যদি নবীগণ কামেল আখলাকের অধিকারী হন ও মাসুম (নিষ্পাপ) হন তাহলে মূসা আলাইহিস সালাম এর জিহ্বাতে জড়তা থাকে কিভাবে এবং তিনি কোন অপরাধ ছাড়া একজন মানুষকে কিভাবে হ*ত্যা করেন?
প্রশ্ন:
আমি ইসমতে আম্বিয়া (নবীগণের নিষ্পাপ হওয়া) সম্পর্কে পড়েছি যে, তাঁরা শারীরিক গঠনগত ত্রুটি ও চারিত্রিক ত্রুটি হতে মুক্ত। যদি তাই হয় তাহলে আমাদের নেতা মূসা আলাইহিস সালাম ভালভাবে কথা বলতে না পারার ব্যাপারে কী বলা যেতে পারে? এবং তিনি কিভাবে বিনা অপরাধে একজন মানুষকে হত্যা করলেন? এটি কি ইসমতে আম্বিয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
উত্তর : আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
আল্লাহ্ তাআলা সকল নবীগণকে সম্মানিত করেছেন, রিসালাত-এর দায়িত্ব পালন বহন করার ও পৌঁছে দেয়ার যোগ্য বানিয়েছেন। তাই তিনি তাঁদের শারীরিক গঠন ও চরিত্রকে পরিপূর্ণ করেছেন। তাঁদেরকে তাঁর প্রচারের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং তাঁদেরকেই তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব দিয়েছেন; অন্যদেরকে নয়। ইরশাদ হয়েছে: “তাঁর রিসালাত (রসূলের দায়িত্ব) কোথায় দেবেন তা তিনিই ভাল জানেন”।[সূরা আনআম, আয়াত: ১২৪]
এ কারণে বনী ইসরাইলরা যখন কালিমুল্লাহ্ মূসা আলাইহিস সালামকে কষ্ট দিচ্ছিল এবং তাঁকে শারীরিক ত্রুটির অপবাদ দিচ্ছিল তখন তিনি তাঁকে নিষ্কলুষ ঘোষণা করেন। কারণ ছিল তারা উলঙ্গ হয়ে গোসল করত এবং একে অপরের দিকে তাকাত। কিন্তু, মূসা আলাইহিস সালাম একাকী আড়ালে গোসল করতেন। তখন তারা বলল: “আল্লাহ্র কসম! মূসা আমাদের সাথে গোসল না করার কারণ হল সে একশিরাগ্রস্ত। একবার তিনি গোসল করতে গিয়ে একটি পাথরের উপর তাঁর কাপড় রাখলেন। পাথরটি কাপড় নিয়ে পালাতে লাগল। তিনি পাথরের পিছে পিছে দৌঁড়াচ্ছিলেন আর বলছিলেন: ওহে পাথর, আমার কাপড়। তখন বনী ইসরাইলরা মূসা আলাইহিস সালামের দিকে তাকাল এবং বলল: আল্লাহ্র শপথ! মূসার কোন সমস্যা নেই। তিনি তাঁর কাপড়টি উদ্ধার করে পাথরটিকে পিটাতে লাগলেন।”[সহিহ বুখারী (২৭৮) ও সহিহ মুসলিম (৩৩৯)]
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার বলেন: “এ হাদিসে দলিল রয়েছে যে, নবীগণ শারীরিক গঠন ও চারিত্রিক দিক দিয়ে পূর্ণতার শীর্ষে। যে ব্যক্তি কোন নবীর ব্যাপারে শারীরিক কোন অপূর্ণতার দোষ তোলে সে ঐ নবীকে কষ্ট দেয়। এমন দোষারোপকারী কাফের হয়ে যাওয়ার শংকা হয়।”[ফাতহুল বারী (৬/৪৩৮)]
একশিরা মানে: অণ্ডকোষদ্বয় বা দুইটির একটি বড় থাকা।
দুই:
মূসা আলাইহিস সালামের জিহ্বাতে যে জড়তা ছিল সেটা জন্মগত ছিল না। মশহুর হচ্ছে তিনি ছোট বেলায় আগুনের অঙ্গার মুখে দেয়ার কারণে এ সমস্যা হয়েছিল; যেমনটি কোন কোন তাফসিরকারক উল্লেখ করেছেন।
পরবর্তীকালে কোন সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া অন্যদের ক্ষেত্রে যেমন ঘটতে পারে নবীদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। নবীরাও কষ্ট পেতে পারেন, আঘাত পেতে পারেন। যার ফলে তাঁদের শারীরিক ত্রুটি ঘটতে পারে। যেমনটি উহুদ যুদ্ধের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল।
এ ত্রুটি যখন রিসালাতের দায়িত্ব পালনকে প্রভাবিত করার পর্যায়ে ছিল তখন মূসা আলাইহিস সালাম এ সমস্যা নিরসনের জন্য দোয়া করেছেন।
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي* وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي* وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّن لِّسَانِي* يَفْقَهُوا قَوْلِي
(অনুবাদ: মূসা বলল: হে আমার রব, আমার বক্ষ আমার জন্য খুলে দাও (আমার মনে সাহস যোগাও)। আমার কাজ আমার জন্য সহজ করে দাও। আর জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দাও। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।)[সূরা ত্বাহা, আয়াত: ২৫-২৮] আল্লাহ্ তাআলা মূসা আলাইহিস সালামের দোয়া কবুল করলেন। قَالَ قَدْ أُوتِيتَ سُؤْلَكَ يَا مُوسَى (অনুবাদ: আল্লাহ্ বললেন, মূসা! তুমি যা চেয়েছো তোমাকে তা দেওয়া হল।)[সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৩৬]
ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহ্র তাআলার বাণী:
أَمْ أَنَا خَيْرٌ مِنْ هَذَا الَّذِي هُوَ مَهِينٌ وَلَا يَكَادُ يُبِينُ
(অর্থ- এই হীন লোকটি (মূসা) থেকে কি আমি শ্রেষ্ঠ নই? সে তো স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারে না।”[সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৫২] এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন:
“সে তো স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারে না”: এটিও একটি মিথ্যা অপবাদ। কারণ যদিও ছোট বেলায় আগুনের অঙ্গার থেকে তাঁর জিহ্বা আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু তিনি আল্লাহ্র কাছে দোয়া করেছেন যাতে করে তিনি তাঁর জিহ্বার জড়তা দূর করে দেন যেন তারা তাঁর কথা বুঝতে পারে। আল্লাহ্ তাঁর সে দোয়া কবুল করেছেন। “আল্লাহ্ বললেন, মূসা! তুমি যা চেয়েছো তোমাকে তা দেওয়া হল”[সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৩৬][তাফসিরে ইবনে কাছির (৭/২৩২)]
এর থেকে পরিস্কার হয়ে গেল যে, মূসা আলাইহিস সালাম যে সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছিলেন যথাযথ ও স্পষ্টভাবে রিসালাতের দায়িত্ব পালনে সেটা কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি এবং সেটি মূসা আলাইহিস সালামের জন্য এমন কোন দোষ বা ত্রুটি ছিল না যেটা মানুষকে তাঁর থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করবে কিংবা তিনি সমালোচনার পাত্র হবেন; মিথ্যাচার ও অপবাদ আরোপ করা ছাড়া; যেমনটি করেছে অভিশপ্ত ফেরাউন।
তিন:
নবীগণ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁরা সৃষ্টিকুলের মাঝে আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আল্লাহ্ তাআলা তাঁদেরকে কবিরা গুনাহ থেকে মুক্ত করেছেন। তাই তাঁরা কখনও কবিরা গুনাহ করেন না। তাঁরা কবিরা গুনাহ থেকে মাসুম বা মুক্ত; সেটা নবুয়তপ্রাপ্তির আগে হোক কিংবা পরে।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) মাজমুউল ফাতাওয়া গ্রন্থে (৪/৩১৯) বলেন:
“নবীগণ কবিরা গুনাহ থেকে মাসুম (নিষ্পাপ); সগিরা গুনাহ থেকে নয়- এটি অধিকাংশ আলেম ও অধিকাংশ দলগুলোর অভিমত…। এটি অধিকাংশ তাফসিরবিদ, হাদিসবিদ, ফিকাহবিদেরও অভিমত। বরং সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী, সলফে সালেহিন ও ইমামদের কাছ থেকে যে সব বক্তব্য এসেছে সেগুলো এ অভিমতের অনুকূলে।”[সমাপ্ত]
আর সগিরা গুনাহ তাঁদের কাছ থেকে কিংবা তাঁদের কারো কারো কাছ থেকে সংঘটিত হতে পারে। এ কারণে অধিকাংশ আলেমের অভিমত হল: তাঁরা সগিরা গুনাহ থেকে মাসুম নন। যদি এমন কোন সগিরা গুনাহ তাঁদের দ্বারা ঘটে যায় তাহলে তাতে সম্মতি দেওয়া হয় না; বরং আল্লাহ্ তাঁদেরকে সতর্ক করে দেন এবং অবিলম্বে তাঁরা সেগুলো থেকে তওবা করে ফিরে আসেন।
এ ধরণের গুনাহ হচ্ছে মূসা আলাইহিস সালাম কর্তৃক মিশরি কিবতি লোকটিকে হত্যা করা। কারণ বিনা অপরাধে লোকটিকে হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যা মূসা আলাইহিস সালাম ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি। বরং ভুলক্রমে ঘটেছে। যে কারণে তিনি এতে প্ররোচিত হয়েছিলেন সেটা হচ্ছে- মজলুম লোকটিকে সাহায্য করা। কারণ মিশরি কিবতিরা বনী ইসরাঈলদেরকে দাস বানাত এবং তাদের উপর অবিচার করত।
ইমাম কুরতুবী বলেন: “তিনি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন; কেননা মজলুমকে সাহায্য করা সকল উম্মতের কাছে দ্বীনি কাজ ও সকল শরিয়তে ফরয। কাতাদা বলেন: কিবতি লোকটি চাচ্ছিল প্রভাব খাটিয়ে ইসরাঈলি লোকটিকে দিয়ে ফেরাউনের রান্নাঘরের জন্য কাঠ বহন করাতে। ইসরাঈলি লোকটি অস্বীকার করল এবং তাকে সাহায্য করার জন্য মূসাকে ডাকল।”
অনুরূপভাবে
قالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ
(অর্থ: সে বলল: হে আমার রব, আমি আমার নিজের প্রতি অন্যায় করে ফেলেছি। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তখন তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন।) এর ব্যাখ্যায় কুরতুবী বলেন: মূসা আলাইহিস সালাম যে ঘুষিটি মেরেছিলেন সেটার জন্য তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন; যে ঘুষির কারণে লোকটির প্রাণ অবসান হয়। এ অনুতপ্ততা তাঁকে তাঁর রবের প্রতি বিনয়াবনত হওয়া ও ক্ষমাপ্রার্থনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে…।
তাঁর এ হত্যাটি ছিল ভুলক্রমে। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘুষি বা লাথি মারলে মানুষ মরে না।
সালিম বিন আব্দুল্লাহ থেকে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, তিনি বলেন: ওহে ইরাকবাসী! সগিরা গুনাহ সম্পর্কে তোমাদের অধিক প্রশ্ন, আর কবিরা গুনাহতে লিপ্ত হওয়া বড়ই বিস্ময়কর! আমি আবু আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমরকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: ফিতনা এদিক থেকে আসবে। তিনি হাত দিয়ে পূর্বদিকে ইশারা করেছেন, যেদিক থেকে শয়তানের শিং উদিত হয়। তোমরা একে অপরের গর্দান কর্তন করতেছ। অথচ ফেরআউনের গোষ্ঠীর যে লোকটিকে মূসা আলাইহিস সালাম ভুলক্রমে হত্যা করেছিলেন সে প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেন:
وَقَتَلْتَ نَفْساً فَنَجَّيْناكَ مِنَ الْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُوناً
(অর্থ- তুমি একজনকে হত্যা করে বসলে। তারপর আমি তোমাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম এবং আমি তোমাকে বড় রকম পরীক্ষায় ফেলেছিলাম।)[তাফসিরে কুরতুবী (১৩/২৬১) থেকে সংক্ষেপে সমাপ্ত]
কুস্তালানি বলেন:
এটি তাঁর ইসমতকে (নিষ্পাপ হওয়াকে) প্রশ্নবিদ্ধ করবে না। কারণ সেটা ভুল ছিল। আয়াতে কারীমাতে সেটাকে শয়তানের কাজ বলা হয়েছে, অন্যায় বলা হয়েছে। অবহেলাবশতঃ কোন ছোট গুনাহ হয়ে গেলে তাঁদের (নবীদের) অভ্যাস অনুযায়ী সেটাকে বড় জ্ঞান করে তিনি সেটা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।[ইরশাদুস সারি (৭/২০৬)]
বরং এর উপরে আমরা যে কথাটি বলতে চাই: নিশ্চয় এ মিশরি কিবতিকে হত্যা করাটা (হত্যা করার কারণ থাকা সত্ত্বেও) ছিল অনিচ্ছাকৃত ভুল। কিন্তু এটি মূসা আলাইহিস সালামের নবুয়তের আগে সংঘটিত হয়েছে। আর নবীগণ নবুয়তপ্রাপ্তির আগে ভুল করা থেকে মাসুম বা মুক্ত নন। বিশেষত তাঁদের অভিপ্রায় যদি ভাল হয় এবং কার্যকারণ থাকে।
ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন:
“আমি এমন কিছু জানি না যে, বনী ইসরাঈল কোন নবীকে কোন কাজ থেকে তওবা করার কারণে সমালোচনা করেছে। বরং তারা মিথ্যাচার করে তাঁদের উপর দোষারোপ করত; যেমনিভাবে তারা মূসা আলাইহিস সালামকে কষ্ট দিয়েছিল। নচেৎ মূসা আলাইহিস সালাম মিশরি কিবতি লোকটিকে হত্যা করেছেন নবুয়তপ্রাপ্তির আগে। এবং তিনি আল্লাহ্কে দেখতে চাওয়া থেকে ও অন্যান্য ভুল থেকে নবুয়তপ্রাপ্তির পর ক্ষমা চেয়েছেন। আমি জানি না যে, বনী ইসরাঈলের কেউ এ ধরণের কোন কিছুর জন্য মূসা আলাইহিস সালামের উপর দোষারোপ করেছেন।[মিনহাজুস সুন্নাহ আন-নাবাওয়্যিয়াহ (২/৪০৯)]
আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব