর প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ইংরেজ কোম্পানি এদেশের প্রকৃত প্রভু হয়ে বসলেন । নবাব ও কোম্পানির মধ্যে এই ক্ষমতা ভাগাভাগির ফলে দেশশাসন ও প্রজাসাধারনের মঙ্গল বিধানের দায়িত্ব কেউই পালন করত না । ফলে বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ দেখা দেয় । ক্ষমতাহীন নবাব সেই বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থ হন । কোম্পানি নিযুক্ত রাজস্ব বিভাগের দুই সহকারী রেজা খাঁ ও সিতাব রায়ের শোষণ ও অত্যাচারে প্রজাদের দুর্দশার অন্ত ছিল না । পরিণতিতে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বা ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বাংলায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । এটি ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত ।

স্বরূপ: দেওয়ানি লাভের আগেই কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে ২৪ পরগনা জেলা এবং মিরকাশিমের কাছ থেকে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের পর বাংলার অবশিষ্ট অংশে রেজা খানকে কোম্পানি নায়েব দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করে। রেজা খানকে পরিচালনার জন্য রায়দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে তার সহকারী হিসেবে কোম্পানি নিযুক্ত করে। অপরদিকে মুর্শিদাবাদ দরবার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস মাইকাসের ওপর। এইভাবে বাংলায় কোম্পানি ও নবাবের মধ্যে দেওয়ানি ও নিজামিত ক্ষমতার বিভাজন ঘটে।

 

দ্বৈত শাসন প্রবর্তনের কারণ

দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি চেয়েছিল , ধীরে ধীরে বাংলার শাসনক্ষমতা করায়ত্ত করতে । রবার্ট ক্লাইভ মনে করতেন —

  • কোম্পানি সরাসরি শাসনক্ষমতায় এলে অন্যান্য ইউরােপীয় বাণিজ্যগােষ্ঠীর মধ্যে এক তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে  পারে ।
  • ইংরেজ কর্মচারীবা বাংলার রাজস্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয় ।
  • প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ব্রিটিশ কর্মচারীর অভাব রয়েছে । এইসব কারণে কোম্পানি সরাসরি সমস্ত ক্ষমতা গ্রহণ না করে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা চালু করে ।

ঐতিহাসিক র‍্যামসে ম‍্যুরের  মতে , কোম্পানি নিজে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের খােলস ছেড়ে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে চায়নি ।

দ্বৈত শাসনের স্বরুপ

দেওয়ানি লাভের আগেই কোম্পানি মিরজাফরের কাছ থেকে ২৪ পরগনা জেলা এবং মিরকাশিমের কাছ থেকে বর্ধমান , মেদিনিপুর ও চট্টগ্রাম জেলা লাভ করেছিল । দেওয়ানি লাভের পর বাংলার অবশিষ্ট অংশেে রেজা খাঁনকে কোম্পানি নায়েব দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করে । রেজা খাঁনকে পরিচালনার জন্য রায়দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে তাঁর সহকারী হিসেবে কোম্পানি নিযুক্ত করে । অপরদিকে মুরশিদাবাদে দরবার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস সাইকসের ওপর । এভাবে বাংলায় কোম্পানি ও নবাবের মধ্যে দেওয়ানি ও নিজামতি ক্ষমতার বিভাজন ঘটে এবং দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার প্রচলন হয় ।

দ্বৈত শাসনের ফলাফল 

কোম্পানি একচেটিয়াভাবে বিনাশুল্কে বাণিজ্য কায়েম করায় দেশীয় শিল্প – বাণিজ্য ধ্বংস হয় । অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের লােভে ইজারাদাররা কৃষকদের ওপর অত্যন্ত চড়া হাবে কর নির্ধারণ করে । যে কৃষকরা তা দিতে অক্ষম হয় তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয় ।

ভারতে কোম্পানির বাণিজ্যের জন্য ইংল্যান্ড থেকে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয় । বাংলা থেকে আদায় করা রাজস্বেই পণ্য ক্রয় করে কোম্পানি এই পণ্য বিক্রয়ের মুনাফা ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয় ।

কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা স্বনামে ও বেনামে বাঁধ , সেতু ও রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ , লক্ষ টাকা মুনাফা লােটে ।

দ্বৈতশাসনেব কুফলরূপে সেসময় বাংলায় দেখা দেয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ( বাংলা ১১৭৬ , ইংরেজি  ১৭৭০ খ্রি .) । এই মন্বন্তরে বাংলার এক – তৃতীয়াংশ লােক অনাহারে মারা যায় ।

 

দ্বৈত শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর বাংলায় একদিকে রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানি মামলা বিচারের অধিকার লাভ করে। অন্যদিকে, নবাব নিজামত (প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা) লাভ করে অর্থাৎ কোম্পানির রাজস্ব আদায় ও শাসন পরিচালনা উভয় ক্ষমতাই লাভ করে। এ ধরনের দ্বৈত শাসনব্যবস্থায় বাংলার সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি ও স্বাভাবিক জনজীবন ভেঙে পড়ে। এ প্রসঙ্গে রিচার্ড বাউচার একটি চিঠিতে লিখেছেন— “অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী শাসনেও যে দেশ সমৃদ্ধ ছিল, তা এখন ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে।”

[1] শিল্পবাণিজ্যের ধ্বংসসাধন: দ্বৈত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক অধিকারকে কাজে লাগিয়ে বাংলার বাণিজ্যে একচেটিয়াভাবে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে দেশীয় শিল্প ও বাণিজ্যের ধ্বংসসাধন ঘটে। রবার্ট ক্লাইভ বলেছেন—আমি শুধু এটুকু বলেছি যে, পৃথিবীর আর কোনাে দেশে এত অরাজকতা, বিভ্রান্তি, ঘুষ, দুর্নীতি এবং উৎপীড়ণ, শােষণের ঘটনা কেউ শােনেনি বা দেখেনি—যা হয়েছিল এই দেশে।

[2] কৃষকদের দুর্দশা বৃদ্ধি: কোম্পানি দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার পেলেও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ না করে তা দেশীয় কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত করে। এই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী অর্থাৎ ইজারাদাররা কৃষকদের কাছ থেকে চড়া হারে রাজস্ব আদায় শুরু করে। রাজস্ব প্রদানে অক্ষম কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হলে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে।

[3] কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি: দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সুযােগে কোম্পানির কর্মচারীরা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা স্বনামে ও বেনামে বিল অব এক্সচেঞ্জ, বাঁধ-সেতু-রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করে।

[4] ছিয়াত্তরের মন্বন্তর: দ্বৈত শাসনের কুফল হিসেবে বাংলাতে মর্মান্তিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বঙ্গাব্দ ১১৭৬ ইংরেজি ১৭৭০ খ্রি.) দেখা দেয়। প্রথমে অনাবৃষ্টির কারণে শস্যহানির ফলে এই দুর্ভিক্ষ ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে কোম্পানির উদাসীনতা ও নিষ্ঠুর শাসননীতির জন্য তা বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়।

মন্তব্য: দ্বৈত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি পেয়েছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা আর নবাব পেয়েছিলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব। ইতিহাসবিদ জন কের মতে, “দ্বৈত শাসনব্যবস্থা বিশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থাকে আরও বিশৃঙ্খল এবং দুর্নীতিকে আরও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলে।” অবশেষে ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটান।

উপসংহার

ওয়ারেন হেস্টিংস সিলেক্ট কমিটির রিপাের্টের ভিত্তিতে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটান । সেসময়কার বাংলার দুরবস্থা প্রসঙ্গে রিচার্ড বিচার এক চিঠিতে লিখেছেন — অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী শাসনেও যে দেশ সমৃদ্ধিশালী ছিল তা ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে । রবার্ট ক্লাইভ বলেছেন — আমি শুধু এটুকু বলেছি যে , পৃথিবীর আর কোনাে দেশে এত অরাজকতা , বিভ্রান্তি , ঘুষ , দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন ও শােষণের ঘটনা কেউ শােনেনি বা দেখেনি — যতটুকু হয়েছিল এই বাংলা দেশে ।

 

শেষ কথা:
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটি পছন্দ হয়েছে। আমি সর্বদা চেষ্টা করি যেন আপনারা সঠিক তথ্যটি খুজে পান। যদি আপনাদের এই “দ্বৈত শাসন বলতে কী বোঝায়?” আর্টিকেল পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই ৫ স্টার রেটিং দিবেন।

4.9/5 - (116 votes)
Mithu Khan

I am a blogger and educator with a passion for sharing knowledge and insights with others. I am currently studying for my honors degree in mathematics at Govt. Edward College, Pabna.

x