বাংলা দোভাষী পুঁথি সাহিত্য

বিসিএস প্রস্তুতি বাংলা দোভাষী পুঁথি সাহিত্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো। আপনারা যারা বিসিএস প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন লেখাটি তাদের জন্য খুবই সহায়ক হবে। তো চলুন আজকের পর্বের আলোচনা দোভাষী পুঁথি দেখি।

দোভাষী পুঁথি

মধ্যযুগের শেষ ১০০ বছরে প্রচুর পরিমাণে দোভাষী পুঁথি রচিত হয়। আঠারো শতকজুড়ে মুসলমান কবিরা দোভাষী পুঁথি রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতার বটতলা নামের জায়গা থেকে সস্তা কাগজে এসব পুঁথি ছাপা হয়ে সারা দেশে প্রচারিত হতো বলে ‘বটতলার পুঁথি’ নামেও এগুলো পরিচিত। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত রেভারেন্ড জে লংয়ের পুস্তকতালিকায় এই শ্রেণির কাব্যকে ‘মুসলমানি বাংলা সাহিত্য’ এবং এর ভাষাকে ‘মুসলমানি বাংলা’ বলা হয়েছে।

ভাষা

দোভাষী পুঁথিগুলো মুসলমান কবিরা লিখতেন । ফলে এসব কাব্যে প্রচুর পরিমাণে আরবি-ফারসি- উর্দু- হিন্দি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। নামে দোভাষী হলেও এসব কাব্যের ভাষা দুটি নয়। বহু ভাষা ব্যবহারের কারণে এগুলোকে বহুভাষী পুঁথি বা মিশ্ৰ ভাষারীতির পুঁথিও বলা হয় ।

বিষয়

বিভিন্ন বিষয় অবলম্বন করে দোভাষী পুঁথি রচিত হয়েছে—

১. প্রণয়োপাখ্যান : বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও লোককাহিনিভিত্তিক প্রেমকাহিনি নিয়ে দোভাষী পুঁথি রচিত হয়েছে। যেমন ‘ইউসুফ-জোলেখা’, ‘সয়ফুলমুলক-বদিউজ্জামাল’, ‘লায়লী-মজনু’, ‘গুলে বকাওলী’ ইত্যাদি।

২. জঙ্গনামা : যুদ্ধ-সম্পর্কিত কাব্যকে জঙ্গনামা বলে। ইসলামের বিভিন্ন যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে দোভাষী পুঁথি রচিত হয়েছে। যেমন ‘জঙ্গনামা’, ‘আমীর হামজা’, ‘সোনাভান’, ‘কারবালার যুদ্ধ’ ইত্যাদি।

৩. পীর পাঁচালি : বিভিন্ন পীরের কাহিনি নিয়ে দোভাষী পুঁথি রচিত হয়েছে। যেমন ‘গাজী কালু চম্পাবতী’, ‘সত্যপীরের পুঁথি’ ইত্যাদি।

৪. ইসলামি আচার-অনুষ্ঠান : ইসলাম ধর্ম, নবী-আউলিয়ার জীবনী ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়েও দোভাষী পুঁথি রচিত হয়েছে। যেমন ‘কাসাসুল আম্বিয়া’, ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’, ‘হাজার মাসলা’ ইত্যাদি।

কবি

দোভাষী পুঁথির রচয়িতারা শায়ের নামে পরিচিত ছিলেন।

ফকির গরীবুল্লাহ

পুঁথিসাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি ফকির গরীবুল্লাহ্। তিনি হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। আঠারো শতকের মধ্যভাগে ১৭৬০–১৭৮০ সালে তিনি কাব্যসাধনা করেন বলে মনে করা হয়। তাঁর লেখা একটি কাব্য ‘ইউসুফ-জোলেখা’। কোরআন শরিফ ও বাইবেলে ইউসুফ-জোলেখার কাহিনি নৈতিক উপাখ্যান হিসেবে ব্যক্ত হয়েছে।

ফারসি সাহিত্যে ও বাংলায় এই কাহিনি নিয়ে কাব্য রচিত হয়েছে। কবি ফারসি কাব্যের অনুসরণে ‘ইউসুফ-জোলেখা’ রচনা করেন। ‘আমীর হামজা’ গরীবুল্লাহর অপর কাব্য। কবি এই কাব্যের প্রথম অংশ রচনা করেন। পরে সৈয়দ হামজা তা সমাপ্ত করেন। ফারসি ও উর্দুতে ‘আমীর হামজা’র কাহিনি কাব্যাকারে রূপায়িত হয়েছিল। কবি ফকির গরীবুল্লাহ্ সেসবের অনুসরণে তা বাংলায় রূপদান করেন। ‘জঙ্গনামা’ ফকির গরীবুল্লাহর আরেকটি বিশিষ্ট কাব্য।

 

কারবালার বিষাদময় কাহিনি এই কাব্যের উপজীব্য। কবি ফারসি কাব্য অবলম্বনে ‘জঙ্গনামা’ রচনা করেন। কবি এ কাব্যে একদিকে যেমন যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি গভীর বেদনার সুর ফুটিয়ে তুলেছেন। এ ছাড়া ফকির গরীবুল্লাহ্ ‘সোনাভান’ ও ‘সত্যপীরের পুঁথি’ রচনা করেন। ‘সোনাভান’ যুদ্ধের কাহিনি; বীর হানিফার সঙ্গে সোনাভানের যুদ্ধের কাহিনি এতে বর্ণিত হয়েছে।

সৈয়দ হামজা

পুঁথিসাহিত্যের ধারায় ফকির গরীবুল্লাহর অনুসারী হিসেবে সৈয়দ হামজার আবির্ভাব। তিনি ১৭৩৩-৩৪ সালে হুগলি জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা, পাঁচালি ও ছড়া রচনায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। আনুমানিক ১৭৮৮ সালে তিনি ‘মধুমালতী’ নামে একটি প্রণয়কাব্য রচনা করেন। কবি সম্ভবত ফারসি কাব্য থেকে বঙ্গানুবাদ করে এ কাব্যের রূপ দেন।

‘মধুমালতী’ অবশ্য দোভাষী পুঁথি বা মিশ্র ভাষারীতির কাব্য নয়। তাঁর মিশ্র ভাষারীতির কাব্য ‘আমীর হামজা’। এই কাব্যে কবি অসংখ্য যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য পুঁথির মতো এই কাব্যেও অলৌকিকতা বিদ্যমান। ‘জৈগুনের পুঁথি’ নামে সৈয়দ হামজা অপর একটি কাব্য রচনা করেন।

১৭৯৭ সালে ‘জৈগুনের পুঁথি’ রচিত হয়। সৈয়দ হামজার আরেকটি কাব্য ‘হাতেম তাই’। উর্দু ‘আরায়েশ মহফিল’ কাব্যের অনুবাদ ‘হাতেম তাই”। পরবর্তীকালে পুঁথিসাহিত্যে অনেক শায়েরই নিজ নিজ প্রতিভার পরিচয় দেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মোহাম্মদ দানেশ ‘চাহার দরবেশ’ রচনা করেন। ফারসি ‘কিসসা-ই-চাহার দরবেশ’ গ্রন্থের অনুবাদ এটি।

পুঁথিসাহিত্যে পীর-ফকিরদের কথা এসেছে ‘গাজী কালু ও চম্পাবতী’ পুঁথিতে। বিরাটনগরের রাজা সেকান্দার শাহর পুত্র গাজী ও তাঁর সহচর কালুর সংসার বৈরাগ্যের কাহিনি এবং গাজীর সঙ্গে রাজকন্যা চম্পাবতীর বিয়ের কাহিনি এই কাব্যের বিষয়। গাজীর বাঘ বাহিনীর সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের যুদ্ধের কাহিনিও এতে স্থান পেয়েছে। গাজীর মাহাত্ম্য নিয়ে পরে কবি আবদুল গফুর, আবদুল হাকিমও কাব্য রচনা করেন।

মর্সিয়া কাব্য

‘মর্সিয়া’ আরবি শব্দ। এর অর্থ শোক বা মাতম। কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসেনের শাহাদাতবরণের করুণ কাহিনি নিয়ে ফারসি ভাষায় কাব্য রচিত হয়। সেগুলোর অনুকরণে মধ্যযুগের শেষভাগে বাঙালি মুসলমান কবিরা কাব্য রচনা করেন। দোভাষী পুঁথির অন্তর্গত এ ধরনের কাব্যকে মর্সিয়া কাব্য বলে। মর্সিয়া সাহিত্যের উৎপত্তি কারবালার বিষাদময় কাহিনিকে ভিত্তি করে হলেও এর মধ্যে অন্যান্য শোক ও বীরত্বের কাহিনির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফাগণের বিজয় অভিযানের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনিও এই শ্রেণির কাব্যে স্থান পেয়েছে। ‘জঙ্গনামা’ নামে বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের কাব্য রচিত হয়েছে। এগুলো প্রকৃতপক্ষে শোককাব্য। তবে শোক প্রকাশের মধ্যেই এদের উদ্দেশ্য সমাপ্ত হয়নি, যুদ্ধকাব্য হিসেবে এদের গুরুত্বও কম নয়। বীরত্বের কাহিনি এসব কাব্যের প্রধান উপজীব্য। কারবালার করুণ কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে মর্সিয়া কাব্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে ।

কবি

মোগল আমলে বাংলায় মর্সিয়া সাহিত্য যাঁরা রচনা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ খান, হায়াত মামুদ, জাফর, হামিদ প্রমুখ। ইংরেজ আমলে মর্সিয়া সাহিত্য বিষয়ের দিক থেকে যথেষ্ট বৈচিত্র্যধর্মী হয়ে ওঠে। বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই।

শেখ ফয়জুল্লা

শেখ ফয়জুল্লাকে এ ধারার প্রথম কবি বলে মনে করা হয়ে থাকে। তিনি ‘জয়নবের চৌতিশা’ নামের কাব্যের রচয়িতা। কাব্যটি আকারে ক্ষুদ্র এবং কারবালার কাহিনির একটি ছোট অংশ অবলম্বনে রচিত। কবির জীবনকাল ষোলো শতকের শেষভাগ বলে মনে করা হয়।

দৌলত উজির বাহরাম খান

দৌলত উজির বাহরাম খান ‘জঙ্গনামা’ কাব্য রচনা করেন। কারবালার কাহিনি নিয়ে রচিত ‘জঙ্গনামা’ বা ‘মক্তুল হোসেন’ কবির প্রথম রচনা। তিনি চট্টগ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ‘লায়লী-মজনু’ তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা।

মুহম্মদ খান

মুহম্মদ খান চট্টগ্রামের অধিবাসী। তিনি ১৬৪৫ সালে ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি ফারসি মক্তুল হোসেন কাব্যের ভাবানুবাদ। কবির বৃদ্ধাবস্থায় এটি রচিত। কবি সতেরো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়।

সেরবাজ

আঠারো শতকের কবি শেখ সেরবাজ চৌধুরী ‘কাশিমের লড়াই’ কাব্য রচনা করেন। কবির জন্ম ত্রিপুরা জেলায়। মহররমের একটি ক্ষুদ্র বিবরণী ‘কাশিমের লড়াই’ কাব্যে স্থান পেয়েছে।

হায়াত মামুদ

আঠারো শতকের একজন বিখ্যাত কবি হায়াত মামুদ কবি রংপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘জঙ্গনামা’ কাব্য কবির প্রথম রচনা। ফারসি কাব্যের অনুসরণে কাব্যটি রচিত। কাব্যটির রচনাকাল ১৭২৩ সাল। হায়াত মামুদ সতেরো শতকের শেষে জন্মগ্রহণ করেন এবং আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁর আরও কিছু কাব্য পাওয়া গেছে।

জাফর

কবি জাফর ‘শহীদ-ই-কারবালা’ ও ‘সখিনার বিলাপ’ নামে মর্সিয়া কাব্য রচনা করেন। সম্ভবত আঠারো শতকের কোনো এক সময়ে এ কাব্য রচিত হয়।

হামিদ

আঠারো শতকের আর একজন কবি হামিদ। ‘সংগ্রাম হুসন’ নামে তিনি একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কাব্য রচনা করেন। মর্সিয়া কাব্যধারায় রাধারমণ গোপ নামে একজন হিন্দু কবির নাম পাওয়া যায়। তিনি ‘ইমামগণের কেচ্ছা’ ও ‘আফতনামা’ নামে দুটি কাব্য রচনা করেছিলেন। এগুলো আঠারো শতকে রচিত হয় বলে সুকুমার সেন মনে করেন।

Similar Posts