প্রশ্ন:
আমি শুনেছি যে, কিয়ামতের আগে মুমিন থাকবে না, আল্লাহ্র নাম স্মরণ করা হবে না। এটি কি কিয়ামতের একেবারে অব্যবহিত পূর্বে; নাকি দাজ্জালের আত্মপ্রকাশের পূর্ববর্তী সময়কালে? এই ইস্যুটির কারণে আমি পেরেশানিতে আছি। কেননা আমি জানি যে, কিয়ামতের পূর্বে মুমিনদের পারসেন্টিজ বেড়ে যাবে এবং পুনরায় আল্লাহর শরিয়ত বাস্তবায়ন করা হবে? সুতরাং তা কিভাবে?
উত্তর: আলহামদু লিল্লাহ।.
সহিহ সুন্নাহ প্রমাণ করে যে, কিয়ামত সৃষ্টিকুলের সর্বনিকৃষ্ট মানুষগুলোর উপর সংঘটিত হবে। যখন পৃথিবীতে ‘আল্লাহ্’ বলা হবে না। এটি দুনিয়ার আয়ুর শেষ দিকে, দাজ্জালের আবির্ভাব, ঈসা আলাইহিস সালামের হাতে সে নিহত হওয়া, ইসলাম ও মুসলমানদের বিজয় লাভ এবং গোটা পৃথিবীতে শরিয়া বাস্তবায়নের পরবর্তী সময়কালে। সহিহ বুখারী (২২২২) ও সহিহ মুসলিমে (১৫৫) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ঐ সত্তার শপথ যার হাতে রয়েছে আমার প্রাণ! অচিরেই ন্যায় পরায়ণ শাসক হিসেবে ঈসা বিন মারিয়াম আপনাদের মাঝে অবতীর্ণ হবেন। তিনি ক্রশকে ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকরকে হত্যা করবেন, জিযিয়াকে প্রত্যাহার করবেন এবং সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে, গ্রহণ করার জন্য কেউ থাকবে না”।
সহিহ মুসলিমের অপর বর্ণনাতে এসেছে: “আল্লাহ্র শপথ! অবশ্যই ইবনে মারিয়াম ন্যায়পরায়ন বিচারক হিসেবে অবতীর্ণ হবেন। অবশ্যই তিনি ক্রশকে ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকরকে হত্যা করবেন, জিযিয়াকে প্রত্যাহার করবেন। প্রাপ্ত-বয়স্কা উটনীকে ছেড়ে রাখা হবে; এর প্রতি কারো আগ্রহ থা কবে না। পরাস্পারিক বিদ্বেষ, শত্রুতা ও হিংসা দূরীভূত হয়ে যাবে। মানুষকে সম্পদ নিতে ডাকা হবে; কিন্তু কেউ সম্পদ গ্রহণ করবে না।”
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: “হাদিসটির মর্ম হলো: অধিক সম্পদ, আশাহীনতা ও প্রয়োজন না-থাকা এবং কিয়ামত নিকটবর্তী জানার কারণে উটনী রাখার প্রতি আগ্রহ থাকবে না। হাদিসে উটনীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে যেহেতু আরবদের কাছে উটনী হচ্ছে সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ। এই হাদিসটি আল্লাহ্ তাআলার বাণী: “যখন দশ মাসের গর্ভবতী উষ্ট্রীগুলোকে উপেক্ষা করা হবে”।[সূরা তাকবীর, আয়াত: ৪] এর মর্মের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। হাদিসের ভাষ্য: “এর প্রতি কারো আগ্রহ থাকবে না” এর মানে হচ্ছে: উটনীর মালিকেরা উটনীর ব্যাপারে অবহেলা করবে, যত্ম নেবে না”।[সমাপ্ত]
এই সময়কালটি কল্যাণ, ঈমান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উত্থানের সময়। এরপর অপর একটি সময় আসবে যখন ঈমানদারদের সংখ্যা কমে যাবে। অবশেষে আল্লাহ্ তাআলা এমন একটি বায়ু পাঠাবেন যা সব ঈমানদারের রুহ কবজ করবে। ফলে খারাপ লোক ছাড়া আর কেউ জীবিত থাকবে না এবং যাদের উপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে।
ইমাম মুসলিম (১৪৮) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “পৃথিবীতে ‘আল্লাহ্’ ‘আল্লাহ’ ডাকা অবধি কিয়ামত সংঘটিত হবে না”।
ইমাম আহমাদ (৩৮৪৪) আব্দুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন: “সর্ব নিকৃষ্ট মানুষ হবে তারা যারা জীবিত থাকা অবস্থায় তাদের উপর উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং যারা কবরগুলোকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করবে”।[শুয়াইব আল-আরনাউত মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থের তাহকীক করতে গিয়ে হাদিসটিকে হাসান বলেছেন]
সময়ের এ ধাপগুলোর বিস্তারিত বিবরণ সহিহ মুসলিম কর্তৃক সংকলিত (২৯৪০) আব্দুল্লাহ্ বিন আমর (রাঃ) এর হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমার উম্মতের মধ্যে দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। সে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। তখন আল্লাহ্ ঈসা বিন মারিয়াম আলাইহিস সালামকে পাঠাবেন। যেন তিনি উরওয়া বিন মাসউদ। তিনি দাজ্জালকে তলব করবেন এবং হত্যা করবেন। এরপর সাত বছর মানুষ এভাবে কাটাবে যে, দুইজনের মধ্যে কোন শত্রুতা নেই। এরপর আল্লাহ্ শামের দিক থেকে শীতল বায়ু পাঠাবেন। এই বায়ু প্রত্যেক যার অন্তরে সরিষা পরিমাণ কল্যাণ বা ঈমান রয়েছে তার রুহকে কবজ করবে। এমনকি তোমাদের কেউ যদি পাহাড়ের কলিজার ভেতরে প্রবেশ করে সেখানে প্রবেশ করে তার রুহ কবজ করবে। তিনি বলেন: এরপর পাখির চপলতা ও হিংস্রজন্তুর স্বপ্নধারী নিকৃষ্ট মানুষেরা বেঁচে থাকবে; যারা ভাল কিছু জানে না এবং মন্দ কিছু থেকে বারণ করে না। এক পর্যায়ে শয়তান মানুষের আকৃতি ধরে বলবে: তোমরা কি আমার ডাকে সাড়া দিবে? তারা বলবে: তুমি আমাদেরকে কিসের নির্দেশ দাও? সে তাদেরকে মূর্তিপূজার নির্দেশ দিবে। এ অবস্থাতেও তারা পরিপূর্ণ জীবিকা পাবে এবং সুন্দর জীবনযাপন করবে। অতঃপর সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে।
ইমাম নববী তাঁর ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন: হাদিসের ভাষ্য: فِي كَبِد جَبَل (পাহাড়ের কলিজার ভেতরে) অর্থাৎ পাহাড়ের মধ্যখানে ও ভেতরে। হাদিসের ভাষ্য: فَيَبْقَى شِرَار النَّاس فِي خِفَّة الطَّيْر وَأَحْلَام السِّبَاع (এরপর পাখির চপলতা ও হিংস্রজন্তুর স্বপ্নধারী নিকৃষ্ট মানুষেরা বেঁচে থাকবে): আলেমেরা বলেন: এর মর্ম হলো: মন্দ কাজ, কামনাবাসনাকে পূরণ এবং অন্যায়ের দিকে তারা পাখির উড্ডয়নের মত দ্রুত ছুটে যাবে। আর একজন অপরের উপর অন্যায় ও জুলুম করার ক্ষেত্রে হিংস্রজন্তুর স্বভাবগত চরিত্রধারী হবে।
ইমাম মুসলিম (২৯৩৭) আন-নাওআস বিন সামআন (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: এক ভোরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের কথা আলোচনা করছিলেন…। এরপর তিনি ঈসা বিন মারিয়াম আল-মাসীহ আলাইহিস সালাম অবতরণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি দামেশকের পূর্বে অবস্থিত শুভ্র মিনারাতে তাঁর দুই হাত দুই ফেরেশতার ডানাতে রেখে অবতরণ করবেন। অতঃপর তিনি তাকে (মসীহ দাজ্জালকে) তালাশ করবেন। এক পর্যায়ে তাকে বাবে লুদ্ধ-এ পাবেন এবং তাকে হত্যা করবেন…। এরপর তিনি ইয়াজুজ-মাজুজের বহিঃপ্রকাশ ও তারা ধ্বংস হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এরপর পৃথিবীকে বলা হবে: তুমি তোমার ফল ফলাও এবং বরকত ফিরিয়ে দাও…। ইতোমধ্যে আল্লাহ্ উত্তম একটি বায়ু পাঠাবেন; যে বায়ু তাদেরকে বগলের নীচ থেকে আক্রান্ত করবে এবং প্রত্যেক মুমিন ও মুসলিমের রূহ কবজ করবে। অতঃপর নিকৃষ্ট মানুষ ছাড়া আরও কেউ বেঁচে থাকবে না। তারা গাধার মত জনসম্মুখে নারীদের সাথে সহবাস করবে। এ সকল ব্যক্তিদের উপরই কিয়ামত সংঘটিত হবে।
আমরা আল্লাহ্র কাছে আমাদের জন্য ও আপনার জন্য তাঁর ইবাদত করতে পারা ও সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাওফিক প্রাপ্তির দোয়া করছি।
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব