বাঙালী ছাড়াও বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, মনিপুরি, মুরং, খাসিয়া, গারো, সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডার মতো বেশ কয়েকটি উপজাতি বা আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাস করে। এরা স্বতন্ত্র্য সংস্কৃতি ও প্রাচীন প্রথা অনুশীলনের জন্য বিখ্যাত।
বাংলাদেশে প্রায় ৪৫ টি উপজাতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এই জনগোষ্ঠীদের অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিং, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, কক্সবাজার এবং পটুয়াখালী অঞ্চলে বাস করে।
এসকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম সাঁওতাল। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম আদিবাসী এই সাঁওতালরা। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে সর্বমোট তিন লক্ষ্য সাঁওতাল বাস করে। সাঁওতালরা প্রথমদিকে শিকার এবং সংগ্রহ করে জীবনধারন করত। মধ্য-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি বনে এদের প্রাচীন নিবাস ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বন উজাড়, বন্য প্রাণী ও পাখির ঘাটতির ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যেতে হয়েছিল।
সাঁওতালরা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন আদিবাসী হিসাবে পরিচিত। নৃতাত্তিক গবেষকদের মতে, সাঁওতাল উপজাতি প্রোটো-অস্ট্রোলয়েডের জাতিগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বংশের লোকদের পূর্বপুরুষরা প্রায় দশ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে পাড়ি জমান। সাঁওতালদের ত্বকের রং এবং চুল কালো, তাদের ঠোঁট বড়, বিস্তৃত নাক এবং তাদের উচ্চতা মাঝারি ধরনের।
সাঁওতালরা প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক নৃগোষ্ঠী। পিতাই পরিবারের প্রধান কর্তা। পরিবারের ছেলে-মেয়েরা পিতার পরিচয়ে পরিচিত হয়। তবে, মহিলারাও অর্থনৈতিকভাবে পরিবারে অবদান রাখে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, স্ত্রীলোকেরা প্রায় সমানভাবে পরিবারের উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়।
সাঁওতাল উপজাতি ১১ টি গোত্রে বিভক্ত। গোত্রগুলো হল হাসদা, মুরমু, কিস্কু, হামব্রোম, মার্ডি, সওরেন, টুডু, বাসকি, বেসরা, চুরে, এবং পাউরিয়া। এই গোষ্ঠীগুলি টোটেম ভিত্তিক, (টোটেম হল প্রতীক, যা একটি দল, গোষ্ঠী, বা গোত্রের প্রতীক)। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে প্রতিটি বংশের নিজস্ব টোটেম রয়েছে এবং একটি বংশ এবং এর টোটেমের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান।
সাঁওতালদের গোষ্ঠী-ভিত্তিক এই সমাজ ব্যবস্থায় একই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। বিয়ের পর মহিলারা স্বামীর গোত্রে অবস্থান করে। সাঁওতাল খ্রিস্টানরা শিক্ষিত এবং প্রভাবশালী হয়ে থাকে। এই খ্রিস্টান সাঁওতালরা তাদের গোত্রের অযৌক্তিক কঠোর নিয়মনীতি মেনে চলে না। তারা একই বংশের হলেও বিয়ে করে।
সাঁওতালরা অতিপ্রাকৃত শক্তির পূজা করে। তারা তাদের ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলে অভিহিত করে। তারা হিন্দু ধর্মের মত প্রচুর দেবদেবীতে বিশ্বাস এবং এগুলোর আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নাচ, গান এবং মদ্যপান অন্তর্ভুক্ত। সাঁওতালদের এই স্বতন্ত্র্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খ্রিস্টধর্মের প্রচারের মধ্য দিয়ে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
সাঁওতালদের নিজস্ব লিপি রয়েছে, যার নাম অলচিকি লিপি। তবে, বাংলা লিপি, ওড়িষ্যা লিপি এবং রোমান লিপিতে এই ভাষার লিখন সর্বজনীন। সাঁওতালি ভাষায় মোট ৮টি স্বরধ্বনি এবং ৬টি অনুনাসিক স্বরধ্বনি এবং ২১টি ব্যঞ্জনধ্বনি অন্তর্ভুক্ত।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত। সাঁওতালি ভাষা হচ্ছে তাদের নিজস্ব ভাষা। গ্রামাঞ্চলে তারা একে অপরের সাথে সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে। কিন্তু যখন তারা ভিন্ন কারো সাথে কথা বলে, তখন তারা বাংলা ভাষায় বলে। সাঁওতাল বাচ্চারা সাধারণত জন্মের পর থেকে উভয় ভাষা শিখে থাকে।
সাঁওতালদের খাবার তাদের জীবনের মতই সহজ সরল। তাঁরা খাবারে খুব বেশি মশলা এবং তেল ব্যবহার করে না। যার কারণেই তারা চর্বি পায় না। প্রকৃতিই তাদের জীবনধারনের প্রধান মাধ্যম। তারা প্রকৃতির সমস্ত কিছু কাজে লাগায়। বাসস্থান বা ঘর নির্মাণ থেকে শুরু করে দেহের পুষ্টি উৎস সবকিছুই তারা প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করে।
ধান চাষ সাঁওতালদের খাবারের প্রধান উৎস। সাঁওতালদের ভাত রান্না ও খাওয়ার পদ্ধতি আলাদা ও বৈচিত্রময়। তারা ভাত রান্নার পর ভাতের থেকে পানি ফেলে দেয় না। তারা তা পুরোপুরি রেখে দেয়। এই খাদ্যকে ‘দা মাডি‘ নামে ডাকা হয়। এর সাথে তারা সাধারণত সবুজ শাকসবজি গ্রহণ করে। এছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরণের মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, পিঁপড়া, ইঁদুর, পাখি, ডিম ইত্যাদিও খেয়ে থাকে।
সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম সোহরাই। উৎসবটি মূলত ধনসম্পত্তি ও গরু-বাছুর বৃদ্ধির জন্য পালন করা হয়। প্রতি বছর পৌষ মাসে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে সোহরাই উৎসবের আয়োজন চলে ।
সোহরাই উৎসব উপলক্ষে বিবাহিতা নারীরা বাবার বাড়ি আসার সুযোগ পায়। ফলে সাঁওতাল নারীরা সারাবছর অপেক্ষায় থাকে উৎসবটির জন্য। তবে, সোহরাই উৎসবের কোন নির্ধারিত দিন বা তারিখ নেই। পৌষ মাসে, সাঁওতাল গোত্র প্রধান এর উপস্থিতিতে উৎসবের একটি দিন নির্ধারণ করে। সেই নির্ধারিত দিন থেকে পরবর্তী সাতদিন ব্যাপী চলে এই সোহরাই উৎসব।