১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুরের অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের এবং মায়ের নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুন্নেসা ও হুমায়রা। বড় দুই ভাইয়ের নাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দুই ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। তবে তাঁর বাবা নিজে শিক্ষিত হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে বাবার এরূপ আচরণ বেগম রোকেয়াকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর বড় দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করার সুবাদে ভাইদের সহায়তায় তিনি বাড়িতে পড়াশোনার সুযোগ লাভ করেন।
১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে বেগম রোকেয়া বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ। স্বামীর সাহচর্যে এসে বেগম রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। ৩ মে ১৯০৯ স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে বেগম রোকেয়া সীমাহীন নৈঃসঙ্গ্যে পতিত হন।
সাহিত্যচর্চা
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহিত্যচর্চা শুরু হয় তাঁর স্বামীর হাত ধরেই। কেউ কেউ বলেন, তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে ‘নবনূর’ পত্রিকায়। আবার অনেকের মতে, তাঁর প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৯০২ সালে “নবপ্রভা’ পত্রিকায়।
বেগম রোকেয়ার প্রথম ইংরেজি রচনা ‘Sultana’s Dream’, যার অনূদিত বাংলা রূপ ‘সুলতানার স্বপ্ন’। যা ১৯০৫ সালে মাদ্রাজের ‘দ্য ইন্ডিয়ান লেডিস’ ম্যাগাজিনে (The Indian Ladies’ Magazine) প্রকাশিত হয়। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ হলো: ‘মতিচূর’ (১৯০৪), ‘পদ্মরাগ’ (১৯২৪), ‘অবরোধবাসিনী’ (১৯৩১)। এ ছাড়া বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা তাঁর অসংখ্য চিঠিপত্র রয়েছে।
সমাজ সংস্কার ও কর্মোদ্যোগ
নিঃসঙ্গ রোকেয়া স্বামীর অনুপ্রেরণাকে বুকে ধারণ করে নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে তিনি তাঁর স্বামীর নামে ১৯০৯ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৯১০ সালে কলকাতায় আসেন এবং ১৯১১ সালে ‘সাখাওয়াত উর্দু প্রাইমারি স্কুল’ স্থাপন করেন।
১৯৩১ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গ উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বেগম রোকেয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারী সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
জীবনাবসান
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জীবনকাল ছিল মাত্র ৫২ বছর। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি উত্তর কলকাতার সোদপুরে শায়িত আছেন।
- বেগম রোকেয়া বিশেষভাবে পরিচিত নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী হিসেবে।
- বেগম রোকেয়ার পারিবারিক নাম ছিল রোকেয়া খাতুন।
- প্রথম দিকে তাঁর লেখক নাম ছিল মিসেস আর এস হোসেন।
- রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাতার নাম বাণী দত্ত।
- ‘পদ্মরাগ’ তাঁর একমাত্র উপন্যাস।
- রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্মরণে ২০০৮ সালে রংপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’। এটিই বাংলাদেশে কোনো নারীর নামে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
- প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়ার জন্মদিনে ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ পালিত হয় এবং নারী উন্নয়নে অবদানের জন্য বিশিষ্ট নারীদের বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।
- ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীনিবাসের নাম দেওয়া হয় ‘রোকেয়া হল’, যার আগের নাম ছিল ‘উইমেন্স হল’।
- ২০০৪ সালে বেগম রোকেয়া বিবিসি বাংলার “সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে ষষ্ঠ হয়েছিলেন।
- রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেসব পত্রিকায় লিখতেন: ‘নবনূর’, ‘সওগাত’, ‘মোহাম্মদী’, ‘নবপ্রভা’, ‘মহিলা’, ‘ভারতমহিলা’, ‘আল-এসলাম’, ‘নওরোজ’, ‘মাহে নও’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘The Mussalman, Indian Ladies’ Magazine প্রভৃতি।
- রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলাধীন পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার নিজ বাড়িসংলগ্ন ৩.১৫ একর ভূমিতে।
- তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ১ জুলাই ২০০১ সালে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপিত হয়।