ইসলামে চিন্তাভাবনা
প্রশ্ন
উত্তর
আলহামদু লিল্লাহ।.
এক:
একজন মুসলিমের উপর ওয়াজিব নিজের ঈমান ও আকিদা সংরক্ষণ করা। নিজের সৃষ্টিগত প্রবৃত্তি ও চিন্তাচেতনার নিরাপত্তার উপর গুরুত্বারোপ করা। নিজের দ্বীনদারি ও অন্তর নিয়ে সংশয় ও ফিতনাগুলো থেকে পলায়ন করে। কারণ অন্তরগুলো দুর্বল। আর সংশয়গুলো ছিনতাইকারী। সামান্য চাকচিক্য দিয়ে অন্তরগুলোকে ছিনতাই করা হয়। বিদাতপন্থী ও পথভ্রষ্টরা সংশয়গুলোকে চাকচিক্য দিয়ে সুশোভিত করেন। অথচ আসলে সেগুলো ভিত্তিহীন ও দুর্বল সংশয়।
বিদাতী ও পথভ্রষ্টদের গ্রন্থগুলো পড়া কিংবা শিরকি ও কুসংস্কারপূর্ণ বইগুলো দেখা কিংবা অন্যান্য বিকৃত ধর্মগ্রন্থগুলোতে নযর দেয়া কিংবা নাস্তিক ও মুনাফিকদের গ্রন্থ বা তাদের ইসলাম বিরোধী চিন্তাধারা ও বাতিল সংশয়গুলো প্রচারকারী ওয়েবসাইটগুলোতে দৃষ্টি দেয়া জায়েয নয়। কেবল ঐ ব্যক্তির জন্য জায়েয হতে পারে, যার শরয়ি জ্ঞান আছে এবং তিনি এগুলো অধ্যয়নের মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে জবাব দিতে চান ও তাদের বিভ্রান্তিগুলো তুলে ধরতে চান এবং তার সেই সক্ষমতা ও পূর্ণ যোগ্যতা আছে। পক্ষান্তরে, যার কাছে শরিয়তের ইলম নাই সে যদি এগুলো পড়ে তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাকে পেরেশানি পেয়ে বসবে, অন্তরের একীন দুর্বল হয়ে যাবে এবং অন্তর যে সংশয়গুলোর মুখোমুখি হবে সেগুলো অন্তরকে কাঁপিয়ে তুলবে।
অনেক সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। বরং অনেক তালিবুল ইলমদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে যারা এই বিষয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাদের তাদের কেউ কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। নাউযুবিল্লাহ।
এ ধরণের কিতাবগুলো যারা পড়েন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ভেবে প্রবঞ্চিত হন যে, তার অন্তর আলোকপাত করা সংশয়গুলোর চেয়ে অধিক শক্তিশালী। হঠাৎ করে সে আবিষ্কার করে যে, ব্যাপক পড়তে পড়তে তার অন্তর এসব সংশয় এমনভাবে পান করেছে যা সে চিন্তাও করেনি। এ কারণে আলেম-উলামা ও সলফে সালেহীনের বক্তব্য হচ্ছে এ সকল গ্রন্থ পড়া ও অধ্যয়ন করা হারাম।
দুই:
ইসলামকে এর নিজস্ব উৎস থেকে জানতে হবে। ইসলামের মহান ও প্রধান উৎস: কুরআন-সুন্নাহ্। ইসলাম বিবেক ও চিন্তাভাবনাকে মর্যাদা দিয়েছে। অনেক আয়াতে এ মর্যাদা ফুটে উঠেছে। কিছু কিছু বাক্য কুরআনে দশ দশবার পুনঃপুনঃ উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন— لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (যাতে তোমরা বুঝতে পার), لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ (চিন্তাশীল লোকদের জন্য),لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ (বুঝমান লোকদের জন্য)।
আল্লাহ্তাআলা কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করার দিকে আহ্বান করেছেন; তিনি বলেন: “এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার কাছে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ গভীরভাবে চিন্তা করে এবং বুদ্ধিমানেরা উপদেশ গ্রহণ করে।”[সূরা ছাদ, ৩৮:২৯]
তিনি তাঁর মাখলুক নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আহ্বান জানিয়ে বলেন: “তারা কি নিজেদের সম্পর্কে ভেবে দেখে না? আল্লাহ্তো আসমান ও জমিন এবং এর মধ্যবর্তী সবকিছু যথার্থভাবে ও একটি নির্দিষ্ট সময়ের তরে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অনেক মানুষই (মৃত্যুর পর) তাদের প্রভুর সাথে সাক্ষাতকে অস্বীকার করে।”[সূরা আর-রূম, ৩০:৮]
বরং জাহান্নামীরা তাদের বিবেক-বুদ্ধি থেকে উপকৃত না হওয়ায় আল্লাহ্তাদের নিন্দা করেছেন। তিনি তাদের সম্পর্কে বর্ণনা করেন: “তারা বলবে, ‘আমরা যদি শুনতাম কিংবা বুঝতাম, তাহলে জাহান্নামের অধিবাসী হতাম না।'”[সূরা মুলক, ৬৭:১০] তিনি আরও বলেন: “তারা কি জমিনে ভ্রমণ করেনি? করলে তাদের অন্তরগুলো এমন হত যা দ্বারা বুঝতে পারত; অথবা কানগুলো এমন হত যা দিয়ে তারা শুনতে পেত। কেননা, চোখ তো (আসলে) অন্ধ হয় না, বরং বুকের ভিতরের অন্তরই (প্রকৃত) অন্ধ হয়ে থাকে।”[সূরা আল-হাজ্জ, ২২:৪৬]
চিন্তাভাবনা একটি ইবাদত; এ আয়াতে আল্লাহ্তাআলা সেটা অবগত করে বলেন: “আসমান-জমিনের সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে অবশ্যই বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে; যারা দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায় ও শোয়া অবস্থায় আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে আর বলে, ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। আমরা আপনার মহিমা বর্ণনা করি। অতএব আপনি আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করুন।”[সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৯০-১৯১]
শাইখ সা’দী বলেন: আল্লাহ্তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি বান্দাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন— এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করার প্রতি, এগুলোর নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করার প্রতি এবং এগুলোর সৃষ্টি নিয়ে ভাবার প্রতি। আয়াতে “নিদর্শন” শব্দকে অনির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। “অমুক বিষয়” এভাবে বলা হয়নি— নিদর্শনাবলীর ব্যাপকতা ও সার্বিকতার দিকে ইঙ্গিত করার উদ্দেশ্য থেকে। কেননা এগুলোর মধ্যে এমন বিস্ময়কর কিছু নিদর্শন আছে যা দর্শনার্থীকে অভিভূত করে, চিন্তাশীলকে সন্তুষ্ট করে, সত্যবাদীদের অন্তরকে কাছে টেনে আনে, আলোকিত বিবেকগুলোকে ইলাহি বিষয়াবলীর প্রতি জাগিয়ে তোলে। আর এগুলোর মধ্যে যে নিদর্শনাবলী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেগুলোর খুঁটিনাটি পুরোপুরিভাবে জানা কোন মাখলুকের পক্ষে সম্ভবপর নয়।
মোট কথা: এগুলোর মধ্যে সন্নিবেশিত মহত্ব, বিশালতা, গমন ও গতির যে শৃংখলা রয়েছে: সবকিছু মহান স্রষ্টার মহত্ব, তাঁর রাজত্বের বিশালত্ব ও ক্ষমতার প্রশস্ততার প্রমাণ বহন করে।
এগুলোর মধ্যে যে নিপুণতা ও দৃঢ়তা রয়েছে, সৃষ্টিকর্মের নতুনত্ব রয়েছে, কর্মের সূক্ষ্মতা রয়েছে সেসব কিছু প্রমাণ করে— আল্লাহ্প্রজ্ঞাময়, তিনি প্রতিটি জিনিসকে সস্থানে রাখেন এবং তাঁর জ্ঞান বিস্তৃত।
এগুলোর মধ্যে সৃষ্টিকুলের জন্য যে উপকার রয়েছে সেটি আল্লাহ্র রহমতের বিশালতা, তাঁর অনুগ্রহের ব্যাপকতা, তাঁর কল্যাণের ব্যাপ্তি ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার আবশ্যকতা প্রমাণ করে।
এ সবকিছু প্রমাণ করে যে, বান্দার অন্তর তার স্রষ্টার সাথে ও বিধাতার সাথে সম্পৃক্ত থাকা, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা এবং তাঁর সাথে এমন কিছুকে শরীক না করা; যেগুলো নিজের জন্য কিংবা অন্যের জন্য বিন্দুমাত্র কিছু করার সক্ষমতা নাই। এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ্তাআলা বুদ্ধিমানদেরকে খাস বলেছেন। যারা হচ্ছেন বিবেকওয়ালা। কেননা এরাই এর দ্বারা উপকৃত, এরা বিবেকের দ্রষ্টা, চোখ দিয়ে নয়।
এরপর আল্লাহ্ বুদ্ধিমানদের বৈশিষ্ট উল্লেখ করেন যে, তারা দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া সর্বাবস্থায় আল্লাহ্কে স্মরণ করে। এটি মুখের যিকির, অন্তরের যিকির সব ধরণের যিকিরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নামায পড়াও অন্তর্ভুক্ত হবে; দাঁড়াতে না পারলে বসে পড়া, বসতে না পারলে শুয়ে পড়া। এবং তারা আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে যাতে করে এর দ্বারা তারা এগুলোর উদ্দেশ্যের পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে পারে।
এতে করে প্রমাণিত হয় যে— চিন্তাভাবনা করা এমন ইবাদত যা আল্লাহ্কে যারা চেনে আল্লাহ্র এমন বন্ধুদের গুণাবলী। যখন তারা এগুলো নিয়ে চিন্তা করে তখন তারা জানতে পারে যে, আল্লাহ্এগুলোকে নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। তখনি তারা বলে উঠে: “হে আমাদের প্রভু, আপনি এটাকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। যা কিছু আপনার মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীল নয় আপনি সেসব থেকে পবিত্র। বরং আপনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন সত্য সহকারে, সত্যের জন্য এবং সত্যকে অন্তর্ভুক্ত করে। অতএব, আমাদেরকে আপনি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান, গুনাহ থেকে বাঁচানোর মাধ্যমে। আমাদেরকে নেক আমলের তাওফিক দিন যাতে করে আমরা আগুন থেকে নাজাত পাই।[তাফসিরে সা’দী (১৬১) থেকে সমাপ্ত]
হাদিসে এসেছে:
আতা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি ও উবাইদ বিন উমাইর (রহঃ) আয়েশা (রাঃ)-র কাছে গেলাম। তখন আয়েশা (রাঃ) উবাইদ বিন উমাইর (রহঃ) কে বললেন: এই বুঝি তুমি আমাদেরকে দেখতে আসার সময় হল? সে বলল: আম্মাজান, পূর্ববর্তী কেউ বলেছেন: ‘বিরতি দিয়ে সাক্ষাত কর এতে ভালবাসা বাড়বে।’ আতা বলেন: তখন তিনি বললেন: রাখ তোমাদের এসব কথা। উবাইদ বিন উমাইর (রহঃ) বললেন: আপনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে সবচেয়ে বড় আশ্চর্যময় কী ঘটনা দেখেছেন, তা আমাদেরকে বলুন। তিনি ক্ষণকাল নীরব থেকে বললেন, এক রাত্রে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, আয়েশা! আজ রাতে আমাকে আমার প্রতিপালকের ইবাদতের জন্য ছেড়ে দাও। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! আমি আপনার নিকটে থাকতে পছন্দ করি এবং যা আপনাকে খুশি করে সেটাও পছন্দ করি। তখন তিনি উঠে পবিত্রতা অর্জন করলেন এবং নামায পড়তে শুরু করলেন। নামাযে তিনি কাঁদতে থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কোল ভিজে গেল। তারপরও কাঁদতে থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর দাঁড়ি ভিজে গেল। এরপরও কাঁদতে থাকলেন। কাঁদতে কাঁদতে মাটি ভিজে গেল! (ফজরের আগে) বিলাল তাঁকে নামাযের খবর দিতে এলেন। সে যখন তাঁকে কাঁদতে দেখলেন, তখন বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাঁদছেন কেন? আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিয়েছেন! তিনি বললেন: আমি কি (আল্লাহর) শোকরগুযার বান্দা হব না? আজ রাত্রে আমার উপর একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। ধ্বংস তার জন্য, যে সেটি পড়েছে, কিন্তু তা নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করেনি:
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ
“আসমান-জমিনের সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের আবর্তনে অবশ্যই বুদ্ধিমান লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে…; [সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০][সহিহ ইবনে হিব্বান (২/২৮৬), দেখুন: আস-সিলসিলা আস-সাহিহা (১/১৪৭)]
বড় চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাদের এ বিষয়ে একটি বই আছে শিরোনাম হল: التفكير فريضة إسلامية (চিন্তাভাবনা ইসলামে ফরয)। বইটি পড়া যেতে পারে।