মসজিদুল হারামের অজানা ১০ তথ্য

পৃথিবীতে আর কোনো স্থাপনা এমন সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনি, যতোটা সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছে মসজিদুল হারাম। বর্তমান সউদি আরবের মক্কায় অবস্থিত পৃথিবীতে প্রথম আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্ধারিত এই স্থানে সারাবিশ্ব থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার মুসলমান জিয়ারতে আসেন। এই মসজিদে অবস্থিত তাওহীদের প্রতীক পবিত্র কাবা মুসলমানদের কেবলা। মুসলমানরা বিশ্বের যে স্থানেই থাকুক না কেন, বর্গাকার আকৃতির এই ঘরের দিকে মুখ করে তারা নামাজ আদায় করে।

আমাদের সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার এই মসজিদটির অনেক কিছুই আমাদের অজানা।

এখানে মসজিদুল হারাম সম্পর্কে এমন দশটি অজানা তথ্য উপস্থাপন করা হলো-

১. প্রাচীনতম মসজিদ

মসজিদুল হারাম পৃথিবীতে আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্ধারিত প্রথম স্থান। কুরআনে বলা হয়েছে,

إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ

অর্থ: নিঃসন্দেহে মানুষের (ইবাদতের) জন্য নির্ধারিত প্রথম ঘর বাক্কায় (মক্কায়), সমগ্র সৃষ্টির জন্য অশেষ বরকতময় ও হেদায়েতের উৎস। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৯৬)

হযরত আবু যর গিফারী (রা.) বর্ণনা করেছেন,

‘আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে কোন মসজিদটি প্রথম তৈরি করা হয়?” তিনি উত্তর দিলেন, “মসজিদুল হারাম।” আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “এরপর কোনটি?” তিনি উত্তর দিলেন, “মসজিদুল আকসা।” (মুসলিম)

কুরআন-হাদীসের এই বিবরণ প্রমাণ করছে, মসজিদুল হারাম পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদ।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মসজিদুল হারাম। ছবি: পিন্টারেস্ট

তবে কে প্রথম এই মসজিদ তৈরি করেছেন, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। কোন কোন মুফাসসিরের (তাফসীরকারক) মতে, আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা প্রথম বর্তমান কাবাঘরের স্থানে একটি ঘর তৈরি করেন। আবার অনেক মুফাসসীর মত প্রকাশ করেছেন, হযরত আদম (আ.) প্রথম এ স্থানে আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি ঘর তৈরি করেন। কালের বিবর্তনে এই ঘর ধ্বংস ও পরিত্যাক্ত হওয়ার পর আল্লাহ নতুন করে হযরত ইবরাহীম (আ.) কে এখানে আল্লাহর ইবাদতের জন্য ঘর তৈরির নির্দেশ দেন।

وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لَّا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ

অর্থ: যখন আমি ইবরাহীমকে বায়তুল্লাহর (কাবা) স্থান নির্দেশ করে দিয়েছিলাম, (তখন আদেশ দিলাম) আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার ঘরকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারীদের জন্যে, নামাযে দন্ডায়মানদের জন্যে এবং রকু সেজদাকারীদের জন্যে। (সূরা হজ্জ্ব, আয়াত: ২৬)

وَعَهِدْنَا إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ

অর্থ: এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১২৫)

২. কুরআনে নাম উল্লেখ

পবিত্র কুরআনে মাত্র দু’টো মসজিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে ফিলিস্তিনের জেরুসালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসার নাম একবার উল্লেখ করা হলেও কুরআন মাজীদে মসজিদুল হারামের নাম এসেছে ভিন্ন ভিন্ন মোট ১৫টি আয়াতে।

মসজিদুল আকসা থেকে কেবলা পরিবর্তন করে যখন মসজিদুল হারামের দিকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, আল্লাহ তখন তার রাসূলের কাছে ওহী নাজিল করেন,

 

قَدْ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ ۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا ۚ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ ۚ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ ۗ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ ۗ وَمَا اللَّـهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ

অর্থ: নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত সত্য। আল্লাহ বেখবর নন, সে সমস্ত কাজ সম্পর্কে যা তারা করে। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৪৪)

তেমনিভাবে রাসূল (সা.) এর মিরাজ যাত্রার ঘটনায় কুরআনে উঠে এসেছে মসজিদুল হারামের নাম।

بْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

অর্থ: পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত; যার চার দিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা ইসরা, আয়াত: ১)

এই দুই আয়াত ছাড়া কুরআনের সূরা বাকারার ১৪৯, ১৫০, ১৯১, ১৯৬, ২১৭ নম্বর আয়াত, সূরা মায়েদার ২ নম্বর আয়াত, সূরা আনফালের ৩৪ নম্বর আয়াত, সূরা তওবার ৭, ১৯, ২৮ নম্বর আয়াত, সূরা হজ্জ্বের ২৫ নম্বর আয়াত, সূরা ফাতহের ২৫ ও ৪৮ নম্বর আয়াতে মসজিদুল হারামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. বৃহত্তম মসজিদ

শুধু প্রাচীনতমই নয়, মসজিদুল হারাম বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। ৪ লাখ ৮ শত বর্গমিটার আয়তনের এই মসজিদে একসাথে ৪০ লাখ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের সম্প্রসারণ কাজ এখনো চলমান আছে।

মসজিদুল হারামের বর্তমান স্থাপনা। ছবি: পিন্টারেস্ট

৪. কাবার পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার

আজকে আমরা যেই কাবা দেখতে পাই, এটি একদম শুরু থেকেই বর্তমান ছিলো না। ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে এর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।

হযরত ইবরাহীম (আ.) নির্মিত কাবার মডেল। ছবি: ইসলামিক ল্যান্ডমার্কস

আল্লাহর আদেশে হযরত আদম (আ.) এর প্রথম কাবা তৈরির পর কালের বিবর্তনে তা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ.) কে কাবা তৈরির আদেশ দিলে তিনি তার ছেলে ইসমাইল (আ.) এর সহায়তা নিয়ে নতুন করে কাবা তৈরি করেন। যে পাথরের উপর দাঁড়িয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) কাবা তৈরি করেন, সেটি মাকামে ইবরাহীম নামে পরিচিতি লাভ করে। কাবা তৈরি করতে গিয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর যখন উঁচু হয়ে দাঁড়ানোর দরকার ছিলো, তখন আল্লাহর নির্দেশে পাথরটি ইবরাহীম (আ.) কে নিয়ে উঁচু হয়ে যেতো। আবার যখন ইবরাহীম (আ.) এর নিচু হয়ে পাথর নেওয়ার প্রয়োজন হতো, তখন পাথরটি আবার নিচু হয়ে যেতো। কাবার নিকটেই বর্তমানে বিশেষ বেষ্টনীর মধ্যে পাথরটি সংরক্ষিত রয়েছে।

কাবার নিকটে বিশেষ বেষ্টনীতে সংরক্ষিত মাকামে ইবরাহীম (বামে), বেষ্টনীর ভেতর ইবরাহীম (আ.) এর পায়ের চিহ্নযুক্ত পাথর (ডানে)

হযরত ইবরাহীম (আ.) এর পরেও আরো অনেকবার কাবা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। এই সংস্কার করতে গিয়ে কাবা আর তার পুরনো আকৃতিতে থাকেনি।

বর্তমান যে বর্গাকার আকৃতির কাবা আমরা দেখছি, এটি হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সময় ছিলো না। তার সময় কাবার আকৃতি বরং আয়তাকার ছিলো। বর্তমানে কাবার বাইরে উত্তর-পশ্চিম দিকে অর্ধ-বৃত্তাকার দেওয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা অংশটুকুও কাবার সাথে যুক্ত ছিলো। এই অংশটুকু বর্তমানে ‘হিজরে ইসমাইল’ ও ‘হাতিম’ নামে পরিচিত।

ডানে ইবরাহীম (আ.) নির্মিত কাবা ও বামে পরবর্তীকালে কুরাইশদের পুনর্নির্মিত কাবা। ছবি: ইন্টারনেট

হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার তিনি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন কাবার কাছে ‘হাতিমে’র অংশটুকু কাবার অর্ন্তুভুক্ত অংশ কিনা। রাসূল (সা.) সম্মতিসূচক উত্তর দিলে তিনি আবার প্রশ্ন করেন, তাহলে কেন এটি কাবার সাথে যুক্ত না। রাসূল (সা.) উত্তর দিলেন,

“কারণ তোমার লোকদের (কুরাইশ) কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ ছিলো না।” (বুখারী)

হিজরে ইসমাইলসহ কাবার বর্তমান চিত্র। ছবি: ইসলামিক ল্যান্ডমার্কস

রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে কুরাইশরা একবার কাবার পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এসময় তারা ওয়াদা করে, তারা শুধু তাদের হালাল অর্থ এই কাজে খরচ করবে। নির্মাণকাজের মাঝপথে তাদের হাতে থাকা অর্থ শেষ হয়ে গেলে তারা নির্মাণ কাজ এখানেই শেষ করতে বাধ্য হয়। এর মাধ্যমেই কাবা বর্তমান বর্গাকার আকৃতি ধারণ করে। পুননির্মিত কাবার বাইরে থাকা অংশটি মাটির তৈরি ইটের দেওয়াল দিয়ে তারা সেসময় ঘিরে রাখে। পরে এই অংশটি ‘হিজরে ইসমাইল’ ও ‘হাতিম’ নামে পরিচিতি পায়।

হিজরে ইসমাইল/হাতিম। ছবি: ইসলামিক ল্যান্ডমার্কস

মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা.) হাতিমকে যুক্ত করে নতুন করে কাবা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফেতনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তিনি তখন তা স্থগিত রাখেন। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) তার খালা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) এর কাছ থেকে রাসূল (সা.) এর এই ইচ্ছার কথা জানেন। পরবর্তীকালে উমাইয়া খলীফাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মক্কায় তার সংক্ষিপ্তকালীন শাসনামলে তিনি হাতিমকে যুক্ত করে ইবরাহীম (আ.) এর সময়কার আকারে কাবাকে নতুনভাবে নির্মাণ করেন। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) কে পরাজিত ও শহীদ করার পর উমাইয়া গর্ভনর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কাবাকে আবার কুরাইশদের নির্মিত বর্গাকার আকৃতিতে নিয়ে যান।

(উপরে ডান থেকে ঘড়ির কাঁটার গতিপথ অনুযায়ী) ইবরাহীম (আ.) নির্মিত কাবা, পরবর্তী কুরাইশদের নির্মিত কাবা, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) নির্মিত কাবা ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নির্মিত কাবা। ছবি: ইন্টারনেট

এর অনেক পরে আব্বাসী খলীফা হারুন আল-রশীদ কাবাকে রাসূল (সা.) এর ইচ্ছা অনুযায়ী ইবরাহীম (আ.) এর তৈরি আকৃতিতে পুনর্নিমাণ করতে চাইলে ইমাম মালিক ইবনে আনাস (রা.) তাকে এই বলে নিষেধ করেন যে, এভাবে একজন শাসক এক আকৃতিতে কাবা পুনর্নিমাণ করলে আরেক শাসক এসে তা পরিবর্তন করবে। এর মাধ্যমে আল্লাহর ঘর শাসকদের হাতের খেলনায় পরিণত হবে।

ইমাম মালিকের কথায় খলীফা হারুন আল-রশীদ কাবাকে ইবরাহীম (আ.) এর সময়কার আকৃতিতে নতুনভাবে তৈরি করা থেকে বিরত হন। সেই থেকে কাবা বর্তমান বর্গাকার আকৃতিতেই রয়েছে।

তবে রাসূল (সা.) এর পর থেকে খোলাফায়ে রাশেদা, উমাইয়া, আব্বাসীয়া, মামলুক, ওসমানীসহ বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল শাসনমলেই কাবার বিভিন্ন সংস্কার কাজ করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে কাবাঘরের ব্যাপকভাবে সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়। তখন ঘরটির দেওয়াল থেকে ক্ষয়ে যাওয়া অনেক পাথর প্রতিস্থাপন করা হয় এবং কাবার ছাদ ও ভিত্তি নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

.১৯৯৬ সালে কাবার সংস্কারকাজ। ছবি: ইলমফিড

৫. রঙবেরঙের কিসওয়া

বর্তমানে আমরা কাবার কিসওয়া তথা আবরণীরূপে সোনালী ক্যালিওগ্রাফি ও নকশার কাজ করা কালো গেলাফই দেখতে অভ্যস্থ। অন্য কোনো রঙের কিসওয়া সম্পর্কে আমরা এখন ধারণাই করতে পারিনা।

কিন্তু কিসওয়া সবসময়ই কালো রঙের ছিলো না। জাহেলিয়াতের যুগেও কাবাকে আবৃত রাখার প্রথা চালু ছিলো। তবে তখন বর্তমান কালো রেশমি কাপড়ের পরিবর্তে লাল ডোরাকাটা সাদা ইয়েমেনি কাপড়ে কাবা আবৃত রাখা হতো।

খোলাফায়ে রাশেদার যুগে কাবার কল্পিত চিত্র। ছবি: টিভি সিরিজ ওমর

খোলাফায়ে রাশেদার যুগে কাবাকে সম্পূর্ণ সাদা রঙের ইয়েমেনি কাপড়ের গেলাফ পরানো হতো। উমাইয়া আমলে কিসওয়া হিসেবে প্রথম সাদার পাশাপাশি লাল ও সবুজ রঙের কাপড়ের ব্যবহার শুরু হয়।

আব্বাসী আমলেও শুরুর দিকে সাদা-লাল-সবুজ রঙের কিসওয়া ব্যবহার করা হতো। একইসাথে তারা তাদের বংশীয় প্রতীক কালো রঙের কাপড়ও কিসওয়া হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। আব্বাসী খলিফা আল-নাসির লি-দ্বীনিল্লাহর (১১৮০-১২২৫) সময়ে প্রথম কিসওয়া হিসেবে শুধু কালো রঙের রেশমি কাপড় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কাবার গেলাফ হিসেবে শুধু কালো রঙের রেশমি কাপড় ব্যবহার করা হচ্ছে।

ওসমানী (অটোমান) শাসনামলে কাবার কিসওয়ার একটি অংশ (বামে); ওসমানী শাসনামলে কাবার চিত্র (ডানে)। ছবি: অটোমান ইম্পিরিয়াল আর্কাইভ

৬. খণ্ড-বিখণ্ড হাজরে আসওয়াদ

কাবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় সংরক্ষিত হাজরে আসওয়াদকে রূপার আবরণের মধ্যে সংরক্ষণের বিষয়টি নিয়ে অনেকেই কৌতুহলী।

কাবার দেওয়ালে সংযুক্ত হাজরে আসওয়াদ (বামে); রূপার আবরণীতে সংরক্ষিত হাজরে আসওয়াদ (ডানে)। ছবি: ইসলামিক ল্যান্ডমার্কস

কেউ বলেন, উমাইয়া খলীফা ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার সেনাবাহিনী যখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) এর শাসনাধীন মক্কা অবরোধ করে, তখন সেনাবাহিনীর নিক্ষিপ্ত মিনজানিকের পাথরের আঘাতে হাজরে আসওয়াদ ভেঙে যায়। পরে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) তা রূপার আবরণীতে সংরক্ষণ করেন।

অখণ্ড হাজরে আসওয়াদের কাল্পনিক চিত্র। ছবি: উইকিমিডিয়া

তবে হাজরে আসওয়াদ ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে বেশি যে বর্ণনাটি পাওয়া যায় তা হলো, দশম শতকে আরব উপদ্বীপের বাহরাইনকেন্দ্রিক পূর্বাঞ্চলীয় উগ্রপন্থী কারামতী সম্প্রদায় প্রচার করেছিল কাবায় হজ্জ্ব করা একটি জাহেলী যুগের প্রথা এবং তারা হাজীদেরকে কাবায় হজ্জ্ব করতে নিরুৎসাহিত করেছিলো। ৯৩০ ঈসায়ীতে তারা মক্কা আক্রমণ করে কাবাঘরে লুটতরাজ করে এবং হজ্জ্ব করতে আসা ৩০ হাজার হাজীকে হত্যা করে জমজম কূপে ফেলে দেয়।

জমজম কূপ। ছবি: মাদায়েন প্রজেক্ট

মক্কায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর তারা ফিরে যাওয়ার সময় তাদের সাথে কাবার দরজা ও হাজরে আসওয়াদ খুলে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কাবার দরজা ও হাজরে আসওয়াদ যখন তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়, তখন পাথরটি কয়েকটি খন্ডে বিভক্ত ছিলো। এই ভাঙা টুকরাগুলো সংযুক্ত করে রূপার আবরণীতে বাধাই করে রাখা হয়।

৭. কাবার চাবি সংরক্ষণ

রাসূল (সা.) এর সময়ে কাবার রক্ষণাবেক্ষনের জন্য বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কিত দায়িত্ব কুরাইশ গোত্রের বিভিন্ন পরিবারের ওপর ন্যাস্ত ছিল। সময়ের আবর্তনে এই সকল পরিবারগুলোর দায়িত্ব বিলুপ্ত হলেও বিশেষ একটি দায়িত্ব এখনো কুরাইশদের একটি পরিবার বহন করে আসছে।

মক্কা বিজয়ের সময় রাসূল (সা.) কাবার চাবি সংরক্ষণকারী বনী শাইবা পরিবারের ওসমান ইবনে তালহার কাছ থেকে চাবি নিয়ে কাবায় প্রবেশ করেন। পরে তিনি চাবিটি ওসমান ইবনে তালহার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন,

“হে বনী শাইবা, কেয়ামত পর্যন্ত এটি গ্রহণ কর এবং কোনো অত্যাচারী, অন্যায়কারী ছাড়া আর কেউ তোমাদের কাছ থেকে এটি কেড়ে নেবে না।”

তালা আটকানো কাবার দরজা; (ইনসেটে) কাবার দরজার তালা ও চাবি। ছবি: আল-আরাবিয়া

খলীফা কিংবা সুলতান অথবা বাদশাহ, যেই হোক না কেন, সকলেই রাসূল (সা.) এর এই বাণীর প্রতি সম্মান জানিয়ে কাবার চাবি আজও পর্যন্ত বনী শাইবা পরিবারের হাতেই সংরক্ষণ করে আসছে। যখনই কেউ কাবায় প্রবেশ করতে চান, তখন কাবার দরজা খুলে দেওয়ার জন্য এই পরিবারের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। বর্তমানে বনী শাইবা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠতম সদস্য সালিহ আল-শাইবী কাবার চাবি সংরক্ষণ করছেন। ২০১৩ সালে তার চাচা আবদুল কাদের আল-শাইবীর ইন্তেকালের পর ৭৭তম কাবার চাবিরক্ষক হিসেবে তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

কাবার চাবি হাতে আবদুল কাদের আল-শাইবী (বামে) ও সালেহ আল-শাইবী (ডানে)

৮. কাবার অভ্যন্তরে

খুব সাম্প্রতিক সময় পর্যন্তও সপ্তাহে দু’দিন কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য সর্বসাধারণের জন্য এর দরজা খোলা থাকতো। যেকেউই তখন কাবার ভেতরে গিয়ে নামাজ আদায় ও দোয়া করতে পারতেন। কিন্তু বর্তমানে ভিড় বেড়ে যাওয়ায় এখন সাধারণের জন্য তা আর খোলা হয় না। শুধু বছরে দু’বার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য কাবার দরজা খোলা হয়। এছাড়া কদাচিৎ অনুমতি পাওয়া বিশেষ বিশেষ অতিথিদের জন্য কাবার দরজা খোলা হয়।

১৯৫৩ সালের হজ্জ্বের সময় খোলা থাকা কাবার দরজা। ছবি: ইলমফিড

আগে কাবায় প্রবেশের জন্য একটি দরজা এবং বের হওয়ার জন্য আরেকটি দরজা ছিলো। এছাড়া কাবার একপাশে একটি জানালা ছিলো। বর্তমানে শুধু একটি দরজা রেখে অপর দরজা ও জানালাটি পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

কিসওয়ার আড়ালের কাবার বন্ধ করে দেওয়া দরজার চিহ্ন

ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন শাসকের হাতেই কাবাঘরের সংস্কারকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যারাই কাবাঘর সংস্কার করেছেন, তারা সকলেই তাদের নাম সংবলিত ফলক কাবাঘরের অভ্যন্তরের দেওয়ালে সংরক্ষণ করেছেন। বর্তমানেও এসকল ফলক কাবার অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আছে।

কাবার ভেতরের দেওয়াল সম্পূর্ণভাবে মার্বেল পাথর দিয়ে আবৃত করে রাখা হয়েছে। আগে কাবার অভ্যন্তরে মোট ছয়টি কাঠের থাম বা স্তম্ভের অবস্থান ছিল। বর্তমানে কাবার ছাদকে ধরে রাখার জন্য তিনটি কাঠের থাম রয়েছে। এই থামগুলোর ব্যাস ৪৪ সেন্টিমিটার এবং এগুলো উচ্চতায় ৯ মিটার লম্বা। অভ্যন্তরভাগ আলোকিত করার জন্য থামগুলোর মধ্যে একটি কড়িকাঠের অবস্থান রয়েছে, যাতে তামা বা রূপার তৈরি বাতিদান ঝুলানোর ব্যবস্থা রয়েছে।

কাবার অভ্যন্তরের চিত্র, ডানে সাদা মার্বেলে চিহ্নিত রাসূল (সা.) এর নামাজ আদায়ের স্থান। ছবি: ইসলামিক ল্যান্ডমার্কস

মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সা.) কাবার ভেতরে যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করেছিলেন, সেস্থানটি বর্তমানে বিশেষ মার্বেল পাথর দিয়ে আবৃত করে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।

এছাড়া কাবার দরজার ডানে কাবার ছাদে যাওয়ার জন্যে একটি সিঁড়িপথ রয়েছে। সিঁড়িপথটি মূলত অ্যালুমমিনিয়াম দ্বারা তৈরি।

কাবার ছাদে যাওয়ার সিড়িপথের দরজা। ছবি: আল-আরাবিয়া

এখানে কাবার অভ্যন্তরের একটি ভিডিওচিত্র সংযুক্ত করা হলো।

৯. বন্যার সমস্যা

চারদিকে পাহাড় ঘেরা একটি ঢালু উপত্যকায় মক্কা শহরের অবস্থান। ফলে হঠাৎ কখনো বৃষ্টি হলে চারপাশের পাহাড় থেকে পানি এসে মক্কা শহর প্লাবিত করতো এবং কাবাঘরসহ সম্পূর্ণ মক্কা পানিতে ডুবে যেতো। মক্কায় এরূপ বন্যা কখনোই অস্বাভাবিক ঘটনা ছিলো না। বন্যার ফলে পুরো শহরে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি হতো। এরমধ্যে কাবা তাওয়াফকারীদের বন্যার কারনে অনেকসময় সাঁতার কেটে তাওয়াফ করতে হত।

১৯৪১ সালে বন্যায় প্লাবিত কাবা। ছবি: ইন্টারনেট

বর্তমানে বন্যারোধী বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মক্কায় এখন আর আগের মত বন্যা হয়না। তবুও মাঝে মাঝে প্রচন্ড বৃষ্টি হলে কাবা, মসজিদুল হারাম সহ মক্কায় পানি জমে যায়।

১০. দুই কাবা

পৃথিবীর কাবার মতোই ঊর্ধ্বজগতে আল্লাহর আরশের কাছে অবিকল অপর একটি কাবা রয়েছে। প্রতিদিনই সত্তর হাজার ফেরেশতা ‘বাইতুল মামুর’ হিসেবে পরিচিত ঊর্ধ্বজগতের এই কাবায় ইবাদত করতে আসেন।

কুরআন কারীমে সূরা তূরের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ এই ঘরের শপথ করে (وَالْبَيْتِ الْمَعْمُورِ) কিয়ামতের নিশ্চয়তা প্রকাশ করেছেন।

হযরত মালিক ইবনে সা’সা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) মিরাজ যাত্রার হাদীসে বর্ণনা এসেছে, মিরাজের রাতে রাসূল (সা.) বাইতুল মামুর দেখে এর সম্পর্কে জিবরাইল (আ.) এর কাছে জানতে চান। হযরত জিবরাইল (আ.) তখন তাকে বলেন,

“এটি বাইতুল মামুর যেখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশতা এসে ইবাদত করেন। এরপর তারা যখন চলে যান, দ্বিতীয়বার তারা আর এখানে প্রবেশের সুযোগ পান না।” (অর্থাৎ প্রতিদিনই নতুন ফেরেশতার দল এখানে ইবাদতের জন্য আসেন।) (বুখারী ও মুসলিম)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *