বদর যুদ্ধের কারণ সমূহ | ব্যাখ্যা ও আলোচনা

বদর যুদ্ধ কি ইসলামের ইতিহাসে তথা বিশ্বের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনা শরিফের মধ্যবর্তী অঞ্চলে “বদর” নামক প্রান্তরে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মার্চ মক্কার বিধর্মী ও মুসলমানদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল তাকে বদরের যুদ্ধ বলা হয়। এ যুদ্ধ ছিল মুসলমান ও ইসলামের জন্য ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ (সা.) যদি পরাজিত হতেন তাহলে হয়ত বা শিশু ইসলামের অকাল মৃত্যু ঘটত। তাই ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। বদরের যুদ্ধের কারণ বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে একক কোনো কারণ দায়ী ছিল না, বরং এর পিছনে নানাবিধ কারণ দায়ী ছিল। বদরের যুদ্ধের কারণসমূহ নিয়ে আলোকপাত করা হলো। ১. ইসলামের শক্তিবৃদ্ধি মক্কার কুরাইশগণ হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়ে ভেবেছিল জন্মভূমি ত্যাগ করে নবী করিম (সা.) দুর্বল হয়ে পড়বেন এবং ইসলাম নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু মদিনায় ইসলামের দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে মক্কার কাফেররা দিশেহারা হয়ে ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম তথা মদিনার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধি ছিল এ যুদ্ধের অন্যতম কারণ। ২. আব্দুল্লাহ বিন উবাইর দুরভিসন্ধি আব্দুল্লাহ বিন উবাইর দুরভিসন্ধিকে বদর যুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে নিজে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রাধান্য সহ্য করতে না পেরে মক্কার কুরাইশদেরকে নবী করিম (সা.) এর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। এক পর্যায়ে সে মুনাফিকদের সাথে জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ৩. ইহুদিদের ষড়যন্ত্র মদিনা সনদের মাধ্যমে মদিনায় বসবাসরত ইহুদিরা নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা পেলেও ইসলামের দ্রুত বৃদ্ধির ফলে তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে মদিনা সনদের শর্তভঙ্গ করে। তারা মদিনার মুসলমানদের গোপন সংবাদসমূহ মক্কায় সরবরাহ করে কুরাইশদেরকে মদিনা আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করে। সৈয়দ আমির আলী বলেন, “Madina itself was honeycombed by sedition and treachery.” (BOOK ref.: the life and teachings of Muhammad (saw)) ৪. বাণিজ্য পথ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা বদর যুদ্ধের আরেকটি কারণ হিসেবে বাণিজ্য পথ রুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কাকে চিহ্নিত করা হয়। মক্কার বণিকরা সিরিয়া, মিশর এবং অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য করতো। মদিনায় মহানবী (সা.) এর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলে কুরাইশদের বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে এ আশঙ্কায় তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং মুসলমানদের চিরতরে ধ্বংস করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ৫. হিংসার সূচনা মদিনাতে ইসলাম সাফল্যজনকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংবাদে কুরাইশদের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব সৃষ্টি হয়। তারা সমগ্র পৌত্তলিক গোত্রসমূহকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। এ প্রসঙ্গে মাওলানা মুহাম্মদ আলী বলেন, “ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য কুরাইশদের উদ্যোগই যুদ্ধের একমাত্র কারণ।” ৬. বহির্বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি সে সময় মক্কা থেকে মদিনা হয়ে সিরিয়া বা অন্যান্য দেশে ব্যবসায় বাণিজ্যের জন্য যেতে হতো বলে হয়রত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের পর মক্কার সাথে মদিনার সুসম্পর্ক নষ্ট হয় এবং তিক্ততার সৃষ্টি হয়। এ কারণে সমগ্র আরবের কাফেররা মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের উপস্থিতি ব্যবসায়বাণিজ্যের প্রতিবন্ধক বলে মনে করে। ৭. ইসলামকে ধ্বংসের পরিকল্পনা হিজরতের পর থেকে মদিনায় ইসলামের ব্যাপক প্রসার দেখে কাফেররা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা ইসলামকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ব্যর্থ হয়। ফলে অন্য উপায় না দেখে তারা যুদ্ধে আসার পরিকল্পনা করে। ফলে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৮. নাখলার খণ্ডযুদ্ধ মক্কার কুরাইশ ও তাদের সাহায্যকারী গোত্রসমূহ মাঝে মাঝে মদিনার মুসলমানদের শস্যখেত জ্বালিয়ে দিত, ফলবান বৃক্ষ নষ্ট করতো এবং উট, ছাগল অপহরণ করে নিয়ে যেত। হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনা সনদে স্বাক্ষরকারী গোত্রসমূহের জানমালের নিরাপত্তার জন্য আব্দুল্লাহ বিন জাহাসের নেতৃত্বে ১২ জনের একটি গোয়েন্দা দল সীমান্তবর্তী এলাকায় টহল দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেন। টহলদার গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে কুরাইশ নেতা, আমর নিহত হয়। নাখলা নামক স্থানে অনুষ্ঠিত এ খণ্ডযুদ্ধ বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। ৯. অর্থনৈতিক কারণ আরবদেশ অনুর্বর ও অনুন্নত হওয়ার কারণে মক্কার লোকেরা ব্যবসায়বাণিজ্যের জন্য মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের উপর নির্ভর করতো। মক্কাবাসী মনে করেছিল, মদিনায় মুসলমানদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেলে মদিনার মধ্য দিয়ে তাদের বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা যে কোনো উপায়ে ইসলামের গতিপথ বন্ধ করে দিতে সংকল্পবদ্ধ হয়। ১০. আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার কুরাইশদের অন্যতম নেতা আবু সুফিয়ান বাণিজ্যের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সিরিয়া গমন করেন। তার একজন প্রতিনিধিকে মক্কায় এনে প্রচার করে যে, কুরাইশ কাফেলা মুসলমান সেনা কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছে। আবু সুফিয়ানের এ প্রচারণা মক্কাবাসীদের মনে ভীষণ ক্রোধের সঞ্চার করে। তাই তারা আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্যসহ মদিনা আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়। ১১. মক্কাবাসীদের ক্ষোভ আবু সুফিয়ানের মিথ্যা প্রচারণা এবং হাদরামি হত্যা মক্কাবাসীদের মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে । ফলে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ১২. হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আশ্রয়দান বদর যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আশ্রয়দান। মক্কাবাসীরা হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিদের বিপ্লবী বলে মনে করতো। মদিনাবাসীরা তাঁদের আশ্রয় দেওয়ায় মক্কার কুরাইশরা তাদের উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিল।