‘কপালকুণ্ডলা’ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস
‘কপালকুণ্ডলা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস
‘কপালকুণ্ডলা’ সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস । এ উপন্যাসের নিগূঢ় ভাবসঙ্গতির জন্য একে রোমান্সধর্মী উপন্যাস বলা হয়। উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে কাব্যের বৈশিষ্ট্য পল্লবিত করে বঙ্কিমচন্দ্র ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসটিকে একটি সার্থক শিল্পপ্রতিমা হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
অরণ্যে কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলাকে কেন্দ্র করে এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে অপরিচিতা এই নারীর নবকুমারের সাথে বিয়ে এবং সমাজ বন্ধনের সাথে তার দ্বন্দ্বই এর মূল কাহিনি । কপালকুণ্ডলার মধ্যে যে রহস্য, সে রহস্য উদ্ঘাটনই উপন্যাসের বিষয়বস্তু । প্রকৃতি-প্রীতি ও বিশ্ব প্রকৃতির গভীর গম্ভীর সৌন্দর্য সত্তার অপরূপ পরিচয়ে কপালকুণ্ডলা অনন্য, অসাধারণ মহিমার জন্মদাত্রী।
বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম বিশ্ব প্রকৃতির রহস্যময় অনুভব ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসেই প্রত্যক্ষগোচর। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি কাব্যধর্মী উপন্যাস। গিরিশচন্দ্র ঘোষ এ উপন্যাসের একটি নাট্যরূপ দেন ।
গ্রন্থ সংক্ষেপ
সপ্তগ্রামের বাসিন্দা নবকুমার সাগরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়ে। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয় । তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা নবকুমারকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। স্থানীয় মন্দিরের অধিকারীর সহায়তায় নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করে নিজের বাড়ি সপ্তগ্রামে ফিরে আসে। পথে মতিবিবি তথা লুৎফউন্নিসা নামক এক রমণীর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয় ।
এই মতিবিবি ছিল নবকুমারের প্রথম স্ত্রী যার সাথে কৈশোরে নবকুমারের বিয়ে হয়েছিল । পরে এক যুদ্ধের সময় মোঘলদের হাত থেকে রক্ষা পেতে মতিবিবিরা সপরিবারে মুসলমান হয়ে যাওয়ায় নবকুমারের পিতা পুত্রবধূকে আর গ্রহণ করেন নি । পথে নবকুমারকে দেখে মতিবিবি পুনরায় তাকে স্বামীরূপে লাভ করতে চায় ।
কিন্তু পরিচয় জানার পর নবকুমার তাকে প্রত্যাখ্যান করে। কপালকুণ্ডলা জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে বড় হওয়ায় স্বাভাবিক সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে অপরিচিত ছিল। নবকুমারের বাড়িতে সে সমাজের মানুষজন ও তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে থাকে। কপালকুণ্ডলার নাম বদলে রাখা হয় মৃন্ময়ী।
এদিকে কাপালিক কপালকুণ্ডলার সন্ধানে সপ্তগ্রামে চলে আসে। সে মতিবিবির সাহায্য চায়। উভয়ের লক্ষ্যই মিলে যায়। কাপালিক কপালকুণ্ডলাকে বলি দিতে চায় আর মতিবিবি চায় নবকুমারকে ফিরে পেতে । মতিবিবি ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করে কপালকুণ্ডলার সাথে বনের ভিতরে দেখা করে ।
ব্রাহ্মণবেশী মতিবিবির সাথে কপালকুণ্ডলাকে দেখতে পেয়ে নবকুমার তাকে ভুল বুঝে কষ্ট পায় । আর কাপালিক এই সুযোগ বুঝে সুরাপান করিয়ে নবকুমারকে উস্কে দেয় এবং তাকে বোঝাতে থাকে— অবিশ্বাসী কপালকুণ্ডলাকে বলি দিতে হবে । একপর্যায়ে কপালকুণ্ডলা কাপালিকের হাতে বলি হতে রাজি হয়।
বলির ঠিক পূর্বমুহূর্তে নবকুমারের সাথে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব সংঘাতময় কথোপকথনের সময় বালির পাড় ভেঙে কপালকুণ্ডলা পানিতে পড়ে যায় । নবকুমারও তাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাপ দেয়। এভাবে শেষ পর্যন্ত নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের মধ্য দিয়ে উভয়েই জীবনের চরম উপসংহারে উপনীত হয়।
সাহিত্যিক পরিচিতি
- জন্ম > ২৬ জুন ১৮৩৮; ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত কাঁঠালপাড়া গ্রামে ।
- উপন্যাস > Rajmohan’s Wife (১৮৬৪), দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫), কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬), মৃণালিনী (১৮৬৯), বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ইন্দিরা (১৮৭৩), যুগালাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), চন্দ্রশেখর (১৮৭৫), রাধারাণী (১৮৭৫), রজনী (১৮৭৭), কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮), রাজসিংহ (১৮৮২), আনন্দমঠ (১৮৮২), দেবী চৌধুরাণী (১৮৮৪), সীতারাম (১৮৮৭)।
- প্রবন্ধ গ্রন্থ > বিজ্ঞানরহস্য, বিবিধ সমালোচনা, সাম্য, প্রবন্ধপুস্তক, ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব অনুশীলন, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, বিবিধ প্ৰবন্ধ ।
- ব্যঙ্গাত্মক ও রসাত্মক প্রবন্ধ গ্রন্থ > লোকরহস্য, কমলাকান্তের দপ্তর, মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত।
- সম্পাদিত গ্রন্থাবলি > দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, বাঙ্গলা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান ।
- মৃত্যু > ৮ এপ্রিল ১৮৯৪ ।