বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার : গঠন ও কার্যাবলী

স্থানীয় সরকারের গঠন

বাংলাদেশের বর্তমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শহর ও গ্রামের জন্য আলাদা ভাবে গঠিত হয়েছে। প্রধান শহরগুলোর জন্য স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দু‘ ধরনের যেমন, সিটি করপোরেশন এবং পেীরসভা। আবার গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা তিন স্তর ভিত্তিক যেমন, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, এবং জেলা পরিষদ।
পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলা (খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান) বাদে বাকি ৬১ টি জেলায় এই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে। বাংলাদেশের স্থানীর সরকারের এসব স্তরের কাঠামো এবং কার্যাবলী নিয়ে আজকের আলোচনা।
গ্রামীণ স্থানীয় সরকার কাঠামো
 
ইউনিয়ন পরিষদ
 
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বনিম্ম স্তর হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ। স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ অনুসারে, প্রতিটি ইউনিয়ন ৯টি ওয়ার্ডে বিভক্ত হবে। একজন চেয়ারম্যান ও ৯ জন মেম্বার নিয়ে গঠিত হবে ইউনিয়ন পরিষদ। এছাড়া তিনটি আসন থাকবে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
ইউনিয়ন পরিষদের সকল সদস্য প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। পরিষদের মেয়াদাকাল হবে শপথ গ্রহণের পরবর্তী ৫ বছর। ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যেক সদস্যই সরকার কর্তৃক ভেতন ভাতা ভোগ করবে।
বি:দ্র: জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুসারে বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৫৭১ টি ইউনিয়ন রয়েছে।

ইউনিয়ন পরিষদের কার্যাবলী

  • ইউনিয়নে জনকল্যাণমূলক কাজ করা।
  • অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন।
  • প্রাথমিক শিক্ষা ও গণশিক্ষার বিস্তারে প্রদক্ষেপ নেওয়া।
  • গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষি, মংস এবং পশপালনে উংসাহ প্রদান।
  • কর আদায়, টোল আদায় সহ সরকারি যাবতীয় ফি সংগ্রহ করা।
  • সরকারি আইন এবং নির্দেশ সমূহ পালনে জনগণকে অবহিত করানো।
  • প্রতিটি শিশুর জন্ম নিবন্ধন করা
  • অপরাধমূলক ও ক্ষতিকর ব্যবসা বন্ধে নিষেধ করা।
  • গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করে জনসেবা নিশ্চিত করা।
  • দেশের খাদ্য খাটতি মেটাতে ও কৃষির উন্নয়নে বিনামূল্যে কৃষকদের সার সরবরাহ করা।
উপজেলা পরিষদ
 
গ্রামীণ স্থানীয় সরকার কাঠামোর দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে উপজেলা পরিষদ। উপজেলা পরিষদ আইন ২০০৯ অনুসারে, প্রত্যেক উপজেলা একজন চেয়ারম্যান, দু‘জন ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলা ১ জন এবং পুরুষ ১ জন),  সংরক্ষিত আসনে ২ জন মহিলা, মেম্বার, নিয়ে উপজেলা গঠিত হবে।
এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য উপজেলায় উপদেষ্টা বলে গণ্য হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (UNO) সরকারের প্রধান উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা যারা সরাসরি সরকার থেকে নিয়োগ পায়। চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং সংরক্ষিত ২ মহিলা আসন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। উপজেলার পরিষদের মেয়াদ হবে শপথ গ্রহণের পরবর্তী পাঁচ বছর।
বি:দ্র: বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৯৫ টি উপজেলা রয়েছে। সর্বশেষ উপজেলা মাদারী পুরের ডাসার।

উপজেলা পরিষদের কার্যাবলী

  • ৫ বছরের জন্য উপজেলার উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ
  • উপজেলার আন্ত সড়ক তৈরি এবং ব্যবস্থাপনা করা।
  • স্বাস্থ্য সম্মত স্যানিটেশন নিশ্চিত ও নিরাপদ পানি সরবরাহ করা।
  • মাদ্রাসা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করা।
  • উপজেলার কৃষি, বন সম্পদ, মংস, এবং পশু সম্পদের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ।
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, এবং পাচার থেকে মুক্ত হতে জনগণকে জনসচেতন করা।
  • ইউনিয়ন পরিষদকে প্রয়োজনীয় সাহার্য এবং সহযোগিতা প্রদান করা।
  • শিক্ষা বিস্তারে কাজ করা
  • আত্ম কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
  • পরিবেশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করা।
জেলা পরিষদ
 
জেলা পরিষদ আইন ২০০০ অনুসারে, প্রত্যেক জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, পনেরজন সদস্য, পাঁচজন মহিলা সদস্য (সংরক্ষিত আসন) নিয়ে গঠিত। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন সিটি করপোরেশনের মেয়র ও  কাউন্সিলর, পৌরসভা মেয়র ও কাউন্সিলর, এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারের ইলোক্টরাল ভোটে নির্বাচিত হবে। প্রতিটি জেলা পরিষদের মেয়াদ হবে ৫ বছর।
বি:দ্র: বর্তমানে বাংলাদেশে জেলার সংখ্যা ৬৪ টি।

জেলা পরিষদের কার্যাবলী

  • জেলার প্রত্যেক উন্নয়নমূলক কাজের পর্যালোচনা করা। কাজটি কি সঠিকভাবে হয়েছে নাকি হয়নি তা দেখভাল করা।
  • জেলার আন্ত সড়ক সমূহ, ব্রীজ, কালভার্ট তৈরি করা।
  • মহাসড়কের পাশে গাছ লাগিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা।
  • পাবলিক লাইব্রেরী স্থাপন করে জ্ঞান বিস্তার করা।
  • জেলার বাগান, খেলার মাঠ, মুক্ত মাঠ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা।
  • উপজেলা এবং পৌরসভার সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে সার্বিক তদারকি করা।
  • জেলার আইন শৃংখলা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
শহর বা পৌর এলাকার স্থানীয় সরকার
 
শহর এলাকার স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ২ স্তরের। যেমন,
১. পৌরসভা
২. সিটি করপোরেশন
বর্তমানে সমগ্র দেশে পৌরসভার সংখ্যা ৩২৮ টি এবং সিটি করপোরেশনের সংখ্যা মাত্র ১২ টি। সিটি করপোরেশনগুলো হচ্ছে ঢাকা উত্তর করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ করপোরেশন, চট্টগ্রাম করপোরেশন, রাজশাহী করপোরেশন, সিলেট করপোরেশন, খুলনা করপোরেশন, বরিশাল করপোরেশন, কুমিল্লা করপোরেশন, রংপুর করপোরেশন, গাজিপুর করপোরেশন, নারায়নগঞ্জ করপোরেশন, এবং সর্বশেষ ময়মনসিংহ করপোরেশন।
পৌরসভার গঠন
স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ অনুসারে, পৌরসভা গঠিত হয় একজন মেয়র, কাউন্সিলর, এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নিয়ে। প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে মেয়র, পুরুষ ও মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হবে, যার মেয়াদকাল থাকবে ৫ বছর।

পৌরসভার কার্যাবলী

  • পৌর এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা সরবরাহ করা।
  • নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন। শহর উন্নয়নের জন্য পরিকল্পিত রাস্তা ঘাট তৈরি, এবং গৃহ নির্মাণ করা।
  • শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিস্তার
  • জনসাধারণের জন্য পার্ক ও উদ্যান তৈরি
  • সড়ক সংরক্ষণ ও নিয়মিত ব্যবস্থাপনা। রাতের ভয়াবহ  অন্ধকার দূর কর করতে সড়কে আলোর ব্যবস্থা করা।
  • পৌর এলাকায় সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা। আগুন নিবানোর জন্য ফায়ার বিগ্রেড স্থাপন। এছাড়া মাদকদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় রোধ করা।
  • জনস্বাস্থ্য ও জনসচেতনা তৈরি করা। যে কোন সংক্রামক রোগের বিস্তাররোধ, কলেরা ও বসন্তের মত রোগের টিকাদান, এবং হাসপাতাল তৈরি করা।
  • সরকার কর্তৃক বিভিন্ন ট্যাক্স, টোল, এবং ফি আদায়।
সিটি করপোরেশন গঠন
 
বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ টি প্রধান শহরে সিটি করপোরেশন রয়েছে। সিটি করপোরেশন গঠিত হয় একজন মেয়র, সাধারণ কাউন্সিলর, এবং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিল নিয়ে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ অনুসারে, প্রত্যেক সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং কাউন্সিলরদ্বয় প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে।
বি:দ্র: ২০১১ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা ‍উত্তর ও ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশনে বিভক্ত হয়।

Similar Posts