(১) দোয়েল
দোয়েল একটি ছোট্ট পাখি। পালকগুলো সাদা-কালো। লেজটা ঊর্ধ্বমুখী। লোকালয়ে আর অগভীর জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়ায়। ঝোপে, ঝাড়ে, গাছের কোটরে দালানের ফাঁকফোকরে থাকে। দোয়েলের মতো মিষ্টি গান গাইতে পারে খুব কম পাখি। নরম সুরে শিস দেয়। বসে থাকে গাছের উঁচু ডালে। মাঝেমধ্যে মধুর সুরে গানের তালে তালে লেজ নাচায়। সাদা-কালোয় সাজানো এর পালকের পোশাক। ডানার ওপরে চওড়া টানা দাগ। এর লেজ বেশ লম্বা। এরা গাছের শিকড়-বাকড় দিয়ে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। বিভিন্ন ফুলের মধু আর কীটপতঙ্গ এদের প্রধান খাবার। দোয়েল আমাদের জাতীয় পাখি।
(২) ছবি আঁকা
মানুষ ভাবতে ভালোবাসে। মানুষের মনে যে ভাবনাগুলো খেলা করে, তার শিল্পময় প্রকাশই ছবি আঁকা। কে কখন ছবি আঁকা শুরু করেছিল, তা বলা মুশকিল। তবে মানুষের আঁকা সবচেয়ে পুরোনো ছবির কথা জানা যায়। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে আলতামিরা নামক এক গুহায় প্রথম মানুষের আঁকা ছবির সন্ধান মেলে। যেকোনো মানুষই ছবি আঁকে। পশু, পাখি, মাছ, আম–জাম, কাঁঠাল, পেঁপে—এর কোনো না কোনোটি মানুষ জীবনে একবার হলেও এঁকেছে। আঁকতে আঁকতে অনেকের ছবি আঁকাটাই নেশা হয়ে যায়। তখন জীবনে ছবি আঁকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। ছবি আঁকা নিয়েই তাদের স্বপ্ন, ছবি আঁকাই তাদের পেশা হয়ে যায়। তারা আপন প্রতিভার প্রকাশ ঘটায় ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন শুধু ছবি এঁকে। তাঁরা কালকে অতিক্রম করেছেন। ছবি আঁকাই তাঁদের পৃথিবীতে অমরত্ব দান করেছে।
(৩) বাংলাদেশের পাখি
পাখির দেশ, নদীর দেশ বাংলাদেশ। পাখিরা প্রকৃতির অংশ। পাখির প্রধান বৈশিষ্ট্য পালক দিয়ে চেনা যায়। বাংলাদেশে আছে ৬৪টি প্রজাতির ৬০০ পাখি। এর মধ্যে স্থানীয় পাখির সংখ্যা ৪০০, অতিথি পাখি ২০০। বাংলাদেশের পাখিগুলো হলো দোয়েল, চড়ুই, টুনটুনি, বুলবুলি, পানকৌড়ি, শালিক, খঞ্জন, জলময়ূর, ভালুক, শ্যামা, ধনেশ, পানডুবি, ফিঙে, টিয়া, বাবুই, জলপিপি ইত্যাদি। পাখি আমাদের অনেক উপকার করে। অধিকাংশ পাখি পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। পরিবেশ রক্ষা করে। কিছু কিছু পাখি বর্জ্য খেয়ে পরিবেশ দূষণ থেকে আমাদের বাঁচায়। এরা আমাদের প্রতিবেশীর মতো। পাখি আমাদের বন্ধু।
(৪) বেগম রোকেয়া
রংপুরের পায়রাবন্ধ গ্রাম। সেই গ্রামেই জন্ম হলো এক শিশুর। নাম তাঁর রোকেয়া। রোকেয়ার দুই বোন আর দুই ভাই। রোকেয়ার পড়াশোনা করার কী অদম্য আগ্রহ! বড় বোনের কাছে তিনি বাংলা শিখলেন। রাত গভীর হলে ভাইয়ের কাছে শুরু হতো তাঁর জ্ঞানার্জন। লুকিয়ে লুকিয়েই পড়া শিখেছেন রোকেয়া। তখন মেয়েদের স্বাধীনতা ছিল না, ছিল না লেখাপড়া করার সুযোগ। যা কিছু করার অধিকার, সবই ছিল ছেলেদের। মেয়েরাও যে লেখাপড়া শিখে কিছু করতে পারে, সে কথা কেউ ভাবতেই পারত না। ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হলো। কয়েক বছর পরই স্বামী মারা গেলেন। এবার রোকেয়ার শুরু হলো আরেক জীবন। মুসলমান মেয়েরা তখন অনেক পিছিয়ে। লেখাপড়া করার স্কুল নেই। মেয়েদের যদি উন্নতি করতে হয়, লেখাপড়া শিখতেই হবে। তাই স্বামীর নামে মেয়েদের একটা প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। রোকেয়া মনে করতেন, মেয়েরা পিছিয়ে থাকলে সেই সমাজের উন্নতি হতে পারে না। তিনিই প্রথম মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মারা যান ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর।
(৫) ফেরিওয়ালা
যে ফেরি করে জীবন চালায় সে ফেরিওয়ালা। রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে নানা ধরনের সামগ্রী বিক্রি করে যে জীবিকা নির্বাহ করে, সেই ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালা আমাদের নিত্যদিনের পরিচিত ব্যক্তি। প্রতিদিনই আমরা দেখি তারা পাড়ায় পাড়ায়, রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের জিনিস, মাছ, তরকারি, ফল, খাবার, কাপড়চোপড় ইত্যাদি বিক্রি করে। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আমাদের বাসার সামনে হাজির হয়। বাজারের চেয়ে কম দামে তাদের কাছ থেকে এসব কেনা যায়। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের গান গেয়ে তারা ক্রেতার মন জয় করার চেষ্টা করে। অনেক ফেরিওয়ালা আবার চুড়ি, ফিতাসহ নানা ধরনের খেলনা বিক্রি করে। যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে অনেক ফেরিওয়ালা অনেক পরিবারের সঙ্গে আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা আমাদের চাহিদামতো অনেক জিনিস দূর শহর থেকেও এনে দেয়। এভাবে তারা আমাদের সময় ও শ্রম বাঁচায়। সমাজে যে যে কাজই করুক না কেন, তাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফেরিওয়ালাদের সম্মান দেখানো আমাদের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব।
(৬) শীতের পিঠা
ষড়ঋতুর দেশ এই বাংলাদেশ। শীতকাল এগুলোর অন্যতম ঋতু। শীতকালে নতুন ধান ওঠে। সেই ধানে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর উৎসব শুরু হয়। নতুন চালের গুঁড়া আর খেজুর রসের গুড় দিয়ে বানানো হয় নানা রকম পিঠা। এগুলোর নানা রকম নাম, নানা রকম রূপের বাহার। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা ছাড়া আরও হরেক রকম পিঠা তৈরি হয় বাংলার ঘরে ঘরে। পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি মুখরোচক খাবার আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে শীতকালে। এ সময় শহর থেকে অনেকেই গ্রামে যায় পিঠা খেতে। তখন গ্রামের বাড়িগুলো নতুন অতিথিদের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে। শীতের সকালে চুলার পাশে বসে গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। গ্রামের মতো শহরে শীতের পিঠা সে রকম তৈরি হয় না। তবে শহরের রাস্তাঘাটে শীতকালে ভাপা ও চিতই পিঠা বানিয়ে বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া অনেক বড় বড় হোটেলে পিঠা উৎসব হয়। পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির একটি অন্যতম উপাদান। আর শীতের পিঠা আমাদের খাদ্যতালিকায় এনেছে বৈচিত্র্য।
(৭) সকালবেলা
সকালবেলাটা আমার খুবই প্রিয় একটা সময়। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। হাতমুখ ধুয়ে আমরা বাড়ির পাশে নদীর তীরে হাঁটতে যাই। সেখান থেকে সকালের সূর্যোদয় খুবই সুন্দর লাগে। সকালে শীতল বাতাস আমার দেহ-মন জুড়িয়ে দেয়। নানা রকম পাখির কলকাকলিতে পরিবেশটা মুখরিত হয়ে ওঠে। এ সময় কৃষকেরা গরু নিয়ে হালচাষ করতে বের হন। গ্রামের মসজিদে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সমস্বরে পবিত্র কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমি বাড়ি ফিরে নাশতা করে পড়তে বসি। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে স্কুলে যাই। ছুটির দিনে সকালবেলা আমি বাবাকে নানা কাজে সাহায্য করি। সকালবেলা তাড়াতাড়ি উঠলে আমার সারাটা দিন খুব ভালো কাটে।
(৮) ঘরের সামনের রাস্তা
আমার ঘরের সামনে একটি হাঁটা রাস্তা আছে। ঘর থেকেই রাস্তাটি দেখা যায়। রাস্তাটি শুরু হয়েছে পাশের গ্রাম থেকে। একটি বড় রাস্তার সঙ্গে গিয়ে এটি মিশেছে। সারা দিনই এ রাস্তা দিয়ে মানুষ যাওয়া-আসা করে। কত রকমের মানুষ যে এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে, তার হিসাব নেই। অফিসের কর্মচারী, কৃষক, ছাত্রছাত্রী, দিনমজুর, ফেরিওয়ালা প্রভৃতি পেশার মানুষ সকালবেলা তাদের কর্মক্ষেত্রে যায় এ রাস্তা দিয়ে। কাজ শেষে বিকেলে আবার ফিরে আসে তাদের বাড়িতে এ রাস্তা দিয়েই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি পথিকের আনাগোনা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—এক এক ঋতুতে রাস্তাটি এক এক রূপ ধারণ করে। পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় রাস্তাটি খুব সুন্দর লাগে। তখন মনে হয় রাস্তাটি যেন চলে গেছে কোনো অজানার দেশে। আমার জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে এ রাস্তা।
(৯) একটি পুরোনো বটগাছ
আমার জন্ম সাল এখন আর মনে পড়ে না। তবে এ দেশের মানুষকে শ দুয়েক বছর ধরে দেখছি। অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আমার ছায়ায় আস্তানা গেড়েছে। বাজার বসেছিল একটানা অনেক দিন। মাঝখানে শুধু মেলা বসত। যুদ্ধের বছরটাতে হাজার হাজার মানুষ চলার পথে আমার ছায়ায় শান্তি খুঁজেছে। অকারণে আমার ওপর অত্যাচারও কম হয়নি। অনেক ভয়ের কাহিনি আছে আমাকে নিয়ে। অনেক শুনেছি মানুষের কষ্টের কাহিনি, নীরব সাক্ষী হয়ে দেখেছিও অনেক। আমার ঝুরি ও ডালপালাগুলো দেখে বৃদ্ধ মনে হলেও এখনো আমি পাখির সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে গাই যৌবনের গান। কালের সাক্ষী হিসেবে অনেক সম্মান পেয়েছি আমি। তবু মানুষের সেবা করতে পেরে ধন্য আমি।