মাহদীর হাকীকত ও কিয়ামতের আলামতগুলোর ক্রমধারা
প্রশ্ন:
ইমাম মাহদী কে কিংবা তিনি কে হবেন? তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহতে কি কোন দলিল আছে? কিয়ামতের আলামতগুলো প্রকাশ পাওয়ার ক্রমধারা কী; যার মধ্যে মাহদীর আবির্ভাব, দাজ্জালের ফিতনা, ইয়াজুজ-মাজুজ ও ঈসা আলাইহিস সালামের অবতীর্ণ হওয়া রয়েছে? আশা করি বিস্তারিত জবাব দিবেন।
উত্তর: আলহামদু লিল্লাহ।.
ইমাম মাহদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর একজন সৎ মানুষ। যিনি শেষ যামানায় আসবেন। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ্ মানবজাতির পরিস্থিতি সংশোধন করবেন এবং পৃথিবী জুলম ও অবিচারে ভরে যাওয়ার পর ন্যায় ও ইনসাফে ভরে উঠবে। তাঁর নাম হবে নবী সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে। তাঁর পিতার নাম হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতার নামে। তাঁর পুরো নাম হবে এমন: মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ্ আল-মাহদী কিংবা আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ্ আল-মাহদী। তাঁর বংশধারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কণ্যা ফাতিমা (রাঃ)-এর কাছে গিয়ে সমাপ্ত হবে। তিনি হবেন হাসান বিন আলী (রাঃ)-এর বংশধারায়। তিনি আবির্ভূত হওয়ার আলামত হলো দুঃসময় ও পৃথিবী জুলুম-অত্যাচারে ভরে যাওয়া।
তিনি আবির্ভুত হওয়া ও তাঁর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্টগুলোর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু হাদিসে। যে হাদিসগুলো সামষ্টিকভাবে ভাবগত-মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছেছে। 1252 নং প্রশ্নোত্তরে তা বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।
আর কিয়ামতের আলামতগুলো সম্পর্কে কথা হলো:
এ ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তাদের মতভেদের কারণ হলো: সুন্নাহতে আলামতগুলোর কোন ক্রমধারা উদ্ধৃত না হওয়া। কিন্তু আলেমগণ কিছু ঘটনার ক্রমধারা উদ্ভাবন করেছেন; যা নিম্নরূপ:
১। কিয়ামতের ছোট আলামতগুলো প্রকাশ পাওয়া। ছোট আলামত অনেক। সেগুলোর সবিশেষ কোন ক্রমধারা নেই। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত ও মৃত্যু, আমওয়াসের প্লেগরোগ, ফিতনার উত্থান, আমানতদারিতা হারিয়ে যাওয়া, ইলম তুলে নেয়া ও অজ্ঞতার উত্থান, সুদ-ব্যভিচার-বাদ্যযন্ত্র-মদের বিস্তার এবং এগুলোকে হালাল জানা, ভবনের দীর্ঘতা নিয়ে প্রতিযোগিতা, খুন বেড়ে যাওয়া, সময় দ্রুত অতিবাহিত হওয়া, মসজিদের কারুকাজ, শির্কের আধিপত্য, লাম্পট্যের বিস্তার, কৃপণতার বৃদ্ধি, ব্যাপক হারে ভূমিকম্প হওয়া, ভূমিধ্বস, মানব-রূপান্তর ও আকাশ থেকে পাথর পড়া, সৎলোকদের প্রস্থান, মুমিনের স্বপ্ন সত্য হওয়া, সুন্নতের ব্যাপারে অবহেলা, মিথ্যার ব্যাপকতা, মিথ্যা-সাক্ষ্যদান বেড়ে যাওয়া, আকস্মিক মৃত্যু বেড়ে যাওয়া, অধিক বৃষ্টিপাত ও কম উদ্ভিদ গজানো, মৃত্যুকামনা করা, রোমানরা বেড়ে যাওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধ হওয়া ইত্যাদি আরও যা কিছু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হাদিসসমূহে উদ্ধৃত হয়েছে।
২। মাহদীর আবির্ভাব হওয়া। দাজ্জাল বের হওয়ার আগে ও ঈসা বিন মারিয়াম আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হওয়ার আগে মাহদীর আবির্ভাব ঘটবে। এর সপক্ষে প্রমাণ বহন করে জাবের (রাঃ) এর হাদিস। তিনি বলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: অবশেষে ঈসা বিন মারিয়াম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবতরণ করবেন। তখন তাদের (ঐ দলের) আমীর আল-মাহদী বলবেন: আসুন আমাদের নামাযের ইমামতি করুন। কিন্তু তিনি বলবেন: না; যেহেতু এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত সম্মান হচ্ছে: আপনারা একজন অন্যজনের উপর নেতা।”[হাদিসটি আল-হারিছ ইবনে আবু উসামা তার মুসনাদ গ্রন্থে সংকলন করেছেন] ইবনুল কাইয়্যেম তাঁর ‘আল-মানারুল মুনীফ’ গ্রন্থে (১/১৪৭) বলেন: এর সনদ জাইয়্যেদ। এ হাদিসটির মূল ভাষ্য সহিহ মুসলিমে রয়েছে। তবে সেখানে আমীরের কথাটি উল্লেখ না করে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে: অবশেষে ঈসা বিন মারিয়াম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবতরণ করবেন। তখন তাদের (ঐ দলের) আমীর বলবেন: আসুন আমাদের নামাযের ইমামতি করুন। কিন্তু তিনি বলবেন: না; যেহেতু এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত সম্মান হচ্ছে: আপনারা একজন অন্যজনের উপর নেতা।”[সহিহ মুসলিম (২২৫)] অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম মাহদীর পেছনে নামায পড়বেন; যা প্রমাণ করে যে, মাহদীর আবির্ভাব ঈসা আলাইহিস সালামের আগে ঘটবে। ঈসা আলাইহিস সালাম দাজ্জালকে হত্যা করবেন; যা প্রমাণ করে যে, মাহদীর যামানায় দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ ঘটবে।
৩। দাজ্জালের আত্মপ্রকাশ।
৪। ঈসা বিন মারিয়াম আলাইহিস সালামের অবতরণ ও তিনি দাজ্জালকে হত্যা করা।
৫। ইয়াজুজ-মাজুজের বহিঃপ্রকাশ। ইয়াজুজ-মাজুজ যে, ঈসা আলাইহিস সালামের যামানায় বের হবে এর সপক্ষে প্রমাণ বহন করে নাওআস বিন সামআন (রাঃ)-এর হাদিস। যাতে রয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে দাজ্জাল সম্পর্কে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন তাতে তিনি বলেন: সে (দাজ্জাল) ঐ অবস্থায় থাকাকালে আল্লাহ্ ঈসার প্রতি প্রত্যাদেশ করবেন যে, আমি আমার এমন কিছু বান্দার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি যাদের সাথে লড়াই করার কেউ নেই। সুতরাং আমার বান্দাদেরকে নিরাপদে তুর (পাহাড়)-এ একত্রিত করুন। তথা আল্লাহ্ ইয়াজুজ-মাজুজকে পাঠাবেন এবং তারা প্রত্যেক উচ্চভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে। তাদের প্রথম দল তাবারীয়া লেক পার হবে এবং সেই লেকে যা আছে সব তারা পান করে ফেলবে। আর তাদের সর্বশেষ দল যখন পার হবে তখন বলবে এখানে এক সময় পানি ছিল।
এরপর কিয়ামতের আলামতগুলো পর্যায়ক্রমে দ্রুত আসতে থাকবে। আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর হাদিসে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আলামতগুলো একটির পেছনে অন্যটি পরপর আসতে থাকবে; যেভাবে পুঁতি সুতা থেকে পড়তে থাকে”।[তাবারানীর ‘আল-মুজাম আল-আওসাত, আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
এরপর পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদিত হবে, জন্তু বের হবে, ভূমিধ্বস ঘটবে এবং অন্য বড় আলামতগুলো প্রকাশ পাবে।
আমরা মৃত্যু অবধি অবিচল থাকার জন্য আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছি। তিনিই সর্বজ্ঞ।
আরও বেশি জানতে পড়ুন: ড. আব্দুল আলীম আল-বাসতাওয়ির ‘আল-মাহদিয়্যুল মুনতাযার’ (১/৩৫৬) এবং ইউসুফ আল-ওয়াবেলের ‘আশারাতুস সাআহ’ (পৃষ্ঠা-২৪৯) ।
সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব