ওয়েল্ডিং কি? এর ইতিহাস।What is Welding?

দুই বা ততোধিক ধাতুকে তাপের সাহায্যে গলায়ে বা না গলায়ে নরম করে চাপের মাধ্যমে জোড়া দেয়ার পদ্ধতিকে ওয়েল্ডিং (Welding) বলে। যেমন- জাহাজ, পুল, ইস্পাতের কাঠামাে (Steel structure), ট্যাংক (Tank), পাইপ লাইন (Pipe line) ইত্যাদি তৈরি করতে এবং ভাঙ্গা বা ফাটলবিশিষ্ট ঢালাই বস্তুকে মেরামত করতে ওয়েল্ডিং পদ্ধতি সর্বাধিক উপযােগী পদ্ধতি। ওয়েল্ডিং-এর দ্বারা উৎপন্ন জোড়কে ওয়েল্ডমেন্ট (Weldment) বলে। যিনি ওয়েল্ডিং করেন তাঁকে ওয়েল্ডার (Welder) বলে।
ওয়েল্ডিং এর ইতিহাস
আজ যে “ওয়েল্ডিং” প্রযুক্তির সাথে পরিচিত– এমনিতেই তা অর্জিত হয় নাই। অনেক চড়াই-উতড়াই ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ওয়েন্ডিং-এর ইতিহাস। উনবিংশ শতাব্দির সাড়া জাগানাে টাইটানিক জাহাজডুবির মূল কারণও ওয়েল্ডিং। আবার বিংশ শতাব্দির সেরা গৌরব চাঁদে পদাপর্ণের মূল অংশীদারও ওয়েন্ডিং। অধুনা ওয়েল্ডিং প্রযুক্তির গুণে মানুষের তৈরি যন্ত্রযান পাথ ফাইন্ডার পৃথিবীর ন্যায় আরেকটি পৃথিবী মঙ্গল গ্রহে বিচরণ করেছে, এমনকি সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে কোন্‌ সুদূরের পানে যে রকেট নামক যন্ত্রযানটি ছুটে চলেছে তাও ওয়েল্ডিং এরই ক্রিয়া কৌশল। এ জন্যই বলা হয় , “Welding is the art of joining metals” অর্থাৎ, ওয়েল্ডিং হল, “ধাতব পদার্থের জোড়া দেয়ার কলা”। এটা আধুনিক বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার যুগ। মানব সভ্যতার গােড়া পত্তনে যে প্রযুক্তি-বুনিয়াদি ভীত হিসেবে ইতিহাসে ঠাই করে নিয়েছে তাই ওয়েল্ডিং (Welding)। ঠিক করে বলা না গেলেও ধাতব যুগের সমসাময়িক কাল থেকেই ওয়েল্ডিং প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হয়। তখন ফোর্জড ওয়েল্ডিং (Forged Welding) এবং রিভেটিং হতাে। এতে করে প্রকৃত পক্ষে জোড়া স্থানটি তেমন শক্তিশালী হতাে না। সুতরাং গবেষণা ও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকল কীভাবে অল্প সময়ে ও অল্প খরচে শক্তিশালী জোড়া দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৮০ সালে রাশিয়ার অন্তর্গত সেন্ট পিটার্সবার্গ নামক স্থানে ক্যাষ্টন কর্তৃক আর্ক ওয়েল্ডিং শুরু হয় এবং এর পরের বছর ১৮৮১ সালে স্টোরেজ ব্যাটারি প্লেট এর বিভিন্ন অংশ জোড়া দেবার জন্য আর্ক ওয়েল্ডিং-এর ব্যবহার ডি-মেরিটার্স কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু শুধু এতটুকুতেই আবিষ্কার স্পৃহা সীমাবদ্ধ রইল না। ১৮৮৬ সালে এলিহু থমসন বিভিন্ন ধাতুকে জোড়া দেবার জন্য আরও উন্নত রেজিস্ট্যান্স ওয়েল্ডিং (Resistance welding) প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন যা বাট ওয়েল্ডিং (Butt welding) নামে পরিচিত।
উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে জার্মান প্রকৌশলী স্ল্যাভিয়ানফ (Slavianoff) আর্ক ওয়েন্ডিং-এ ব্যবহৃত ধাতব ইলেকট্রোড (Metalic Electrode) উদ্ভাবন করেন। স্ল্যাভিয়ানফ এই ব্যাপারে পুরাে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হননি। ক্রমে আরাে অনেকের অবদানে এর উন্নয়ন ঘটে।
বিংশ শতাব্দির শুরু থেকে ওয়েল্ডিং-এর ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ১৯০১ – ১৯০৩ সালের ভিতরে অক্সি-এসিটিলিন ওয়েল্ডিং প্রক্রিয়ার বিশেষ উন্নয়ন ঘটে। ফ্রান্সে এডমন্ড কুকী পিকীরিটের সাহায্যে ওয়েল্ডিং যন্ত্রপাতির প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। এসময় থেকে ওয়েল্ডিং শিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ করতে থাকে।
১৯০৫ সালে সুইডিশ বিজ্ঞানী কিলবার্গ ফ্লাক্স ইলেকট্রোড আবিষ্কার করেন। এছাড়া তা আর্ক-ওয়েল্ডিং-এর ব্যবহার করে পূর্বের অসমাপ্ত আর্ক ওয়েল্ডিংকে পূর্ণতা দান করেন।
১৯০৭ সালের মধ্যে অক্সি-অ্যাসিটিলিন এর যন্ত্রপাতি ইউরোপে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এরপর ওয়েল্ডিং পদ্ধতির ব্যবহার ইউরােপের সীমানা পেরিয়ে আফ্রিকা, এশিয়া হয়ে ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯২০ সালে হিলিয়াম ও আর্গন গ্যাস দুইটি টাংস্টেন ইলেকট্রোড প্রান্ত ও আর্কস্থলকে ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে দেখা যায়, গ্যাস আবৃত থাকার দরুন অক্সিডেশন প্রতিহত হয় ও ওয়েল্ডিং নিখুঁত হয়। ১৯১২ সালে সর্বপ্রথম ফ্লাক্স আবৃত ইলেকট্রোড সম্পর্কে ধারণা অর্জিত হয় এবং ১৯২৯ সালে সর্বপ্রথম তা ব্যবহৃত হয় ও ১৯২৯ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তা বাজারে ছাড়া হয়।
১৯২০ এর কোঠায় সাব মার্জড আর্ক ওয়েল্ডিং আবিষ্কৃত হয়। এতে জোড় অঞ্চল প্রচুর পরিমাণ ফ্লাক্সের ভিতর নিমজ্জিত থাকে। এবং একটি ধাতব এবং কার্বন ইলেকট্রোড ব্যবহারে ওয়েল্ডিং করা হয়। এভাবে কাল পরিক্রমায় ওয়েল্ডিং সহজ, দ্রুত ও নিখুঁত হয়।
১৯৪০ সালে রাসেল মেরিডিথ উড়ােজাহাজের অ্যালুমিনিয়ায় ও ম্যাগনেশিয়াম যন্ত্রাংশ ওয়েল্ডিং করতে নিষ্ক্রিয় গ্যাস আবৃত প্রণালি (Inert gas process) অবলম্বন করেন। বর্তমানে মিগ এবং টিগ ওয়েল্ডিং-এ থেকে উদ্ভাবিত হয়।
১৮৮১ সাল থেকে প্লাজমা আর্ক (Plasma arc) ওয়েল্ডিং সম্বন্ধে গবেষণা শুরু হয় এবং ১৯২৫ সালে মােটামুটি কার্যকর প্রমাণিত হয়। জার্মান বৈজ্ঞানিক গের্ডিয়ান একটি নযল বা নিয়ন্ত্রিত সরুপথে ইলেকট্রিক আর্ক প্রবাহিত করে দেখতে পান আর্কের গতি ও তাপমাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। উত্তপ্ত নযলটিকে পানির প্রবাহ দ্বারা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। আর্ক-এর সাথে চাপযুক্ত হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম গ্যাস প্রবেশ করিয়ে দিলে গ্যাস এবং আর্ক আয়ােনাইজড (Ionised) হয়ে তীব্র বেগে জেটের ন্যায় বের হতে থাকে। এর ফলে তাপমাত্রা অতি উচ্চে, এমনকি ৫৫০০০° সেন্টিগ্রেড (প্রায় ১০০০০০° ফারেনহাইট) পর্যন্ত উঠে থাকে।
ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট এম গাগু (Robert M Gagu) নিউইয়র্ক এর একটি গবেষণাগারে এরূপ প্লাজমা আর্কের সাহায্যে ধাতু ওয়েল্ডিং, কাটিং এবং স্প্রেইং (spraying) করতে সক্ষম হন।
১৯৫৮-৬০ সাল থেকে প্লাজমা জেটের সাহায্যে সুন্দরভাবে স্টেইনলেস স্টিল ও অন্যান্য কঠিন ধাতু কাটা শুরু হয়। বিশেষ করে এটি আর্ক অঞ্চলকে গাদ (Slag) দিয়ে এবং গ্যাস দিয়ে আবৃত রাখে। ফলে নিখুঁত ওয়েল্ডিং সম্ভব হয়।
১৯৫০ এর দিকে ইলেকট্রোস্ল্যাগ ও ইলেকট্রোগ্যাস ওয়েল্ডিং উদ্ভাবিত হয়। এক্ষেত্রে রাশিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া প্রায় যুগপৎভাবে এর উপর গবেষণা চালায় ও অবশেষে কৃতকার্য হয়।
১৯৩৮ সালে আলট্রাসনিক ওয়েল্ডিং অর্থাৎ অতি উচ্চহার শব্দোত্তর তরঙ্গ (সেকেন্ডে ৬০,০০০ বার) সৃষ্টি করে ধাতু ওয়েল্ডিং করার পন্থা আবিষ্কৃত হয়। উক্ত তরঙ্গ হেতু ধাতু পৃষ্ঠে দানার আকার ক্ষুদ্রতর হয়। ফলে সহজে ওয়েল্ডিং করার উপযােগী হয়ে ওঠে। ফ্রিকশন ওয়েল্ডিং সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় রাশিয়াতে। এতে ঘূর্নায়মান একটি ধাতু খণ্ডকে স্থির অন্য একটি খণ্ডের মুখােমুখি সংস্পর্শে ধরা হয়। ফলে সংযােগ স্থলে ঘর্ষণ হেতু ধাতু উত্তপ্ত হয়ে গলে যায়। অতঃপর উচ্চ চাপ প্রয়ােগ করে অনেকটা ফোর্জিং পদ্ধতির ন্যায় কয়েক সেকেন্ডের ভিতর ওয়েল্ডিং সম্পন্ন করা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৪ – ৪৫ এর দিকে ইলেকট্রন বিম ওয়েল্ডিং কার্যকর প্রামাণিত হয়। ১৮৯৫ সালে থার্মিট ওয়েল্ডিং আবিষ্কার করেন জার্মানীর হ্যানস গােল্ডস্মিথ। ১৯০২ সালে সুইজারল্যান্ডের ইঞ্জিনিয়ার শুপ গালিত ধাতু ছিটিয়ে ওয়েল্ডিং পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এভাবেই নিত্য নতুন ওয়েল্ডিং প্রক্রিয়ার উদ্ভাবনসহ ব্যাপক উন্নতি সাধন হতে থাকে।
বর্তমানে ওয়েল্ডিং প্রক্রিয়ার নবতর সংযােজন যেমন- টিগ ওয়েল্ডিং, মিগ ওয়েল্ডিংসহ নানা অত্যাধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার ফলে আজ সূক্ষ্মতি সূক্ষ্ম জোড় তৈরির কার্য সম্পাদন করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন ভারী যন্ত্রপাতি তৈরি সহজ হয়েছে তেমনি সুক্ষ্ম কাজেও ওয়েল্ডিং-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখা দিয়েছে।
বর্তমানে ওয়েল্ডিং প্রক্রিয়া যন্ত্রের পাশাপাশি মানুষের দেহের শিরা উপশিরা সংযােজন তথা স্থায়ী জোড় তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিধায় ওয়েল্ডিংকে মানব বন্ধন প্রক্রিয়াও বলা হয়। অতএব, এক কথায় বলা যায় দুইটি মন বাদে যে কোন দুই বা ততােধিক বস্তুর বন্ধন বা জোড় তৈরির সর্বাধুনিক পদ্ধতির নাম ওয়েল্ডিং (Welding)।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *